শুক্রবার , ২৯শে মার্চ, ২০২৪ , ১৫ই চৈত্র, ১৪৩০ , ১৮ই রমজান, ১৪৪৫

হোম > Uncategorized > উপকূল থেকে উপকূল ॥ চোখের জলে লবণ চাষ!

উপকূল থেকে উপকূল ॥ চোখের জলে লবণ চাষ!

শেয়ার করুন

বাংলাভূমি২৪ ডেস্ক ॥ লোকসানে লবণচাষ। হাজারো চাষির জীবিকায় ধস। রয়েছে বিপুল সম্ভাবনা। তবুও অবহেলা। চাষিরা উৎসাহিত হচ্ছে না। অথচ লবণখাতের সম্ভাবনা জাগিয়ে তোলা যায় অনায়াসে। সম্ভাবনা বিকাশে বাধা পদে পদে। তৎপর সিন্ডিকেট চক্র। লবণের ন্যায্য দাম পাওয়ার ক্ষেত্রে বড় বাধা মধ্যস্বত্বভোগী। লুকোচুরি বড় ব্যবসায়ীদের। কারও প্রশ্ন, লবণখাত কী পাটখাতের মত ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে? এসব নিয়ে ‘চোখের জলে লবণ চাষ!’ শিরোনামে ধারাবাহিক প্রতিবেদনের প্রথমপর্ব প্রকাশ হলো সোমবার।

বদরখালী, চকরিয়া, কক্সবাজার: কক্সবাজার অঞ্চলে চোখের জলে লবণ চাষ করছেন হাজারো চাষি। মাথার ঘাম পায়ে ফেলে তপ্ত রোদে পুড়ে রাতদিন পরিশ্রমের পর কেজিপ্রতি লবণের দাম মিলছে মাত্র দেড় থেকে দুই টাকা। অথচ বাজারে লবণের কেজি ২০ থেকে ২৫ টাকা। একরপ্রতি ৬০০ মণ লবণ উৎপাদন হলে দাম পাওয়া যাচ্ছে সর্বোচ্চ ৪০ থেকে ৫০ হাজার টাকা। অথচ আবাদ খরচ একরপ্রতি প্রায় ৮০ হাজার টাকা।

এতটা ঘাটতি কীভাবে পোষাবে? লোকসান দিয়ে বাপদাদার পেশায় কীভাবে টিকে থাকবেন এই মানুষগুলো? কক্সবাজারের চকরিয়ার বদরখালী এলাকায় লবণ মাঠে সরেজমিন তথ্যসংগ্রহে গেলে এমন অনেক প্রশ্নের মুখোমুখি হয় বাংলানিউজ।

চাষিরা লবণের ন্যায্য মূল্য চান, লবণচাষে টিকে থাকতে চান। সেজন্যে মণপ্রতি অন্তত দেড় থেকে ২শ’ টাকার দাবি তাদের। তাহলে লোকসান আর ঘাটতি কাটিয়ে উঠে টিকে থাকতে পারবে।

চকরিয়া সদর থেকে প্রায় ১৮ কিলোমিটার দূরে বদরখালী ইউনিয়নের কেন্দ্রবিন্দু বদরখালী বাজারের আশপাশের গ্রামগুলোতে মাঠের পর মাঠ লবণ চোখে পড়ে।

ঝড়বৃষ্টি শুরু হওয়ার আগে চাষিরা দিনরাত কাজ করে আরও একটু বেশি লবণ উৎপাদনের চেষ্টা করছেন। আজমনগর পাড়ার মাঠের ভেতর দিয়ে হেঁটে গেলে রাস্তার দু’ধারে চোখে পড়ে শুধু স্তুপের পর স্তুপ লবণ।

তপ্ত রোদে লবণ মাঠের আইলে দাঁড়িয়ে মাঠের দিকে তাকিয়ে নি:শ্বাস ফেলতে ফেলতে বয়সী লবণ চাষি মোজাফফর আহমদ বলছিলেন, এখন তো আর সেদিন নেই। এক সময় খরচ ছিল কম, লবণের দামও পাওয়া যেত ভাল। এখন খচর বেড়েছে অস্বাভাবিক, মাঠে লবণ পড়ে থাকলেও কেউ কিনতে আসে না। মণপ্রতি ১০০ টাকা দাম পাওয়াই যেন ভাগ্যের ব্যাপার।

মোজাফফর জানালেন, লবণের দাম এবার অস্বাভাবিক পড়ে গেছে। মণপ্রতি ৭০-৮০ টাকার ওপরে উঠছে না। অথচ গত বছরও ১৬৫ থেকে ১৭০ টাকা দরে লবণ বেচাকেনা হয়েছে। যে পরিমাণ খরচ বেড়েছে, তাতে লবণের মণপ্রতি ২শ’ টাকা দাম পেলে চাষিরা লাভবান হতে পারে। মোজাফফর হোসেনের এই কথায় সায় দেন তার পাশে ভিড় করা আরও কয়েকজন চাষি।
ঝড়ষঃথ১
আজমনগর পাড়ার প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সামনের ছোট্ট দোকানে ভর দুপুরে বেশ কয়েকজন লবণ চাষির ভিড়। রোদে মাঠের কাজ ফেলে খানিক বিশ্রামের জন্য এসেছেন তারা।

এদেরই একজন আবু সৈয়দ। ছোটবেলা থেকে লবণ চাষেই জীবিকা নির্বাহ করছেন। তিনি মূল্যায়ন করলেন এভাবে, এ বছরের মত এতটা খারাপ অবস্থা লবণ চাষিদের আর কখনো যায়নি। লবণ চাষ করে এবার অধিকাংশ চাষি দেনায় জড়িয়ে পড়বে।

আলাপকালে বেশ কয়েকজন লবণ চাষি একসঙ্গে হিসেব কষে এক একর জমিতে লবণের উৎপাদন খরচ বের করলেন। তাদের হিসাবে মালিকের কাছ থেকে জমি বর্গা নিতে ছয় মাসের জন্য দিতে হয় প্রতি একরে ২৫ হাজার টাকা। একজন শ্রমিকের বেতন কমপক্ষে ৩৫ হাজার টাকা। পলিথিন কিনতে হয় প্রায় ১৫ হাজার টাকার। পানি সরানোসহ অন্যান্য আরও খরচ আছে প্রায় ৫ হাজার টাকা। এতে খরচ দাঁড়ায় ৮০ হাজার টাকা।

চকরিয়ার বেশ কয়েকটি গ্রামের লবণ মাঠ ঘুরে বাংলানিউজের চোখে পড়েছে চাষিদের ব্যস্ততা। কেউ পানি তুলছে, কেউবা পানি সরাচ্ছে। কেউবা মাঠ থেকে লবণ তুলে স্তুপ করছে। কোথাও বা দু’জন মিলে মাঠে বিছানো পলিথিনের দু’প্রান্ত ধরে জমে যাওয়া লবণ এক জায়গায় জড়ো করছেন।

মাঠে মাঠে এবার ব্যাপক লবণ উৎপাদনের দৃশ্য চোখে পড়লেও চাষিদের মুখ একেবারেই মলিন। কারণ এবার মাঠে ক্রেতার সংখ্যা খুবই কম। বিক্রি না হওয়ায় অনেককে লবণ মাঠের পাশে গর্ত করে লবণ মজুদ করতে দেখা গেছে।

সূত্র বলছে, নানা ধরণের প্রাকৃতিক দুর্যোগের ভেতর দিয়ে কখনো লাভ কখনো লোকসান গুণে উপকূলীয় অঞ্চলে প্রায় ৪৫ হাজার লবণ চাষি পরিবার এ পেশা ধরে রেখে জীবিকা নির্বাহ করছেন। জাতীয় চাহিদা পূরণে রাখছেন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। বিভিন্ন সময় এমন অনেক মৌসুম যাচ্ছে, বর্গা চাষিরা নিজেদের শ্রমের খরচটুকুও তুলে আনতে পারছেন না। প্রতিনিয়ত দুর্যোগের সঙ্গে লড়াই করে লবণ নির্ভর এসব প্রান্তিক চাষিরা সরকারি-বেসরকারি বিশেষ কোন সহায়তাও পান না।

বাংলাদেশ লবণ চাষি সমিতির সভাপতি অ্যাডভোকেট শহিদ উল্লাহ বাংলানিউজকে বলেন, দেশীয় লবণ শিল্প বাঁচাতে জাতীয় নীতিমালা-২০১১ অনুযায়ী সব ধরনের পদক্ষেপ নিতে হবে। নানা অযুহাত দেখিয়ে লবণ আমদানি বন্ধ করতে হবে। চাষিদের উৎসাহিত করতে তাদের দিতে হবে ন্যায্য মূল্য।

লবণ বোর্ড কিংবা সরকার থেকে মাঠ পর্যায়ে লবণের মূল্য নির্ধারণের দাবি জানিয়ে বাংলাদেশ লবণ চাষি সমিতির সাধারণ সম্পাদক মওলানা শহিদুল ইসলাম বলেন, লবণ চাষে চাষিদের সব ধরনের সহায়তা করতে হবে। চাষিদের লাভজনক পথ দেখাতে পারলেই দেশীয় লবণখাত এগিয়ে যাবে। বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম