বৃহস্পতিবার , ১৮ই এপ্রিল, ২০২৪ , ৫ই বৈশাখ, ১৪৩১ , ৮ই শাওয়াল, ১৪৪৫

হোম > জাতীয় > একাত্তরে মায়ের গর্ভেই শুনেছে গোলাবারুদের শব্দ, এখনও প্রতিবন্ধী

একাত্তরে মায়ের গর্ভেই শুনেছে গোলাবারুদের শব্দ, এখনও প্রতিবন্ধী

শেয়ার করুন

স্টাফ রিপোর্টার ॥
১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় রায়েরবাজারে স্বামীর সঙ্গে দুই সন্তান নিয়ে বসবাস করতেন আমেনা খাতুন (৭৫)। মুক্তিযুদ্ধের শেষ দিকে ডিসেম্বরে রায়েরবাজারে বুদ্ধিজীবী হত্যাযজ্ঞে মেতে ওঠে হানাদার বাহিনী। বাড়ি থেকে শিক্ষক, সাংবাদিকসহ বুদ্ধিজীবীদের ধরে এনে হত্যা করে রায়েরবাজার ইটভাটায় ফেলে দিত তারা।

আজও আমেনার কানে ভাসে হানাদার বাহিনীর গোলাবারুদের বিকট শব্দ। ওই সময় আমেনা ছয় মাসের অন্তঃসত্ত্বা। হানাদার বাহিনীর গোলাবারুদ ও নিরীহ মানুষের আর্তনাদ শুনেছেন গর্ভে থাকা আমেনার সন্তানও। ১৯৭২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে স্বাধীন দেশে আমেনার কোলজুড়ে আসে তার ছোট ছেলে।

জন্মের পর মা ও ছেলে শারীরিকভাবে সুস্থ থাকলেও ক্রমেই মানসিকভাবে আরও অসুস্থ হয়ে পড়ে ছেলে। গত ২২ বছর ধরে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন তিনি। চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, জন্মগতভাবে মানসিকভাবে অসুস্থ আমেনার সন্তান। তার সুস্থ হওয়ার সম্ভাবনা খুবই ক্ষীণ।

আমেনার বাড়ি ছিল রায়েরবাজার ইটভাটার খুব কাছে। সেখানে এখন গড়ে উঠেছে ‘রায়েরবাজার বধ্যভূমি স্মৃতিসৌধ’। সন্তান গর্ভে নিয়ে অন্ধকার ঘর থেকে হানাদার বাহিনীর নির্যাতনের সেই দৃশ্য দেখেছেন নিজ চোখে। শুনেছেন মানুষের বাঁচার আকুতি-আর্তনাদ।

৭৫ বছর বয়সী আমেনা বলেন, ছেলেটা আমার আর ভালো হবে না। ডাক্তার জানিয়েছেন, গর্ভে থাকাবস্থায় ওর মাথায় গোলাবারুদসহ অস্বাভাবিক শব্দের প্রভাব পড়েছে। এ জন্য জন্ম থেকেই ও অসুস্থ।

২০ বছর আগে স্বামীকে হারিয়েছেন এ বৃদ্ধা। তিন ছেলে ও এক মেয়ের জননী আমেনা। তার গ্রামের বাড়ি চুয়াডাঙ্গায়। অষ্টম শ্রেণি পাস করার পর ঢাকায় বিয়ে হয় তার। স্বামী শামসুজজোহা ছিলেন একজন সরকারি কর্মকর্তা। রায়েরবাজারে স্বামীর নিজ বাড়িতে বসবাস করতেন তিনি।

আমেনা জানান, মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি সেনারা তার বাড়ির কিছুটা দূরে ক্যাম্প করে। বাড়ির সামনে দিয়ে অনেক মানুষকে ধরে নিয়ে যেতে দেখেছেন তিনি। তারা আর কোনো দিন ফিরে আসেনি। নিজের চোখে দেখা অভিজ্ঞতা নিয়ে লিখেছেন মুক্তিযুদ্ধবিষয়েক একাধিক গ্রন্থ।

স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে তিনি বলেন, ১৯৭১ সালের ডিসেম্বর মাসে আমি ছয় মাসের অন্তঃসত্ত্বা ছিলাম। এর আগে আমার দুই ছেলে সন্তানের জন্ম হয়। আমাদের বাড়ির সামনে রাস্তার পাশে একটি বড় বটগাছ ছিল। ১৪ ডিসেম্বর বিকেলে রাজাকার আলবদর সদস্যদের সহযোগিতায় সেই রাস্তা দিয়ে অসংখ্য মানুষকে ধরে নিয়ে যায় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী। ইটভাটার পাশে তাদের নির্যাতন করা হয়। বাঁচার জন্য মানুষের আর্তনাদ ও আকুতি শুনতে পেতাম। এক ব্যক্তিকে হত্যার করার আগে তিনি বারবার আল্লাহ-রাসুলের নাম নিচ্ছিলেন। বলছিলেন, তিনি শিক্ষকতা করেন। কোনো খারাপ কাজ করেননি। কিছু সময় পর একটি গুলির শব্দে সবকিছু নিস্তব্ধ হয়ে যায়।

আমেনা খাতুন বলেন, ১৪ ডিসেম্বর দুপুরে আমার স্বামীর পরিচিত একজন মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার আমাকে সাবধানে থাকতে বলেন। সবসময় বাড়ির লাইট বন্ধ করে ঘরের মধ্যে লুকিয়ে থাকতে পরামর্শ দেন। বাড়ির মধ্যে একটি পোষা কুকুর ছিল সেটিকে দূরে রেখে আসার কথাও বলেন। কুকুর ডাকলে সেই আওয়াজ শুনে রাজাকাররা বাড়ির মধ্যে প্রবেশ করতে পারে বলে সতর্ক করেন। পরে আমার দেবর বাছেদুজ্জামান কুকুরটি দূরে রেখে আসে।

সেই কালরাতের স্মৃতিচারণ করে তিনি আরও বলেন, রাতে ঘরের বেড়ার ফাঁক দিয়ে দেখি, কয়েকজন লোককে মেরে আমাদের বাড়ির পাশে ফেলে রাখা হয়েছে। এ দৃশ্য দেখার পর আমার ছোট দেবর আমাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেলে। পরদিন পাশের এক বিহারির বাসায় আমাদের পরিবারের সবাই গিয়ে আশ্রয় নেই।

আমেনা জানান, রায়েরবাজার বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধ ছিল একটি ইটভাটা। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর সদস্যরা বিভিন্ন এলাকা থেকে মানুষ ধরে এনে গুলি করে মেরে এখানে ফেলে রাখত। ৭৫ বছর বয়সেও সেই স্মৃতি তিনি এখনও ভুলতে পারেননি। প্রায়ই রায়েরবাজার বধ্যভূমিতে চুপচুপ বসে থাকেন আমেনা। সূত্র: জাগোনিউজ।