বৃহস্পতিবার , ২৮শে মার্চ, ২০২৪ , ১৪ই চৈত্র, ১৪৩০ , ১৭ই রমজান, ১৪৪৫

হোম > গ্যালারীর খবর > এই লজ্জা আমরা রাখি কোথায়!

এই লজ্জা আমরা রাখি কোথায়!

শেয়ার করুন

বাংলাভূমি২৪ ডেস্ক ॥
তাহলে পুলিশই গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জে সাঁওতালদের ঘরে আগুন দিয়েছিল। একদল পুলিশ সাঁওতাল পল্লীর একটি ঘরের কাছে দাঁড়িয়ে আছে। তার অদূরে একজন পুলিশ সদস্য লাইটার জেলে সাঁওতালদের ঘরে আগুন লাগিয়ে দিচ্ছে, তার সঙ্গে আগুন লাগাচ্ছেন আরেক ব্যক্তি। দাঁড়িয়ে থাকা পুলিশ সদস্যদের মধ্যে আরেকজন মোবাইল ফোনে কথা বলছেন। এরপর একের পর এক ঘরগুলো পুড়ে যাচ্ছে, এমন একটি ফুটেজ ইউটিউব, আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় ভাইরাল হয়ে গেছে। পুলিশের পক্ষ থেকে সাঁওতালদের ঘরে আগুন লাগার অভিযোগ অস্বীকার করা হয়েছে।

সোমবার  গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জ উপজেলায় তাদের  ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা পরিদর্শন করতে যান মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান কাজী রিয়াজুল হক। এরপর মাদারপুরে গির্জার সাঁওতালদের সঙ্গে এক সমাবেশে তিনি বক্তব্য দেন। ওই সমাবেশেই তির, ধনুক, লাঠি হাতে আসেন সাঁওতালরা। সাঁওতালরা কতটা নিরাপদের অভাব বোধ করছে যে তারা নিরস্ত্র হয়ে আসতে ভয় পেয়েছে।

মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান কাজী রিয়াজুল হকের সামনে তির, ধনুক, লাঠিহাতে আসেন। কাজী রিয়াজুল হক সাঁওতালদের কাছে তির, ধনুক নিয়ে আসার কারণ জানতে চান। জবাবে সাঁওতালরা বলেন, নিজেদের নিরাপত্তার জন্য তাঁরা এভাবে এসেছেন। রিয়াজুল বিষয়টিকে নিজেদের জন্য লজ্জাজনক বলেন। তিনি বলেন, বিষয়টি সবার জন্য ‘লজ্জার’।

তাহলে এই লজ্জা আমরা কোথায় রাখব? মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান বলেন, এ দেশে সাঁওতালসহ বিভিন্ন ধর্মের মানুষ সবার সমান অধিকার আছে। এটা আমাদের সংবিধানের কথা। কারও ঘর উচ্ছেদ বা পুড়িয়ে দেওয়া যাবে না। এসব কাজে যারা জড়িত তাঁদের খুঁজে বের করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে হবে।

কে দেবে সেই দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি। কে খুঁজে বের করবে তাকে, যে সাঁওতালদের ঘরে পুলিশের পোশাক পরিধান করে আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য হিসেবে অসহায় মানুষকে রক্ষার পবিত্র দায়িত্ব পালন কালে এ অপকর্মটি করেছেন। আর তার পাশেই তার সহকর্মীরা তা দেখেছেন। দুষ্টের দমন ও শিষ্টের পালনে প্রশিক্ষণ ও শপথ নেয়ার পরই তারা তা করেছেন। রাজনৈতিক প্রভাবে করতে বাধ্য হয়েছেন। এমন এন্তার কথার ডালপালা অতীতের মত গজিয়ে সেমিনার থেকে সিম্পোজিয়াম হয়ে টেলিভিশনের টকশোতে উঠলেও উঠতে পারে। তার আগেও তা থেমে যেতে পারে। কেউ এসব বিষয় নিয়ে কথা বলার আগ্রহ বোধ করতে না পারেন। ঝুঁকি মনে করতেও পারেন। কিন্তু আন্তর্জাতিক মিডিয়া ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে যে বাংলাদেশের পুলিশ সাঁওতালদের ঘরে আগুন দিচ্ছে এমন ফুটেজ দেখবেন তাদের মনে কি প্রতিক্রিয়া হবে।

এই পুলিশ সদস্যদের জন্যে গর্ববোধ হয় যখন তারা জাতিসংঘে শান্তি মিশনে কাজ করেন। দেশের জন্যে মূল্যবান বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করেন। পরিবার ও স্বজনদের দেশে ফেলে বিদেশের মাটিতে কত কষ্ট করে দায়িত্ব পালন করেন। পুলিশ সদস্যদের উপকরণ, প্রশিক্ষণ সহ নানাবিধ জটিলতায় তারা দায়িত্ব পালন থেকে কখনো পিছপা হন না। কিন্তু তাই বলে সাঁওতালদের ঘরে আগুন দিতে দেখা যাবে পুলিশ সদস্যকে। আর পুলিশের পক্ষ থেকে তা অস্বীকার করলেই কেচ্ছা খতম হয়ে যাবে ?

সরেজমিনে দেখার পর সাঁওতালদের উদ্দেশে মানবাধিকার কমিশন চেয়ারম্যান বলেন, আজকে সরেজমিনে ঘটনা দেখে অনেক অন্যায় চোখে পড়েছে। সত্য ঘটনা উদ্ঘাটন করে তাঁরা তা সরকারের কাছে তুলে ধরবেন।

রংপুর চিনিকলের জমিতে আখ কাটাকে কেন্দ্র করে ৬ নভেম্বর গোবিন্দগঞ্জের সাহেবগঞ্জ এলাকার সাঁওতাল-অধ্যুষিত মাদারপুর ও জয়পুর গ্রামে পুলিশ ও চিনিকলের শ্রমিক-কর্মচারীদের সঙ্গে সাঁওতালদের সংঘর্ষ হয়। ওই ঘটনায় তিনজন সাঁওতাল নিহত হন।

সাঁওতালদের ছোড়া তীরে আহত হন ৯ পুলিশ। এরপর আইনশৃঙ্খলা বাহিনী অভিযান চালিয়ে ইক্ষু খামারের জমি থেকে সাঁওতালদের বসতি উচ্ছেদ করে। এ সময় তাদের বসত-ঘরগুলো আগুনে পুড়িয়ে দেওয়া হয়। পুলিশ সদস্যরাই এসব বসতিতে আগুন দিয়েছিল বলে প্রথম থেকেই অভিযোগ করছেন সাঁওতালরা।

ভাইরাল হয়ে যাওয়া ৩ মিনিট ৩১ সেকেন্ডের ভিডিও’র প্রথমে দেখা যাচ্ছে, পুলিশ সদস্যরা রাস্তা ধরে সাঁওতালদের বসতির দিকে এগিয়ে যাচ্ছেন। প্রথম ২০ সেকেন্ড পর দেখা যায় সাঁওতালদের বাড়ির সামনে গিয়ে কয়েকজন পুলিশ সদস্য কাঁদানে গ্যাস ও গুলি ছুড়ছেন। পোশাক পরিহিত পুলিশের পাশাপাশি সাদা পোশাকের পুলিশ সদস্যরাও সেখানে উপস্থিত ছিলেন। তাদের গায়ে বুলেট প্রুফ জ্যাকেট দেখা গেছে।

এ ভিডিওতে আরও দেখা যায়, সেখানে গিয়ে পুলিশ সদস্যরা সাঁওতালদের ঘরে লাথি মারতে থাকে। এসময় কয়েকজন পুলিশ সদস্য সাঁওতালদের কুঁড়েঘরের খড় হাত দিয়ে টেনে ছিড়তে থাকেন। ভিডিও’র ৩৫ সেকেন্ডের দিকে দেখা যায় এক পুলিশ সদস্য একটি কুঁড়েঘরের খড়ে লাইটার জ্বেলে আগুন লাগানোর চেষ্টা করছেন। কিন্তু, লাইটার দিয়ে আগুন লাগাতে পুরোপুর সফল না হওয়ায় তাকে সাহায্য করতে গোলাপী টি-শার্ট পরা আরেক ব্যক্তি এগিয়ে যান এবং  দেশলাই জ্বালিয়ে সাঁওতালদের ঘরে আগুন লাগিয়ে দেন। এরপরই দাউদাউ করে আগুন জ্বলে ওঠে ঘরে। পরে সিভিল পোশাক পরা একজন গিয়ে আগুনটি ভালোভাবে ধরেছে কিনা তার তদারকি করেন। এরপর মুহূর্তে পুরোঘরটিতে আগুন লেগে যায়। নৃশংস পুলিশ সদস্যরা এরপর সেখান থেকে আগুন নিয়ে সাঁওতালদের অন্যান্য ঘরেও আগুন লাগিয়ে দেন। ভিডিও ফুটেজের ১ মিনিট ২৭ সেকেন্ডের দিকে দেখা যায়, আগুন লাগানো ঘরগুলোর সামনে দিয়ে হাঁটছেন পুলিশ সদস্যরা। ১ মিনিট ৫৫ সেকেন্ডের দিকে দেখা যায়, অনেকগুলো ঘর আগুনে পুড়ছে, গবাদি পশুগুলো চিৎকার করে ছুটছে।

ভিডিওতে ২ মিনিট ৩০ সেকেন্ডের দিকে দেখা যায়, সাঁওতালদের বসতিতে আগুন লাগলেও তা নেভানোর চেষ্টা করছেন না কোনও পুলিশ সদস্য। তাদের সামনেই ঘরগুলো আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে যায়। ৩ মিনিট ২৮ সেকেন্ডের দিকে দেখা যায়, আগুনের দাউদাউ করে পুড়ছে অনেকগুলো ঘর।

সাঁওতালদের উচ্ছেদ অভিযান প্রসঙ্গে গোবিন্দগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) সুব্রত সরকার সাংবাদিকদের  বলেন, ‘গোবিগঞ্জের পরিস্থিতি এখন স্বাভাবিক। সেদিন থানা পুলিশ, জেলা পুলিশ, র‌্যাব সবাই ওই অভিযানে অংশ নিয়েছিল। আগুন নেভোনোর জন্য দমকল বাহিনীকে খবর দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু তারা আসার আগেই সব পুড়ে যায়।’

পুলিশ সদস্যরা আগুন দিয়েছে এমন অভিযোগ প্রসঙ্গে সুব্রত সরকার বলেন, ‘পুলিশ আগুন দিয়েছে- এর কোনও সত্যতা পাওয়া যায়নি।’

এ প্রসঙ্গে জাতীয় আদিবাসী পরিষদের সভাপতি রবীন্দ্রনাথ সরেন সাংবাদিকদের বলেন, ‘পুলিশ এ ঘটনার জন্য দায়ী। সাঁওতালদের পক্ষ থেকে মামলা হলেও পুলিশ কাউকেই আটক করেনি। বরং এলাকায় উত্তেজনা সৃষ্টি করছে। নিরীহ লোকজনকে ধরছে। অপরাধীদের ধরতে পুলিশের কোনও ভূমিকা নেই।’

হামলার পর থেকেই আশ্রয়হীন হয়ে পড়ে শত শত সাঁওতাল পরিবার। ওই পরিবারগুলোর কেউ কেউ খামারের পাশে সাঁওতাল পল্লী মাদারপুর গির্জার সামনের মাঠে কলাগাছের পাতা দিয়ে ছোট্ট ছোট্ট কুটুরি বানিয়ে, আবার কেউ কেউ ত্রাণে পাওয়া তাঁবু টানিয়ে কোনও রকমে ঠাঁই নিয়ে আছেন। অনেকে থাকছেন পরিত্যক্ত স্কুলঘরে খড় বিছিয়ে।

আইনমন্ত্রী আনিসুল হক সাংবাদিকদের বলেন, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগর ও গোবিন্দগঞ্জের ঘটনার সঙ্গে জড়িতদের বির“দ্ধে অবশ্যই আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এ রকম ঘটনায় যারা যুক্ত ছিলেন তাদেরকে অবশ্যই বিচারের আওতায় আনা হবে। তাদেরকে দৃষ্টান্তমূলক সাজা দিতে হবে। আমাদের সময়.কম