শুক্রবার , ২৬শে এপ্রিল, ২০২৪ , ১৩ই বৈশাখ, ১৪৩১ , ১৬ই শাওয়াল, ১৪৪৫

হোম > Uncategorized > আন্দোলনরতদের পুলিশের লাঠিপেটা ॥ গার্মেন্ট শিল্পে আগামী শনিবার ধর্মঘট

আন্দোলনরতদের পুলিশের লাঠিপেটা ॥ গার্মেন্ট শিল্পে আগামী শনিবার ধর্মঘট

শেয়ার করুন

স্টাফ রিপোর্টার ॥ তোবা গার্মেন্টের শ্রমিকদের বকেয়া বেতন-ভাতা দেয়া ও নেয়া নিয়ে গতকাল দিনভর ছিল নাটকীয়তা। একদিকে রাজধানীর বাড্ডা এলাকার তোবা গার্মেন্টের ভবন হোসেন মার্কেটে শ্রমিকদের বিজিএমইএ থেকে বেতন-ভাতা আনতে গেটে তালা দিয়ে বাধা দেয়া হয়। অন্যদিকে বিজিএমইএ ভবনে বেতন দেয়ার প্রক্রিয়া চললেও মাত্র ৫০০ শ্রমিক গতকাল রাত পর্যন্ত বেতন নিয়েছেন। তোবার কারখানায় প্রায় ১৬০০ কর্মী রয়েছেন। আজ আবার সকাল থেকে রাত নয়টা পর্যন্ত বেতন দেয়ার ঘোষণা দিয়েছে বিজিএমইএ। এদিকে আন্দোলনরত শ্রমিকরা দাবি আদায়ে আগামী শনিবার সারা দেশে গার্মেন্ট শিল্পে ধর্মঘটের ডাক দিয়েছে। গতকাল শ্রমিকদের আন্দোলনে সংহতি প্রকাশ করতে যাওয়া শ্রমিক নেতা ও বিশিষ্টজনদের ওপর পুলিশ লাঠিচার্জ করে। তাদের বিক্ষোভ মিছিলে বাধা দেয়া হয়।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, ভোর থেকে কারখানার সামনে পুলিশ ভ্যান, জলকামান ও এপিসি নিয়ে প্রায় শতাধিক পুলিশ অবস্থান নেয়। প্রতিদিনের মতো অনেক শ্রমিক রাতে বাসায় গিয়েছিলেন। অনশনকারী শ্রমিকদের পাশে যারা ছিলেন তাদের মধ্যে কেউ কেউ ফজরের নামাজ পড়তে মসজিদে গিয়েছিলেন। নামাজ শেষে তারা ফিরে এসে দেখেন কারখানার প্রধান চারটি গেটে নতুন তালা ঝুলিয়ে দেয়া হয়েছে। প্রতি গেটের সামনে অবস্থান নিয়েছে পুলিশ। এ সময় শ্রমিকরা কারখানার ভিতরে যেতে চাইলে পুলিশ বাধা দেয় তাদের। শ্রমিক মুক্তি আন্দোলন সভাপতি শবনম হাফিজ জানান, কারখানার ভিতরে প্রায় ১২০০ শ্রমিক অবস্থান করছেন। অনশনরত শ্রমিকরা দুর্বল হয়ে পড়ায় ৫০ জন শ্রমিকের শরীরে তখন স্যালাইন চলছিল। তাদের মধ্যে বেশ কয়েক জন অসুস্থ হয়ে পড়লে সংগ্রাম কমিটির নেতৃবৃন্দসহ সাধারণ শ্রমিকরা পুলিশকে বারবার জানানোর পরেও মানবাধিকারের প্রতি কোন শ্রদ্ধা না দেখিয়ে তারা বিজিএমইএ’র কাছ থেকে বকেয়া বেতন আনার জন্য শ্রমিক ওপরে জবরদস্তি করে।
তোবার ফিনিশিং সুপারভাইজার লিটন মিয়া সাংবাদিকদের জানান, বহিরাগতদের বের করার নামে পুলিশ ভিতরে ঢুকে তোবার আন্দোলনকারী শ্রমিকদের ভয় দেখিয়ে কারখানা থেকে বের করে দেয়। এ সময় অনেক শ্রমিক পুলিশের ভয়ে বের হতে বাধ্য হয়। এদিকে গার্মেন্টের দ্বিতীয় তলায় জনতা ব্যাংক বাড্ডা শাখা হওয়ায় কর্মচারীদের ব্যাংকে ঢুকতে গিয়ে বিড়ম্বনায় পড়েন। ব্যাংকের এক কর্মকর্তা সাংবাদিকদের জানান, প্রথম একটু অসুবিধা হলেও পরে পুলিশ গেট খুলে ব্যাংকের কর্মচারীদের ভিতরে প্রবেশ করতে সহযোগিতা করেছে।
সূত্র আরও জানায়, বেলা ১২টার দিকে পুলিশ কারখানার তালা ভেঙে ফেলে। কিন্তু তারা কাউকে কারখানার ভিতরে ঢুকতে দেয়নি। এ সময় সাংবাদিকরা ঢুকতে চাইলে পুলিশ তাদেরকেও ঢুকতে দেয়নি। এদিকে বেলা একটার দিকে তোবা কারখানার সামনে জাতীয় গার্মেন্ট শ্রমিক জোট নেতা মাহতাব উদ্দিনের নেতৃত্বে অনশনবিরোধী একটি বিক্ষোভ মিছিল করা হয়। এ সময় ঘটনাস্থলে আসেন বাম মোর্চার সমন্বয়কারী জুনায়েদ সাকি। এ সময় তিনি কারখানার গেটে ঢোকার চেষ্টা করলে কর্তব্যরত পুলিশরা তাকে চারদিক থেকে ঘিরে ধরে। তিনি সাংবাদিকদের জানান, আমরা গার্মেন্ট নিয়ে কোন রাজনীতি করছি না। অসহায় শ্রমিকদের পক্ষে কথা বলছি। কথা শেষ হতে না হতেই পুলিশ তার ওপরে ব্যাপক লাঠিচার্জ করে। এর কিছুক্ষণ পরে টেক্সটাইল গার্মেন্ট ওয়ার্কার্স ফেডারেশন সাধারণ সম্পাদক সেলিম হোসেনের নেতৃত্বে অনশনবিরোধী অপর একটি বিক্ষোভ মিছিল থেকে বাম মোর্চার শ্রমিক নেতা মোস্তফা ও ইসরাফিলের ওপর হামলা করা হয়। সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের উত্তরে সাধারণ সম্পাদক সেলিম বলেন, শ্রমিকরা যাতে বিজিএমইএ’র টাকা না নেয় তার জন্য একটি চক্র উঠেপড়ে লেগেছে। কিন্তু আমাদের সংগঠন চায় সরকারের সঙ্গে শ্রমিকদের যে চুক্তি হয়েছে তারা সেই ভাবে বেতন-ভাতা গ্রহণ করুক। এ জন্য তারা শ্রমিকদের স্বার্থে কাজ করছেন। এ সময় তিনি বাম মোর্চা নেতাদের ওপরে হামলা করার কথা অস্বীকার করেন।
প্রত্যক্ষদর্শী শ্রমিক বেলাল আহম্মেদ জানান, বেলা আড়াইটার দিকে তোবা কারখানার সামনে পুলিশের অ্যাকশন শুরু হয়। এ সময় বাম মোর্চার নেতৃবৃন্দ এবং কারখানা অভ্যন্তরে অনশনকারী অসুস্থ শ্রমিকদের খাবার ও শরীরে পুশ করার স্যালাইন নিয়ে তোবা সংগ্রাম পরিষদের শ্রমিক নেতারা ভিতরে প্রবেশ করতে গেলে পুলিশ তাদের বাধা দেয়। সংগ্রাম কমিটির মেডিকেল টিম কো-অর্ডিনেটর আহম্মেদ মহিউদ্দিন সাংবাদিকদের জানান, পুলিশ তাদের মেডিকেল টিম ভেঙে দিয়েছে এবং জরুরি কাগজপত্র তছনছ করেছে। গুলশান থানার এসি নুরে আলম সাংবাদিকদের জানান, পুলিশ কোন লাঠিচার্জ করেনি। নিরাপত্তার কারণে সাংবাদিকসহ অন্য কাউকে তারা ভিতরে ঢুকতে দেয়নি। তোবা কারখানা এলাকার শ্রমিকদের নিরাপত্তার স্বার্থে পুলিশ শান্তিপূর্ণভাবে দায়িত্ব পালন করেছে। কারখানা এলাকার আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা করতে ঘটনাস্থলে পুলিশ সভা বা সমাবেশ করতে দেয়নি। তবে যারা জোর করে তা করতে চেয়েছিল হয়তো পুলিশ সদস্যরা তাদের বাধা দিয়েছে। কারখানার গেটে কে বা কারা তালা দিয়ে এ বিষয়ে পুলিশ অবগত নয়।
শনিবার ধর্মঘট, আজ-কাল বিক্ষোভ: একবারে তিন মাসের বকেয়া বেতন ও বোনাস দেয়ার দাবি আজকের মধ্যে না মানা হলে আগামী শনিবার দেশের সব গার্মেন্ট শিল্পাঞ্চলে ধর্মঘট পালন করা হবে। এছাড়া কাল বৃহস্পতিবার ও শুক্রবার সারা দেশে বিক্ষোভ সমাবেশ করা হবে। চলমান আমরণ অনশন অব্যাহত থাকবে। গতকাল এ বিক্ষোভের ডাক দিয়েছেন তোবা সংগ্রাম কমিটি পরিষদ। এ সময়ের মধ্যে তাদের দাবি মানা না হলে আগামী ৯ই জুলাই সারা দেশে অবরোধ কর্মসূচি পালন করবে বলে হুঁশিয়ারি দিয়েছেন তারা। গতকাল বাড্ডা হোসেন মার্কেটের সপ্তম তলায় অবস্থিত তোবা কারখানার অনশনরত শ্রমিকরা মাইকে এ ঘোষণা দেন শ্রমিক সংগ্রাম কমিটির সমন্বয়ক মোশারেফা মিশু। তিনি বলেন, সরকারের দালাল বাহিনী, বিজিএমইএ এবং পুলিশ তাদের আন্দোলন নস্যাৎ করতে শ্রমিকদের ওপরে নির্যাতন চালিয়েছে এবং তাদের শ্রমিক নেতা হাবিবসহ তিন নেতার মুক্তির দাবিতে সারা দেশে শ্রমিকরা ধর্মঘট পালন করবে। প্রয়োজনে পরে আরও কঠোর কর্মসূচি পালন করা হবে। তিন মাসের বকেয়া বেতন-ভাতা, ওভারটাইম এবং ঈদ বোনাসের দাবিতে গত ২৮শে জুলাই থেকে তোবা কারখানার পোশাক শ্রমিকরা আন্দোলন করছে। আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় গতকাল অনশনের দশম দিনে দফায় দফায় পুলিশের লাঠিচার্জ, ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া ঘটেছে বাড্ডার তোবা কারখানার সামনে। সংহতি প্রকাশ করতে এসে বাম মোর্চা নেতা জুনায়েদ সাকি, বাংলাদেশ গার্মেন্ট শ্রমিক মুক্তি আন্দোলন কমিটির সভাপতি শবনম হাফিজ, নৃ-বিজ্ঞানী শামীমা লুৎফা, গুলরক সহ তোবা সংগ্রাম কমিটির নেতৃবৃন্দ পুলিশের লাঠিচার্জের শিকার হয়েছেন।
আজও তোবা কর্মীদের বেতন দেবে বিজিএমইএ: গতকাল তোবা গ্রুপের শ্রমিকদের বকেয়া বেতন আংশিক পরিশোধ করছে বিজিএমইএ। বাকি বেতন আজও ৯টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত দেয়া হবে বলে জানিয়েছেন বিজিএমইএ’র সভাপতি আতিকুল ইসলাম। গতকাল বিজিএমইএ কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি এই ঘোষণা দেন। এছাড়া, গতকাল রাত ৯টা পর্যন্ত বেতন দেয়া হয়। তিনি বলেন, কোন কারখানা সঙ্কটে পড়লে তার বেতনাদি পরিশোধ করার দায়িত্ব বিজিএমইএ’র নয়। তিনি বলেন, তোবা গ্রুপের শ্রমিকদের নিয়ে একটি মহল শিল্পখাতকে অস্থির করার চেষ্টা করছে। শ্রমিকদের বেতন নিতে বিভিন্নভাবে বাধা দেয়া হচ্ছে। তারা বলছে, কারখানা থেকেই বেতন দিতে হবে। বিজিএমইএতে যাওয়ার প্রয়োজন নেই। যেখানে কাজ, সেখানেই বেতন। এভাবে অসহায় শ্রমিকদের আন্দোলনমুখী করা হচ্ছে। এ সময় রাজনীতির ঊর্ধ্বে পোশাক খাতকে স্থান দিতে সবার প্রতি আহ্বান জানান তিনি। আতিকুল ইসলাম বলেন, আমাদের কাছে একটি প্রশ্ন, বেতন-ভাতার দাবিতে আন্দোলন, নাকি কোন এজেন্ডা বাস্তবায়নের জন্য এ আন্দোলন চলছে? একটি গোষ্ঠী নিজেদের হীন স্বার্থ চরিতার্থ করার জন্য নিরীহ শ্রমিকদেরকে জিম্মি করে শিল্পখাতকে অশান্ত করার কাজ করে যাচ্ছে। তিনি বলেন, আমরা জেনেছি, কিছু বহিরাগত ব্যক্তি হোসেন মার্কেটে গিয়ে অবস্থানরত শ্রমিকদের কাছে গুজব তুলেছে যে, বকেয়া বেতন গ্রহণের জন্য বিজিএমইএ ভবনে যাওয়ার প্রয়োজন নাই। মালিক নিজে কারখানায় গিয়ে শ্রমিকদেরকে কারখানা থেকে বেতন দেবেন। শুধু তাই নয়, শ্রমিক ভাইবোনদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে ভীতি প্রদর্শন করা হয়েছে, যাতে করে তারা কোনভাবেই বকেয়া বেতন গ্রহণের জন্য বিজিএমইএ ভবনে না আসেন।