বৃহস্পতিবার , ২৮শে মার্চ, ২০২৪ , ১৪ই চৈত্র, ১৪৩০ , ১৭ই রমজান, ১৪৪৫

হোম > গ্যালারীর খবর > অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ রানা প্লাজা ট্র্যাজেডি

অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ রানা প্লাজা ট্র্যাজেডি

শেয়ার করুন

বাংলাভূমি২৪ ডেস্ক ॥ স্বজন হারানো হামিদা, শাকিল, রুপা, রিহান, রবিন ওদের কেউ মা হারিয়েছে, কেউ বাবা। আবার কারও মা-বাবা দু’জনকেই কেড়ে নিয়েছে সর্বনাশা রানা প্লাজা ট্র্যাজেডি। পিতা-মাতাহীন এসব শিশু কেউ স্কুলে যায়, আবার কারও স্কুলে যাওয়ার বয়স হয়নি। ভয়াল এই দুর্ঘটনার প্রায় এক বছর হতে যাচ্ছে। কিন্তু চোখের জল শুকায়নি এই অসহায় শিশুদের। অবুঝ শিশুরা এখনও পথ চেয়ে থাকে তার মা-বাবার জন্য। নানা ছলনায় বাবা-মায়ের স্মৃতি ভুলিয়ে রাখছেন স্বজনরা। দুর্ঘটনার পর নিহতদের পরিবার ও শিশু সন্তানদের পাশে দাঁড়ানোর প্রতিশ্রুতি এসেছিল চারদিক থেকে। কিন্তু সময়ের সঙ্গে মিইয়ে গেছে এসব প্রতিশ্রুতি। অনাথ শিশুরা বেড়ে উঠছে অযতœ আর অবহেলায়। তাদের অনেকের ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত।
চার বছর বয়সী শিশু কুরবান আলী বিকালে মায়ের অপেক্ষায় বাড়ির সামনের সড়কে দাঁড়িয়ে থাকে। সে বিশ্বাস করে তার মা জীবিত আছেন। কোন এক বিকালে হয়তো তিনি ফিরবেন। রানা প্লাজায় কাজ করতেন কুরবানের মা জাহেদা বেগম। ওই ভবনের একটি গার্মেন্টের সুইং হেলপার ছিলেন তিনি। এখন শিশু কুরবান মায়ের জন্য কান্নাকাটি করলে তাকে মিথ্যা সান্ত্বনা দেয়া হয়- ‘তোমার মা দেশে গেছে, আসবে’। কিন্তু তার আর আসা হয় না। কুরবান আলীর রিকশাচালক পিতা আবদুল আলীম জানান, স্ত্রী জাহেদার লাশ বা কঙ্কাল পাননি তিনি। শ্রম মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, নিখোঁজ ৩০১ জনের মধ্যে এ পর্যন্ত ডিএনএ পরীক্ষা করে ২০০ জনের পরিচয় পাওয়া গেছে।
রিহান শেখ। ১৫ মাস বয়সী রিহানের ভবিষ্যৎ নিয়ে দুশ্চিন্তায় তার নানী নাজমা বেগম। রিহানের পিতা মনসুর শেখ ও মা রেহেনা বেগম কাজ করতেন রানা প্লাজার চতুর্থ তলার গার্মেন্ট হ্যামটনে। স্ত্রী-সন্তান নিয়ে থাকতেন শাশুড়ির সঙ্গে সাভার ইমান্দিপুর। ফাটলের কারণে গার্মেন্ট একদিন বন্ধ ছিলো। পরদিন ২৪শে এপ্রিল সকালে গার্মেন্টে যাওয়ার সময় মনসুর স্ত্রী রেহেনাকে তাগাদা দিয়ে বলেন, ‘তুমি যাবা না।’ রেহেনা বলেছিলেন, ‘না।’ মনসুরের শাশুড়ি জানান, তিনি মনসুরকে তাড়াহুড়া করতে বারণ করলে তিনি বলেছিলেন, ‘লেট হইলে বকা শুনন লাগবো। চাকরি থাকবো না। একটু আগেই যাই।’ রেহেনা সেদিন যেতে চাননি। তিনি বলেছিলেন, ‘রিহানকে রেখে যেতে ইচ্ছে করে না। লেট হোক রিকশায় যাবো। তবু ছেলের কাছে একটু থাকি।’
দুর্ঘটনায় রিহানের বাবা-মা দু’জনেই প্রাণ হারান। রেহেনার লাশের সঙ্গে ২০ হাজার টাকা ছাড়া সরকারি কোন সাহায্য জোটেনি। আত্মীয়-স্বজনের দানে-অনুদানে রিহানের দুধ কিনতে হয়। জামা-কাপড় কিনতে হয়। অচেনা কাউকে দেখলে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে সে। রিহানের নানী নাজমা বেগমের কোন পুত্র সন্তান নেই। নেই উপার্জনক্ষম কেউ। প্রথম দিনই এনাম মেডিকেলের ভেতর থেকে রেহেনার লাশ শনাক্ত করে আনেন নাজমা বেগম। এসময় কর্তব্যরত পুলিশ কর্মকর্তা অস্থায়ী ঠিকানা ইমান্দিপুর, সাভার লিখলেও ভুল করে স্থায়ী ঠিকানা লিখেন শরিয়তপুর। লাশের সঙ্গে ২০ হাজার টাকা পেলেও ওই ভুলের কারণে নিহতদের পরিবারের জন্য প্রধানমন্ত্রীর ঘোষিত অর্থ পাননি তারা। নয় দিন পর মনসুর শেখের লাশ গ্রহণ করেন তার ভাই সিরাজ শেখ। ওই সময়ে কোন কাগজে মনসুরের স্ত্রী ও সন্তানের কথা উল্লেখ করা হয়নি। পরে রিহানের দাদী সরকারি সাহায্য ১ লাখ টাকা পান। কিন্তু বঞ্চিত থেকে গেছে শিশু রিহান। রিহানের পিতার বাড়ি মানিকগঞ্জ জেলা সদরের নারসি ঘিওর গ্রামে।
একই ভাবে সরকারি সাহায্য থেকে বঞ্চিত গাইবান্ধা জেলার সাঘাটা থানার দুপারভিটা গ্রামের মুছা মুন্সি। পেশায় নির্মাণ শ্রমিক। সাভার ইমান্দিপুরের অস্থায়ী বাসিন্দা মুছা মুন্সীর তিন সন্তান। স্বামীর আয়-রোজগারে অনেক কষ্টে চলতে হতো। সন্তানদের লেখাপড়ার কথা চিন্তা করেই সুইং অপারেটর হিসেবে গার্মেন্টে কাজ নেন মুছার স্ত্রী বিলকিছ বেগম। কর্মস্থল রানা প্লাজার সপ্তম তলার নিউওয়েভ স্টাইল লিমিটেড। বিলকিছের বড় মেয়ে অষ্টম শ্রেণীতে অধ্যয়নরত খাদিজা আক্তার বলেন, ‘ছোট ভাই মামুনের বয়স তখন তিন বছর। ওই দিন বাসা থেকে যাওয়ার সময় মামুন আম্মার পিছু নিয়েছিল। সে আম্মার শাড়ির আঁচল ধরে রেখেছিল। আম্মা আমাদের লেখাপড়ার জন্যই এত কষ্ট করতেন। সেই আম্মা-ই আজ নেই।’ বলতে বলতে চোখের কোণে জল জমাট হয় তার। মুছা মুন্সী জানান, টাকার অভাবে সন্তানদের খাওয়া, জামা-কাপড় কেনা কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। সেখানে ঠিকমতো লেখাপড়ার খরচ যোগাতে পারছেন না। স্ত্রী বিলকিছের লাশ বা কঙ্কাল পাননি তিনি। যে কারণে সরকারি কোন সাহায্য-সহযোগিতা জুটেনি।
হামিদা ও হনুফা দু’বোন। সাভারের ইমান্দিপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে তৃতীয় শ্রেণী ও প্লে গ্রুপের শিক্ষার্থী। বিভিন্ন বাসায় পরিচারিকার কাজ করে সন্তানদের খরচ যোগাচ্ছেন তাদের মা। গার্মেন্টকর্মী পিতা আব্দুল হামিদ ছিলেন পরিবারে একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি। রানা প্লাজা কেড়ে নিয়েছে তাকে। বিদ্যালয়ে দীর্ঘ সময় থাকার কারণে পেটে ক্ষুধা লেগে যায় জানিয়ে হামিদা তার পিতাকে শেষবার বলেছিল, ‘আব্বা টোস্ট বিস্কুট আইনেন।’ কিন্তু টোস্ট বিস্কুট নিয়ে আর ফিরেননি পিতা। রানা প্লাজা ধসে পড়ার ১১দিন পর পিতার লাশ পেয়েছিলো তারা। সরকারি সাহায্য পেলেও পিতাকে হারিয়ে সবই হারিয়ে ফেলেছে হামিদা ও হনুফা।
রানা প্লাজা ধসে নিহত হয়েছেন নওগাঁ জেলার নিয়ামতপুর উপজেলার হাকিমপুরের রশিদ ও স্বপ্না দম্পতি। স্বামী-স্ত্রী কাজ করতেন রানা প্লাজার পঞ্চম তলার একটি গার্মেন্টে। এ দম্পতির দুই সন্তান। ভাবকুণ্ড উচ্চ বিদ্যালয়ের সপ্তম শ্রেণীর ছাত্রী রূপা ও বীরজোয়ান সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পঞ্চম শ্রেণীর ছাত্র শাকিল। মা-বাবাকে হারিয়ে দাদা-দাদীই তাদের আশ্রয়স্থল। মা-বাবার সহকর্মী কাউকে দেখলে অঝোর ধারায় কাঁদে রূপা ও শাকিল। রূপা জানান, নতুন জামা নিয়ে তাদের মা-বাবা আর আসবেন না। এসব কথা খুব মনে পড়ে তার। পারইল ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আবু হেনা মোস্তফা কামাল চৌধুরী জানান, রানা প্লাজা ধসের কয়েকদিন পর রশিদের লাশ পেলেও তার স্ত্রীর লাশ তখন পাওয়া যায়নি। গত মে মাসে ডিএনএ পরীক্ষার মাধ্যমে স্বপ্নার পরিচয়ও শনাক্ত করা হয়। নিহতের এই পরিবার যথারীতি সরকারি সাহায্য পেয়েছেন।
রানা প্লাজা ধসে যাওয়ার চারদিন পর বেঁচেও শেষ পর্যন্ত বাঁচতে পারেনি শাহিনা। তার ফুটফুটে সন্তান সায়ের রহমান রবিন এখন বড় হচ্ছে বড় খালা জেসমিনের কাছে। রবিনের বয়স এখন তিন বছর। মা কোথায়- রবিনের কাছে জানতে চাইলে সে বলে, ‘কাজে গেছে। বিকালে আসবে।’ মায়ের জন্য অন্তহীন অপেক্ষা চঞ্চল ছেলেটির। রবিনের জন্য প্রাপ্ত সরকারি সাহায্য ১ লাখ টাকা রয়েছে তার নানা আব্দুল মোতালিবের কাছে। এছাড়াও র‌্যাবের গোয়েন্দা শাখার তৎকালীন প্রধান কর্নেল জিয়াউল হাসান তার পুরস্কারের ৫ লাখ টাকার মধ্যে আড়াই লাখ টাকা এফডিআর করে দিয়েছেন রবিনের নামে। রানা প্লাজার মালিক রানাকে গ্রেপ্তারের জন্য ওই পুরস্কার পান তিনি। শাহিনাকে বাঁচাতে না পেরে সেদিন উদ্ধারকর্মীদের সঙ্গে কেঁদেছিলেন কোটি কোটি মানুষ। সন্তান রবিন জন্মের পূর্বেই স্বামীকে ছেড়ে কুষ্টিয়া থেকে ঢাকা-সাভারে বাবা, ভাই-বোনদের কাছে আশ্রয় নেয় শাহিনা। মৃত্যুর পর তার লাশ দেখতে স্বামী আসেনি। এ অবস্থায় এতিম রবিনকে লালনপালন করছেন তার খালা।
গার্মেন্ট শ্রমিক ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্রের সাভার-আশুলিয়ার সাধারণ সম্পাদক খাইরুল মামুন মিন্টু জানান, ডিএনএ টেস্টে অনীহাসহ নানা জটিলতায় সরকারি সাহায্য পাননি অনেক নিহতের সন্তান-স্বজনরা। নিখোঁজ শ্রমিকদের নিহত হিসেবে বিবেচনা করে তাদের পরিবারকে অনুদান দেয়ার দাবি জানিয়েছে শ্রমিকদের এই সংগঠন।
এদিকে প্রতিদিনই রানা প্লাজার ধ্বংসস্তূপ থেকে বের হচ্ছে মৃত মানুষের দেহাবশেষ। শনিবারও মৃত মানুষের হাড় পাওয়া গেছে সেখানে। কিন্তু ডিএনএ পরীক্ষার জন্য তা সংগ্রহে অনীহা কর্তৃপক্ষের। স্থানীয় শ্রমিকদের অভিযোগ, পুলিশ প্রহরা অনিয়মিত। যে কারণে ওই ভবনের রড চুরির জন্য পথশিশুরা তৎপর। এছাড়া, মৃতদের দেহাবশেষ পুলিশের কাছে নিয়ে গেলে পুলিশ তা গ্রহণ করতে অনীহা প্রকাশ করেন। এ বিষয়ে সাভার থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মোস্তফা কামাল বলেন, ‘পুলিশ প্রহরা নিয়মিত। তবে পাবলিকের দেয়া হাড় পুলিশ নেবে না। পুলিশ আইন অনুসারে তা সংগ্রহ করছে।’ টিএনএ পরীক্ষা না হওয়ার কারণে রানা প্লাজায় কর্মরত এখনও নিখোঁজ ১০১ জনের পরিবারের সদস্যরা বঞ্চিত হচ্ছেন সরকারি সাহায্য-সহযোগিতা থেকে। রানা প্লাজা ধসে নিহত হয়েছেন ১১৩৪ জন শ্রমিক। রানা প্লাজার নয়টি তলায় অবস্থিত পাঁচটি পোশাক কারখানায় এসব শ্রমিকরা কাজ করতেন। জীবিত উদ্ধার করা হয় ২৪৩৮ জনকে। তাদের অনেকেই গুরুতর আহত হলেও সরকারি সাহায্য পেয়েছেন মাত্র ৯৭ জন।
ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্রের তথ্য অনুযায়ী নিহতদের মধ্যে ৭৭৭ জনের পরিবারকে ১ থেকে ৫ লাখ টাকা পর্যন্ত সরকারি অনুদান দেয়া হয়েছে। অন্যদের বিষয়ে শ্রমিকদের স্থায়ী ঠিকানা অনুসারে সংশ্লিষ্ট জেলা প্রশাসকদের তদন্ত করার নির্দেশ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। জেলা প্রশাসকদের তদন্ত প্রতিবেদনের ভিত্তিতেই অন্যদের সহযোগিতা করা হবে বলে জানা গেছে। কিন্তু নানা জটিলতার কারণে সরকারি অনুদান পৌঁছেনি অনেকের হাতে। মানবজমিন