বাংলাভূমি ডেস্ক ॥
দেশে বিশেষায়িত ডিগ্রিধারীদের পেছনে সরকারের বড় ধরনের এ বিনিয়োগ করলেও সংশ্লিষ্ট পেশায় ধরে রাখা যাচ্ছে না তাদের। সামাজিক মর্যাদা, প্রতিপত্তি ও বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধার দিকে তাকিয়ে বিশেষায়িত শিক্ষায় শিক্ষিতরা পেশা বদলাচ্ছে। বিশেষায়িত এসব খাতে দক্ষ জনবলের সংকট রয়েছে। তাছাড়া বিশেষায়িত এসব শিক্ষায় শিক্ষার্থী প্রতি সরকারের ব্যয় ও ভর্তুকিও বেশি। বিশেষায়িত ডিগ্রি নিয়ে অন্য খাতে পেশা নির্বাচনের এ প্রবণতাকে সরকারি অর্থের অপচয় হিসেবে দেখছেন বিশেষজ্ঞরা।
সরকার যেই বিষয়ে অর্থ খরচ করে একজন মানুষকে দক্ষ ও শিক্ষিত করে তুলছে সেই ব্যাক্তি অন্য পেশায় চলে যাওয়ায় সংস্লিষ্ট ক্ষেত্রে যোগ্য লোক কমছে অন্যদিকে পছন্দের পেশাতেও ব্যাক্তি কাঙ্খিত দক্ষতা দেখাতে পারছেন না। কারণ তার দক্ষতা অন্য পেশায়।
বুয়েটের কম্পিউটার বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ কায়কোবাদ বলেন, একজন চিকিৎসক বা প্রকৌশলী তৈরিতে সরকারকে অনেক অর্থ বিনিয়োগ করতে হয়। এর উদ্দেশ্য, তারা দেশের মানুষকে স্বাস্থ্যসেবা দেবেন, টেকনিক্যাল সেবা দেবেন। একজন চিকিৎসক বা প্রকৌশলী চার-পাঁচ বছরের কষ্টার্জিত জ্ঞান শূন্য করে অন্য পেশায় চলে যাচ্ছেন। এটি দেশের জন্য বড় মাপের ক্ষতি।
পুলিশের পাশাপাশি জনপ্রশাসন বা কাস্টমসের মতো পেশায়ও চলে যাচ্ছেন বিশেষায়িত ডিগ্রিধারীরা। এর ফলে তাদের শিক্ষাজীবনের অর্জিত জ্ঞান কর্মক্ষেত্রে প্রয়োগের সুযোগ থাকছে না বলে মনে করেন ইউজিসি চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. আবদুল মান্নান। তিনি বলেন, বাংলাদেশে এখন প্রচুরসংখ্যক পেশাগত শিক্ষিত লোক অন্য পেশায় চলে যাচ্ছেন। এটা জনগণের প্রতি ও জনগণের অর্থের প্রতি এক ধরনের অবিচার। জনগণের অর্থে বিশেষায়িত জ্ঞান অর্জন করে অন্য পেশায় চলে যাওয়ায় জাতি তাদের সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। অন্যদিকে বিদেশী অনেক চিকিৎসক ও প্রকৌশলী আমাদের দেশে এসে কাজ করছেন। এতে প্রতি বছর বড় অংকের অর্থ দেশের বাইরে চলে যাচ্ছে।
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) প্রাক্তন শিক্ষার্থী মিশু বিশ্বাস। ২০১২ সালে নেভাল আর্কিটেকচার অ্যান্ড মেরিন ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে পড়াশোনা শেষ করে চিটাগং ড্রাই ডক লিমিটেডে সহকারী নেভাল স্থপতি হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন। পরে ২০১৪ সালে ৩৩তম বিসিএসের মাধ্যমে যোগ দেন পুলিশে। বর্তমানে গোয়েন্দা পুলিশের সহকারী কমিশনার হিসেবে কর্মরত আছেন।
ঢাকা মেডিকেল কলেজ থেকে এমবিবিএস ডিগ্রি অর্জন করেন সৈয়দ মামুন মোস্তফা। চিকিৎসক পেশায় না গিয়ে তিনিও এখন পুলিশ কর্মকর্তা। ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের সিনিয়র সহকারী কমিশনার হিসেবে কর্মরত তিনি।
পেশা বদলানোর কারণ হিসেবে দুইজনই বলেছেন জনগনকে প্রত্যক্ষ সেবা দানের সুযোগ বেশি থাকায় তারা পেশা বদলেছেন। তবে শিক্ষা সংস্লিষ্টরা বলছেন সামাজিক প্রতিপত্তির কারনেই তারা পেশা বদলাচ্ছেন।
কতটা ব্যয় হয় তাদের জন্য?
বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশনের (ইউজিসি) তথ্য অনুযায়ী বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষার্থীর জন্য সরকারের ব্যয় হয় বছরে গড়ে ২ লাখ ৫১ হাজার ৩১২ টাকা। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীপ্রতি এ ব্যয় আরো বেশি, ২ লাখ ৭৪ হাজার ৬১০ টাকা। এছাড়া শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষার্থীর পেছনে সরকারকে ব্যয় করতে হয় ১ লাখ ২১ হাজার ৪৪৫ এবং চট্টগ্রাম ভেটেরিনারি ও অ্যানিমেল সায়েন্সস বিশ্ববিদ্যালয়ে ১ লাখ ২৯ হাজার টাকা।
প্রকৌশল শিক্ষার্থীদের পেছনেও বড় অংকের অর্থ ব্যয় হয় সরকারের। বুয়েটের শিক্ষার্থীপ্রতি সরকারের এ ব্যয় ৯৬ হাজার ২০৪ টাকা। এর চেয়েও বেশি ব্যয় করতে হয় চিকিৎসাবিজ্ঞানের শিক্ষার্থীদের পেছনে, মাথাপিছু গড়ে ১ লাখ ৫৫ হাজার ২৮৬ টাকা।
যদিও এর বাইরে অন্যান্য শিক্ষায় সরকারের ব্যয় এর চেয়ে কম। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীপ্রতি সরকারের বার্ষিক ব্যয় গড়ে ৫৭ হাজার ৬০২ টাকা। এছাড়া চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে এ ব্যয় ৭৩ হাজার ১৫৬, জাহাঙ্গীরনগরে ৭৭ হাজার, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে ৫৮ হাজার ৯২২, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে ২৫ হাজার ৩৭৪ ও বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে ২৭ হাজার ৪৮৪ টাকা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীপ্রতি বার্ষিক ব্যয় এর চেয়ে কিছুটা বেশি হলেও তা ১ লাখ টাকার মধ্যে।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) উপাচার্য অধ্যাপক ডা. কামরুল হাসান বলেন, একজন চিকিৎসক তৈরিতে দেশের মানুষের অনেক বড় অবদান রয়েছে। দেশের সাধারণ মানুষের অর্থে আমরা পড়াশোনা শিখে চিকিৎসক হই। চিকিৎসা বিজ্ঞানে ডিগ্রি নিয়েও যদি কেউ এ পেশায় না থাকে তাহলে তার এ খাতে আসাই উচিত হয়নি। আমাদের একটি দায়বদ্ধতা থাকা উচিত। নিজেদের পেশার প্রতি আমাদের সম্মান করা উচিত।
তথ্য সুত্র : বনিক বার্তা