বৃহস্পতিবার , ১৮ই এপ্রিল, ২০২৪ , ৫ই বৈশাখ, ১৪৩১ , ৮ই শাওয়াল, ১৪৪৫

হোম > গ্যালারীর খবর > আজ কাপাসিয়া হানাদার মুক্ত

আজ কাপাসিয়া হানাদার মুক্ত

শেয়ার করুন

আকরাম হোসেন রিপন
কাপাসিয়া ব্যুরো ॥
গাজীপুর: আজ ২৪ নভেম্বর ১৯৭১ সালে এই দিনে কাপাসিয়া হানাদার মুক্ত হয়েছিল। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে কাপাসিয়ার জন্য এটি একটি স্মরণীয় দিন। বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতিতে যিনি নেতৃত্ব দিয়ে গৌরবোজ্জ্বল বিজয় ছিনিয়ে আনেন। কাপাসিয়া তাঁর পূণ্য জন্মভূমি। তিনি হলেন বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী বঙ্গতাজ তাজউদ্দিন আহম্মদ। তাঁর পথ ধরেই সেদিন বীর সেনারা মূলত বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণের পর থেকে শুরু হয় কাপাসিয়ায় মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি। ১৯ মার্চ ১৯৭১ মাহমুদ আলম খান বেনুর নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধারা সর্ব প্রথম শপথ গ্রহণ হয়Ñজীবন দিয়ে হলেও মুক্তিযুদ্ধ করে বাংলাদেশকে স্বাধীন করবো। সেই থেকে শুরু হয় দেশের অভ্যন্তরে অস্ত্র সংগ্রহ ও প্রশিক্ষণ। পরবর্তীতে ভারত গমন, প্রশিক্ষণ শেষে অস্ত্রশস্ত্রসহ পুনরায় কাপাসিয়ায় আগমন এবং পাক সেনাদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন ধরনের অপারেশন শেষে ২৪ নভেম্বর কাপাসিয়া হানাদার মুক্ত হয়।

সাবেক এমপি বীর মুক্তিযোদ্ধা মুহম্মদ শহীদুল্লাহ জানায়, ১৯৭১ সালের ২০ নভেম্বর ঈদুল ফিতরের আগের দিন তরগাঁও খেয়াঘাটে পাক সেনাদের সাথে সম্মুখ যুদ্ধে অবতীর্ণ হই। আমাদের কৌশলী আক্রমণ এত তীব্র ছিল যে, তারা নৌকা দিয়ে কাপাসিয়া পাক সেনা ক্যাম্পে পশ্চাদাচরণ করতে বাধ্য হয়েছে এবং আমাদের গুলিতে নৌকায় থাকা বেশ কয়েকজন পাক সেনা নিহত হয়। অপর দিকে তাদের গুলিতে টোক এলাকার মুক্তিযোদ্ধা নরেন ও চরখামের মুক্তিযোদ্ধা সাহাব উদ্দিন গুলিবিদ্ধ হয়ে আহত হন। দুই মুক্তিযোদ্ধাকে চিকিৎসা শেষে সুস্থ করে তোলা হয়। এরপর আমরা পরিকল্পনা করি কাপাসিয়া পাকসেনাদের ক্যাম্পে আক্রমণ করে কাপাসিয়া হানাদার মুক্ত করবো। সে অনুযায়ী পাকসেনাদের অবস্থান কৌশলগত বিভিন্ন দিক ঠিক করি ও আক্রমণ রচনা করার জন্য রায়েদ ইউনিয়নের বাগেরহাট গ্রামের বীর মুক্তিযোদ্ধা নাজিম উদ্দিনকে কাপাসিয়া পাঠাই। তিনি বাংলাদেশ রেলওয়েতে ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগে চাকুরী করে বর্তমানে অবসর জীবন যাপন করছেন। তিনি ছিলেন অসীম সাহসী ও বুদ্ধিমান। ১৯৭১ সালে ২২ নভেম্বর নাজিম উদ্দিন ছদ্মবেশে কাপাসিয়া পাইলট উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে পাক সেনাদের ক্যাম্পে যান। তাদের সাথে মাঠে ফুটবল খেলেন। স্থানীয়ভাবে যারা খেলায় অংশ গ্রহণ করেছিলেন তাঁদের কাছ থেকেও প্রয়োজনীয় বিভিন্ন তথ্য সংগ্রহ করেন। তাছাড়া আমি নিজে রাজাকারদের কাছ থেকে তথ্য সংগ্রহ করি। আমিও সনমানিয়া ইউনিয়নের ধানদিয়া বটতলার মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্প থেকে খেয়া পার হয়ে সাফাইশ্রী মোড়ে অবস্থিত কৃষি অফিসে অবস্থান নেই। সম্ভবত: কৃষি উন্নয়ন কর্পোরেশনের অফিস ছিল। আমার যতদূর মনে পড়ে অফিসারের বাড়ী ছিল ময়মনসিংহের গফরগাঁও। আমি ওই অফিসে বসে যে সকল রাজাকার পাকসেনা ক্যাম্প থেকে রাস্তায় টহল দেয় তাদের সাথে যোগাযোগ করি। তারা আমার সাথে দেখা করে। তাদের কাছ থেকে প্রয়োজনীয় তথ্য সংগ্রহ করি। আমার সহপাঠি বন্ধু ফজলু। বাড়ী কাপাসিয়া ইউনিয়নের জামিরারচর গ্রামে। সে কাপাসিয়া পাক সেনাক্যাম্পে দায়িত্বরত রাজাকার ছিল। আমি তার সাথে বন্ধুত্বের সম্পর্ক নিয়ে যোগাযোগ করি। তার সাথে সাক্ষাৎ এবং আক্রমণের পরিকল্পনার জন্য তার গ্রামের বাড়ীতে যাওয়ার পরিকল্পনা করি। সে মতে ২২ নভেম্বর রোজার ঈদের পরের দিন আমি ও আরেক সহযোদ্ধা বন্ধু মো: রফিকুল ইসলাম, বাড়ী চাঁদপুর এবং সনমানিয়া ইউনিয়নের আড়াল গ্রামের কেসলু ভাইকে নিয়ে আমরা তিনজন ধানদিয়ার রফিক নায়েবের বাড়ীতে স্থাপিত মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্প থেকে জামিরারচরের উদ্দেশ্যে পায়ে হেঁটে রওয়ানা দেই। দুপুর ১২টার দিকে জমিরারচরের শাহাজাহান ভাইদের বাড়ীতে যাই। শাহজাহান ভাই ব্যবসায়ী, একসময় ঢাকা বিখ্যাত ইব্রাহিম ট্রেইলার্স পরিচালনা করতেন। বিকাল অনুমান ৩/৩-৩০টার দিকে পূর্ব নির্ধারিত সময় ও স্থানে রাজাকার বন্ধু ফজলু আমার সাথে সাক্ষাৎ করতে আসে। আমি তাকে নিয়ে এমন একটি জায়গায় বসেছিলাম যার চর্তুদিকে গাছগাছড়া ঝোপ জঙ্গলের মত ছিল। আমার নিরাপত্তার জন্য ওই ঝোপ দুটোতে মুক্তিযোদ্ধা রফিক ও কেসলু অস্ত্র নিয়ে এ্যাম্বুস অবস্থানে ছিল যাতে ফজলু আমার কোন রকম ক্ষতি করতে না পারে। বন্ধু হলেও রাজাকার, সেজন্য মুক্তিযোদ্ধা হিসাবে আমাকে সর্বদা সতর্ক থাকতে হয়েছে। এমতাবস্থায় আলাপচারিতার এক পর্যায়ে ফজলু একটি সিগারেট জ্বালিয়ে আরেকটি সিগারেট আমাকে দেয় । আমি তখন তাঁর জ্বালিয়ে সিগারেটটি নিলাম এবং সে আমাকে যেটি দিয়েছিল সেটি তাকে জ্বালিয়ে নিতে বললাম, যা হউক তার সাথে আলাপ করে পাক সেনা ক্যাম্প আক্রমণের পুরো কৌশল নির্ধারণ করলাম। ২৩ নভেম্বর রাতে পাক সেনাদের ক্যাম্প আক্রমণের সিদ্ধান্ত নিলাম। তাই ওই রাতে বেনুদাকে সকল তথ্য সর্বরাহ করি এবং কাপাসিয়া অবস্থানরত সকল গ্রুপের মুক্তিযোদ্ধাদেরকে কখন কোথায় কী ভাবে অবস্থান নিতে হবে সে বিষয়ে যেন বেনুদা সমন্বয় করতে পারেন। ২২ নভেম্বর রাতে ও ২৩ নভেম্বর দিনে সংশ্লিষ্ট সকলকে আক্রমণের সুনির্দিষ্ট নির্দেশনা মতে মুক্তিযোদ্ধারা ২৩ নভেম্বর রাতে বিভিন্ন স্থানে অবস্থান নেয়। এমন অবস্থায় রাজাকাররা ভীত হয়ে পড়ে, পাক সেনারাও বিভিন্ন স্থানে মুক্তিযোদ্ধাদের আক্রমণের তীব্রতায় মনোবল হারিয়ে ফেলে।

২৪ নভেম্বর ভোর ৬টার দিকে পাক সেনারা কাপাসিয়া ক্যাম্প ছেড়ে ঢাকার দিকে রওয়ানা দেয়। আমি তখন জামিরারচরে শাজাহান ভাইদের বাড়ীতে ছিলাম। লোকজন এসে খবর দিল পাক সেনারা চলে যাচ্ছে। এ খবর পেয়ে জামিরারচর ব্রীজের কাছে যেয়ে দেখি স্থানীয় পাক সেনারা আর্মির গাড়ীতে ও দালালরা গরুর গাড়ীতে চড়ে চলে যাচ্ছে। তারপর আমরা পাকা রাস্তায় এন্টিটেঙ্ক মাইন পোতার সিদ্ধান্ত নেই, এ গুলো নিয়ে আমাদের আশ্রয় স্থল থেকে আসতে আসতে ইতোমধ্যে পাকসেনারা জামিরারচর ব্রীজ অতিক্রম করে রাজেন্দ্রপুরের দিকে অগ্রসর হয়ে যায়। তাদের আক্রমণ করে গতিরোধ করার সুযোগ পাইনি। তবে তারা চলে যাওয়ার সাথে সাথেই জামিরারচর ব্রীজের পূর্ব পাশে অবস্থানরত রাজাকারদের ঘেরাও করিলে অস্ত্রসহ তারা আত্মসমর্পন করে। পরে তাদের মাথায় রাইফেল ও গোলাবারুদ দিয়ে কাপাসিয়ার দিকে নিয়ে আসি। তাদেরকে নিয়ে জয় বাংলা স্লোগান দিতে দিতে কাপাসিয়া পাইলট স্কুলে যেখানে পাকসেনাদের ক্যাম্প ছিল সেখানে নিয়ে আসি। তখনও কাপাসিয়া নদীর ওপারে চরে মুক্তিযোদ্ধারা অক্রমণ করার জন্য অবস্থান করছিল। আমি তখন কাপাসিয়া পাইলট স্কুলের নদীরপাড়ের আমগাছতলায় একটি উঁচু পিলারের উপর দাঁড়িয়ে রাজাকারদের নিয়ে “জয় বাংলা” স্লোগান দেই ও কাপাসিয়া মুক্ত ঘোষণা করি। সকলে এ্যাম্বুস উঠিয়ে হানাদার মুক্ত কাপাসিয়া আসুন। দুপুরে সকল মুক্তিযোদ্ধারা কাপাসিয়া আসে এবং সবাই মিলে বাঙ্গালীর প্রাণের স্লোগান “জয় বাংলা”ধ্বনিতে কাপাসিয়া মুখরিত করে তুলি। এভাবে মুক্তিযুদ্ধের ২৪৪ দিনের মাথায় কাপাসিয়া হানাদার মুক্ত হয়।