শনিবার , ২০শে এপ্রিল, ২০২৪ , ৭ই বৈশাখ, ১৪৩১ , ১০ই শাওয়াল, ১৪৪৫

হোম > সারাদেশ > ইতিহাস ঐতিহ্য ও শিল্পসমৃদ্ধে কালিয়াকৈর

ইতিহাস ঐতিহ্য ও শিল্পসমৃদ্ধে কালিয়াকৈর

শেয়ার করুন

আমিনুল ইসলাম ॥
গাজীপুর : গাজীপুর জেলার একটি উন্নয়নশীল, শিল্পসমৃদ্ধ, জনগুরুত্বপূর্ণ ও ঐতিহাসিক উপজেলার নাম কালিয়াকৈর প্রায় ৭০ বছর আগে এই কালিয়াকৈর সাভার থানার অন্তর্ভূক্ত ছিল। খ্রিস্টীয় অষ্টম শতাব্দীতে পাল রাজবংশের রাজধানী ছিল কালিয়াকৈর। রাজনৈতিক উত্থান-পতনের মধ্যদিয়ে সুবেদার ইসলাম খানের শাসন আমলে তিনি রাজত্ব পুনর্গঠনের প্রয়োজনে খাগি গালিব খানকে শাসনভার অর্পণ করেন। তাঁর নাম অনুসারে এ এলাকার নামকরণ করা হয় তালিমাবাদ পরগনা। বিংশ শতাব্দীর প্রারম্ভে খাগি বংশের উত্তরসূরি রহিম নওয়াব খান চৌধুরীর একান্ত প্রচেষ্টায় এ এলাকাকে পৃথক থানার মর্যাদা দিয়ে কালিয়াকৈর নামকরণ করা হয়।
বংশী, তুরাগ, ঘাটাখালী ও গোয়ালিয়া নদীর অববাহিকায় ঐতিহ্যবাহী ভাওয়াল গড়ের পশ্চিম অঞ্চলে পলি মিশ্রিত ও বনভূমি সমন্বয়ে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরপুর কালিয়াকৈর থানা। কালিয়াকৈর নামকরণের নির্ভরযোগ্য কোনো সূত্র ও প্রকৃত তথ্য জানা যায়নি। জনশ্রুতি আছে, প্রাচীনকালে কালিয়ানাগ নামে এক ধরনের বড় বড় সাপ বসবাস করতো গর্তে বা পুকুরে। কালের আবর্তে কালিয়ানাগ পরিবর্তন হয়ে কালিয়া এবং পুকুর বা গর্তের পরিবর্তন হয়ে কৈর হয়। পরে কালিয়া ও কৈর যোগ হয়ে কালিয়াকৈর হয়েছে।
অবস্থান ঃ এ থানা ২৪-৪ ডিগ্রি উত্তর অংশ এবং ৯০-১৪ ডিগ্রি পূর্ব দ্রাঘিমা অংশে অবস্থিত। থানার উত্তরে ময়মনসিংহ জেলা, পশ্চিমে টাঙ্গাইল, পূর্বে জয়দেবপুর ও দক্ষিণে সাভার থানা অবস্থিত। থানার মোট আয়তন ৩১৪.১৪ বর্গকিলোমিটার। ৭৭.৭২৪ একর জমির মধ্যে ১৯.৬৯৭ একর বনাঞ্চল। কালিয়াকৈর থানা ১৯৮১ সালে উপজেলায় উন্নীত হয়। ২০০১ সালে এখানে পৌরসভা গঠিত হয়, যা আজ প্রথম শ্রেণীর পৌরসভায় উন্নিত হয়েছে । এ থানায় ৯টি ইউনিয়ন, ১৮১ মৌজায় ২৮২টি গ্রাম রয়েছে। কালিয়াকৈর থানার ওপর দিয়ে ঢাকা-টাংগাইল মহাসড়ক ও একটি রেলপথ নির্মিত হয়েছে। থানার মোট পরিবারের সংখ্যা ৪৫ হাজার ৫৭৫। জনসংখ্যা ২,৫৫,০৪০ জন। পুরুষ ১,৩২,২৬০ জন ও মহিলা ১,২২,৭৮০ জন। উপজেলার শতকরা ২১ ভাগ মানুষ শিক্ষিত। ১৯৮১ সালের রিপোর্ট অনুযায়ী এ উপজেলায় ২,০১,২৬৫ জন মুসলমান ও ১৯,৫৯৫ জন হিন্দু ও ১০০০ জন অন্যান্য ধর্মাবলম্বী লোক বাস করে।
গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান সমুহ ঃ উপজেলায় ১টি টেলিফোন ও টেলিগ্রাফ অফিস, বিমান সিগনাল রিপিটার ও তালিমাবাদ ভূ-উপগ্রহ কেন্দ্র রয়েছে। থানার কৃতীসন্তান বিশ্বনন্দিত বৈজ্ঞানিক ড. মেঘনাদ সাহা, মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক, সাবেক মন্ত্রী ও রাষ্ট্রদূত শামসুল হক , দেশের প্রথম মহিলা পাইলট সৈয়দা কানিজ ফাতেমা রুকসানা। কালিয়াকৈর উপজেলার ঐতিহাসিক স্থানের মধ্যে ঢোল সমুদ্র দিঘি অন্যতম। এ ছাড়াও রয়েছে পাগল ধর্মের প্রবক্তা চিনাইল কেশবনাথ পাগলার আশ্রম, বক্তারপুরে ষাড়ের পুকুর, লোহকৈরে হযরত লোহা আলী ও বৈরাবরী দরবারের প্রতিষ্ঠাতাদের মাজার শরীফ। বাংলাদেশের প্রাচীনতম ঐতিহ্যবাহী বলিয়াদী ও শ্রীফতলী জমিদারবাড়ী। নন্দনপার্ক, আনসার ডিভিপি একাডেমি, মৌচাক জাতীয় স্কাউট প্রশিক্ষণ কেন্দ্র, চন্দ্রা, কাচিঘাটা দুটি ফরেষ্ট রেঞ্জ অফিস ও পাঁচটি বিট অফিস। কালিয়াকৈরের ধনীর চিরা-জগৎ বিখ্যাত
সম্ভাবনাময় পযর্টক স্থান সমুহ ঃ
রাজধানী ঢাকা থেকে মাত্র ৫০ কিলোমিটার দূরে। পাখিডাকা ছায়াঘেরা অপরূপ প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি কালিয়াকৈর। ঢাকার অদূরে গাজীপুর জেলা শহরের মাত্র ১৫ কিলোমিটার পশ্চিমে কালিয়াকৈর উপজেলা গঠিত।
একটি পৌরসভা ও নয়টি ইউনিয়নের প্রত্যেকটি অঞ্চলই যেন একেকটি সুন্দর, মনোরম ও মনোমুকর সম্ভাবনাময় পর্যটন এলাকা। এর প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ করতে দিনভর হেঁটে বেড়ালেও পর্যটকদের ক্লান্তি আসবে না।
নন্দন পার্ক-দক্ষিণ এশিয়ার সর্বাধুনিক পার্কটিও কালিয়াকৈর উপজেলায় নির্মিত হয়েছে। বাড়ইপাড়া বাসস্ট্যান্ডের কাছেই। যা নন্দন পার্ক নামে পরিচিত। প্রতিদিন এখানে হাজার হাজার দেশী-বিদেশী পর্যটক অবসর সময় কাটিয়ে যান। এটি একটি সর্বাধুনিক প্রযুক্তিনির্ভর আকর্ষণীয় বিনোদন কেন্দ্র।
নুরবাগ আম্রকানন ঃ নুরবাগ আম্রকানন একটি আকর্ষণীয় সেন্টার। এর শীতল ছায়া সব মানুষের হৃদয়ে ক্লান্তি দূর করে আনন্দের জোয়ার বয়ে আনে।
জাতীয় স্কাউট প্রশিক্ষণ কেন্দ্র ঃ মৌচাক বাসস্ট্যান্ড সংলগ্ন সারি সারি শালগাছের অপরূপ প্রাকৃতিক সৌন্দর্যবেষ্টিত সুবিশাল এলাকা। এটি একটি শুটিং ও পিকনিক স্পটও। এখানে প্রতি বছর বিশ্ব-জাম্বুরি অনুষ্ঠিত হয়।
এখানে সারাদেশের হাজার হাজার ছাত্র-শিক্ষক স্কাউটিংসহ বিভিন্ন কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ করেন। সম্প্রতি স্কাউটিং বিশ্বকে জানার জন্য এখানে স্থাপন করা হয়েছে একটি স্কাউট মিউজিয়াম।
আনসার একাডেমী ঃ সফিপুর আনসার ও ভিডিপি একাডেমি লেক ও বাগান শুটিং স্পট হিসেবে ব্যবহৃত হয়। এখানে প্রতিদিনই কোনো না কোনো নাটক বা ছবির শুটিং হয়ে থাকে।
চন্দ্রা ফরেস্ট রেস্ট হাউস ও চন্দ্রা পিকনিক স্পট পাশাপাশি। ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়ক সংলগ্ন চন্দ্রা বাসস্ট্যান্ড থেকে আধা কিলোমিটার আগে সারি সারি গজারি গাছের সুসজ্জিত এলাকা।
শিল্প ঃ সভ্যতার তীর আঁচড়ে জীবন দাবিত হলেও শাল বা গজারি বনের গহিনে হারিয়ে যাওয়ার যথেষ্ট সুযোগ রয়েছে। এসব অরণ্যে বিভিন্ন প্রজাতির পাখি ও বন্যপশু মাঝে মাঝে চোখে পড়ে। এ উপজেলাকে যদি পরিকল্পিতভাবে পর্যটন এলাকা হিসেবে তৈরি করা যায় তাহলে প্রতি বছর কোটি কোটি টাকা আয় করা সম্ভব।
ঢোল সমুদ্র ঃ কালিয়াকৈর উপজেলা সদর থেকে মাত্র ১৩ কিলোমিটার উত্তরে বোয়ালী ইউনিয়ন। ঢোল সমুদ্র গ্রামে রয়েছে অতি প্রাচীন বিশাল আয়তনের একটি দিঘি। তার নাম সোনাদিঘি। দিঘিটির রয়েছে অনেক ইতিহাস ও ঐতিহ্য। কবে বিশাল আয়তনের দিঘিটি খনন করা হয় সে সম্পর্কে নির্ভরযোগ্য কোনো তথ্য নেই। তবে জনশ্রুতি আছে, তৎকালে পাল বংশধর রাজা যশ পাল প্রায় ৫শ’ বছর আগে বিশাল আয়তনের এ দিঘিটি খনন করেন। দিঘিটি এতই গভীরভাবে খনন করা হয়েছিল যে, তার ওপর থেকে নিচের তলা দেখা যেত না। তলা না দেখা যাওয়ার ফলে একে তলাছাড়া পুকুর বলা হয়।
কিন্তু মজার ব্যাপার হলো, দিঘিটি এত গভীরভাবে খনন করা হলেও দিঘিতে বিন্দু পরিমাণ পানিও ওঠেনি। পানি না ওঠায় রাজা পড়ে গেলেন মহাবিপদে। এভাবে কিছুদিন চলে যাওয়াার পর হঠাৎ একদিন রাজা স্বপ্নে দেখলেন তার ছয় রানীর মধ্যে ছোট রানী যদি ঢাকঢোল বাজাতে বাজাতে দিঘিটির ওপর থেকে নিচের তলা পর্যন্ত যায় তাহলে দিঘিটিতে পানি উঠবে। রাজার কথা মতো ছোট রানী ঢাকঢোল বাজাতে বাজাতে দিঘির নিচের দিকে নামতে থাকে। এভাবে রানী যতই নিচের দিকে নামতে থাকে দিঘিতে তত বেশি পানি উঠতে লাগল। এতে ছোট রানী পানিতে তলিয়ে যান। তারপর থেকে ছোট রানীকে আর দেখা যায়নি। তিনি আর কোনোদিন ফিরে আসেনি। ঢোল বাজিয়ে পানি ওঠানো হয়েছে বলে দিঘিটার নাম দেয়া হয়েছিল ঢোল সমুদ্র।
এছাড়া কালামপুর শিল্পী কুঞ্জ, ওয়াটার ফ্রন্ট, আনন্দ পার্ক ও সোহাগ পল্লী পিকনিক স্পট। এছাড়া রয়েছে মৌচাক হোমস, ভান্নারা রেস্ট হাউস, আন্ধার মানিক এলাকায় রয়েছে জিয়া ফিল্ম সিটিসহ আরও অনেক পিকনিক স্পট।