শুক্রবার , ১৯শে এপ্রিল, ২০২৪ , ৬ই বৈশাখ, ১৪৩১ , ৯ই শাওয়াল, ১৪৪৫

হোম > Uncategorized > অবৈধভাবে অনুদান নিচ্ছে ৮৫০টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান

অবৈধভাবে অনুদান নিচ্ছে ৮৫০টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান

শেয়ার করুন

স্টাফ রিপোর্টার ॥ দেশের প্রায় সাড়ে ৮শ’ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান অবৈধভাবে ‘স্তর পরিবর্তন’ করেছে। শুধু তাই নয়, অবৈধভাবে স্তর পরিবর্তন শেষে অনেক প্রতিষ্ঠান আবার অবৈধভাবে সরকারি অনুদান বা এমপিও (শিক্ষক-কর্মচারীদের জন্য বেতন-ভাতার সরকারি অংশ) নিতে সক্ষম হয়েছে। মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা অধিদফতরের হিসাবে এই অর্থের পরিমাণ ৫৩ কোটি টাকা। তবে সূত্র জানায়, প্রকৃত চিত্র আরও করুণ।

শিক্ষা মন্ত্রণালয়, মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদফতর (মাউশি) এবং ব্যানবেইসের সংঘবদ্ধ একটি চক্র অবৈধ ওই কাজটি করতে সহায়তা করেছে। বিষয়টি ইতিমধ্যে তদন্তে প্রমাণিত। প্রায় পৌনে দু’বছর আগে বিষয়টি ধরা পড়লেও জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। এদিকে বিষয়টি উদঘাটিত হওয়ার পর এ নিয়ে হৈচৈ যখন তুঙ্গে, তখন এতে হস্তক্ষেপ করে শিক্ষা মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি। এ ব্যাপারে তাদের সাত সদস্যের একটি উপ-কমিটি তদন্ত শেষে পৌনে দু’শ প্রতিষ্ঠানকে স্তর পরিবর্তনের যোগ্য বলে সুপারিশ করে। তাদের রিপোর্ট অনুযায়ী পৌনে ৭শ’ প্রতিষ্ঠানের কোনো ধরনেরই যোগ্যতা নেই স্তর পরিবর্তনের অর্থাৎ এ খাতে ব্যয়িত সরকারি অর্থ এক প্রকার গচ্চা যাচ্ছে। তাদের সুপারিশ বাস্তবায়ন হলে পৌনে ৭শ’ প্রতিষ্ঠানকে আগের অবস্থায় ফিরে যেতে হবে।

সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, অবৈধ এই স্তর পরিবর্তনের বিষয়টি বৈধ করা হলে সরকারকে এসব প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা বা এমপিও বাবদ সব মিলিয়ে বছরে অন্তত একশ’ কোটি টাকা খরচ করতে হবে। তবে স্থায়ী কমিটির সুপারিশের ভিত্তিতে অবৈধভাবে স্তর পরিবর্তনকারী পৌনে ২শ’ প্রতিষ্ঠানকে যদি এমপিও দেয়া হয়, সে ক্ষেত্রে খরচ ১৫ কোটি টাকায় নেমে আসবে।

এ নিয়ে তদন্তের নেতৃত্বদাতা শিক্ষা মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য অধ্যক্ষ মোঃ শাহ আলম যুগান্তরকে বলেন, অনুসন্ধানে তারা সাড়ে ৮শ’ প্রতিষ্ঠানের মধ্যে শতাধিক হাইস্কুল ও উচ্চ মাধ্যমিক কলেজ এবং ৭৭টি ডিগ্রি কলেজকে পেয়েছেন যাদের স্তর পরিবর্তন হওয়া প্রয়োজন। অর্থাৎ এসব প্রতিষ্ঠান ছাত্রছাত্রীসহ অন্যান্য শর্ত পূরণ করেছে। বাকিদের ন্যূনতম যোগ্যতাও নেই। এ কারণে ওই পৌনে দু’শ প্রতিষ্ঠানের স্তর পরিবর্তনকে জরুরি ভিত্তিতে, মানবিক কারণে ও শিক্ষা সম্প্রসারণের স্বার্থে বৈধ করে নেয়ার পরামর্শ স্থায়ী কমিটি দেয়। তবে একই সঙ্গে অবৈধ এ কাজটির সঙ্গে জড়িত সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতেও বলা হয়েছে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ‘স্তর পরিবর্তন’ বলতে নিু মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে, মাধ্যমিক থেকে উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয় বা কলেজ এবং উচ্চ মাধ্যমিক থেকে ডিগ্রি কলেজে উন্নীত হওয়াকে বোঝায়। সূত্র জানায়, নিয়মবহির্ভূতভাবে স্তর পরিবর্তন করে ২২০টি নিু মাধ্যমিক হয়েছে মাধ্যমিক, ৭১টি মাধ্যমিক উচ্চ মাধ্যমিক হয়েছে বা কলেজ এবং ৫৫৫টি উচ্চ মাধ্যমিক হয়ে গেছে ডিগ্রি কলেজ। সরকারি নিয়ম অনুযায়ী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের স্তর পরিবর্তনের সঙ্গে এর কোড নম্বরও পরিবর্তিত হয়। প্রতিষ্ঠানকে শনাক্ত এবং সরকারি আর্থিক অনুদান বা এমপিও দেয়ার কাজে লাগে সেটি।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, বিষয়টি ধরা পড়ার পর ২০১২ সালের ২৬ জানুয়ারি মন্ত্রণালয়ের উচ্চপর্যায়ের সভায় কেবল মাধ্যমিক ও নিু মাধ্যমিক স্তরেরই মোট ৩৬১টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ‘কোর্ড পরিবর্তন’ করে এমপিওভুক্তির সুবিধা নেয়ার তথ্য উপস্থাপন করা হয়েছিল। পরবর্তীকালে সংখ্যা কমিয়ে ২৯১টি করা হয়। ওই সভায় বলা হয়, স্তর পরিবর্তনের পর প্রতিষ্ঠানগুলো অবৈধ ও অনুমোদিতভাবে এমপিওভুক্তও করা হয়। এতে বছরে এ খাতে অতিরিক্ত ৫৩ কোটি টাকা খরচ হচ্ছে। শিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং মাধ্যমিক, মাউশি ও ব্যানবেইসের একশ্রেণীর কর্মকর্তা-কর্মচারীর যোগসাজশে বছরের পর বছর শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের স্তর কোড পরিবর্তন করে শিক্ষক-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা দেয়া হচ্ছে। এর মধ্যে বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে কোড পরিবর্তনকারী প্রতিষ্ঠানও রয়েছে বলে জানা গেছে। অর্থাৎ দেড় দশক ধরে মাউশির সংঘবদ্ধ চক্র ঘুষের বিনিময়ে এ অপকর্ম করে যাচ্ছে।

জানা গেছে, এরপর বিষয়টি খতিয়ে দেখতে মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (প্রশাসন) এসএম গোলাম ফারুকের নেতৃত্বে ১০ সদস্যের কমিটি গঠন করা হয়। গত বছরের ২২ এপ্রিল ওই কমিটির সভা হয়। অন্যদিকে বিষয়টি নিয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটিও কাজ করে। স্থায়ী কমিটি বিষয়টি নিয়ে অধ্যক্ষ শাহ আলম এমপির নেতৃত্বে ৭ সদস্যের আরেকটি সাব-কমিটি গঠন করে দেয়। ওই কমিটি দীর্ঘদিন কাজ শেষে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে পৌনে ২শ’ প্রতিষ্ঠানের স্তর পরিবর্তনকে ইতিবাচকভাবে দেখার সুপারিশ করে। অবশ্য সংসদীয় স্থায়ী কমিটিকে ২৯১টি স্কুল ও কলেজের আর্থিক দুর্নীতি উদঘাটন, কোড পরিবর্তনের কারণে সরকারের আর্থিক সংশ্লেষ থাকবে না- এমন প্রতিষ্ঠানের তালিকা প্রণয়ন, কোড পরিবর্তনের ত্র“টি চিহ্নিত ও এমপিও নির্দেশিকায় বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত, এমপিও নির্দেশিকা সংশোধন, ৫৫৫টি কলেজকে ডিগ্রি স্তরে উন্নীতকরণে আর্থিক ক্ষতিসাধনের বিষয়ে তদন্ত প্রতিবেদন জরুরি ভিত্তিতে দাখিল এবং কোডবহির্ভূত ডিগ্রি ও মাস্টার্স পর্যায়ের এমপিও সংক্রান্ত তথ্য সংগ্রহের দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল।

এদিকে সূত্র জানিয়েছে, ৫৫৫টি কলেজকে ডিগ্রি স্তরে উন্নীত করা সংক্রান্ত তদন্ত কমিটির রিপোর্ট সংসদীয় কমিটিকে দেয়া হয়েছে। তাতে সংশ্লিষ্ট কলেজের শিক্ষক-কর্মচারীদের এমপিওভুক্তির কাজে মাউশি ও ব্যানবেইসের কিছু কর্মকর্তাকে চিহ্নিত করা হয়। তাদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ও আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়ার সুপারিশ করা হয়েছে। কিন্তু তা আজ পর্যন্ত বাস্তবায়ন হয়নি। তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়, ৫৫৫টির মধ্যে ৫০৬টি কলেজকে ডিগ্রি স্তরে পরিবর্তনের কাজ মন্ত্রণালয়ে সম্পন্ন হয়েছে। কোড পরিবর্তনেরও আদেশ দেয়া হয়েছে। এতে ভবিষ্যতে এমপিও প্রদান, স্তর পরিবর্তন ইত্যাদি অনিয়ম বন্ধে এমপিও সংক্রান্ত আইন করার সুপারিশ করা হয়। এমপিও নির্দেশিকায় কোড পরিবর্তনের বিষয়টিও অন্তর্ভুক্ত করার সুপারিশ রয়েছে।

সূত্র জানায়, গত বছরের জানুয়ারির বৈঠকে শিক্ষামন্ত্রী বলেছেন, যাচাই-বাছাই ছাড়া কোনো প্রতিষ্ঠানের কোড পরিবর্তন বাতিল করা হলে স্থানীয় এমপি প্রশ্নের মুখে পড়তে পারেন। ফলে কেস-টু-কেস যাচাই-বাছাই করে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। এ কারণেই বিষয়টি নিষ্পত্তিতে বিলম্ব ঘটছে। আরেকটি সূত্র জানায়, কোড পরিবর্তনকারী কোনো প্রতিষ্ঠানের এমপিও বাতিল বা স্থগিত হওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই। কেননা অনেক প্রতিষ্ঠানই ইতিমধ্যে সরকারি দলের ছত্রছায়ায় চলে গেছে। তাছাড়া প্রতিষ্ঠানগুলোর সামাজিক অবস্থানকেও মন্ত্রণালয়ের নীতিনির্ধারকরা ভয় পাচ্ছেন। তাই স্তর পুনর্বিন্যাসের ফলে সরকারের ব্যয়ের পরিমাণ আরও বাড়বে এবং এজন্য বাড়তি অর্থ চাইতে হবে মন্ত্রণালয়কে। মন্ত্রণালয়ও শেষ পর্যন্ত অবৈধ স্তর পরিবর্তনকে বৈধতা দেবে। কিন্তু প্রশ্ন উঠেছে, অনিয়মকারীরাও এভাবে প্রমার্জন পাবে কিনা।

সংশ্লিষ্টদের বক্তব্য : জানতে চাইলে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের যুগ্মসচিব ও মন্ত্রণালয়ের তদন্ত কমিটির সদস্য এএস মাহমুদ বলেন, কোড পরিবর্তনের বিষয়টি নিয়ে এখন সংসদীয় উপ-কমিটি তাদের রিপোর্ট জমা দিয়েছে। এখন তা নিয়ে মাউশি কাজ করছে। তাদের কাজ শেষ হলেই মন্ত্রণালয় এ নিয়ে প্রয়োজনীয় সিদ্ধান্ত নেবে। তিনি বলেন, কোড পরিবর্তনের ঘটনায় একটা অনিয়ম হয়েছে। এটা তাদের সময়ে ঘটেনি। তবে অনেক আগে থেকে চলে আসছে। এতে বিভিন্ন পর্যায়ের ব্যক্তিরা জড়িত। দোষী প্রমাণিত হলে সরকার এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেবে।

মাউশি মহাপরিচালক অধ্যাপক ফাহিমা খাতুন বলেন, মাউশিতে সব ধরনের দুর্নীতির পেছনে থাকে আর্থিক সংশ্লেষ। অর্থের বিনিময়ে একশ্রেণীর কর্মকর্তা-কর্মচারী কখনও এমপিও পাইয়ে দেয়। আবার স্তর বা কোড পরিবর্তন করে দিয়ে বাড়তি এমপিও দিয়েও অবৈধ অর্থ আয় করে থাকে। এ ধরনেরই একটি দুর্নীতি তিনি যোগদানের পর ধরেছেন। মোট ২৭৩ জনকে এমপিও দেয়া হয়েছে যাদের নাম কমিটি অনুমোদন করেনি কিন্তু তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করে দেয়া হয়েছে।

এ কাজে সংশ্লিষ্ট শাখা আর কম্পিউটার সেল জড়িত। ওই অপকর্মে ১৫ জনের সংশ্লিষ্টতা পাওয়ার পর তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার সুপারিশ করেছে তদন্ত কমিটি। কোড পরিবর্তনের ঘটনাটিও এ ধরনের একটি দুর্নীতি ও অনিয়ম। ওই ঘটনায় যারা জড়িত তাদের অনেকেই অবসরে চলে গেছেন। এখন অবসরে যাওয়া ওই সব ব্যক্তির বিরুদ্ধে কী ব্যবস্থা নেয়া যায়- তা নির্ধারণে ঊর্ধ্বতন পর্যায়ের মতামত নেয়া হবে। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, অনুসন্ধান চালালে অন্তত এক লাখ এমপিও মিলবে যা বৈধভাবে অর্জিত নয়।