শুক্রবার , ১৯শে এপ্রিল, ২০২৪ , ৬ই বৈশাখ, ১৪৩১ , ৯ই শাওয়াল, ১৪৪৫

হোম > গ্যালারীর খবর > ক্ষমতায় থেকে নির্বাচনের প্রস্তুতি আওয়ামী লীগের

ক্ষমতায় থেকে নির্বাচনের প্রস্তুতি আওয়ামী লীগের

শেয়ার করুন

স্টাফ রিপোর্টার ॥ ক্ষমতায় থেকেই আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন করার পরিকল্পনা করছে আওয়ামী লীগ। এ লক্ষ্যে প্রয়োজনে সংবিধান সংশোধনের চিন্তাভাবনা করা হচ্ছে। নতুন সংশোধনীতে জাতীয় সংসদ বহাল রেখেই নির্বাচন দেয়ার বিধান রাখা হবে। তা ছাড়া সরকারের মেয়াদও নির্বাচন-পরবর্তী ছয় মাস রাখা হতে পারে। বর্তমান সংবিধানে নির্বাচনের তিন মাস আগে সংসদ ভেঙে দেয়ার যে বিধান রয়েছে তা পরিবর্তন করে নতুন বিধান সংযোজন করা হতে পারে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে পাঁচ সিটি করপোরেশন নির্বাচনে পরাজয়ের পর সরকারের নীতিনির্ধারকেরা এখন যেকোনো উপায়ে নির্বাচন দিলেই তাদের পরাজয় হবে বলে জানিয়েছেন। বিভিন্ন উপায়ে গোয়েন্দা সংস্থাগুলোও সরকারকে যে তথ্য জানিয়েছে তাতে সরকারের জনপ্রিয়তায় মারাত্মক ধসের চিত্র ফুটে উঠেছে। এ অবস্থায় সরকার আর কোনো কিছুতেই ঝুঁকি নেবে না। বিরোধী দলের কঠোর আন্দোলনের মুখেও তারা এ অবস্থান বজায় রাখবে। সরকারের নীতিনির্ধারকেরা মনে করছেন বিএনপিসহ তাদের মিত্ররা নির্বাচনে এলে সে নির্বাচন সরকারি দলের জন্য সুখকর নাও হতে পারে। এ জন্য বিরোধী দল যাতে নির্বাচনে আসার মতো পরিবেশ না পায় তেমন ব্যবস্থা নেয়া হবে।
অবশ্য সরকারের একটি মহল মনে করছে সিটি করপোরেশন নির্বাচনে বিএনপি আসবে না হিসাব করে তফসিল দেয়া হয়েছিল। কিন্তু শেষ মুহূর্তে তারা নির্বাচনে আসে এবং সরকারি দল পরাজিত হয়। জাতীয় নির্বাচনের ক্ষেত্রেও শেষ মুহূর্তে বিএনপি আসবে। কেননা বিএনপি নির্বাচনে এলে বিজয়ী হবে এমন ধারণায় নির্বাচন থেকে তারা দূরে থাকতে পারবে না। দলটির নেতাকর্মীরাও তাদেরকে নির্বাচনে আসার জন্য চাপ দেবে।
তবে বিএনপির একাধিক স্থায়ী কমিটির সদস্য আলাপকালে জানান, স্থানীয় সরকারের নির্বাচন আর জাতীয় নির্বাচন এক নয়। জাতীয় নির্বাচনে সরকার গঠনের প্রশ্ন থাকায় সেখানে খেলার জন্য মাঠে সবার সমান সুযোগ থাকা (লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড) খুবই বাঞ্ছনীয়। তা নাহলে সে নির্বাচনে জয়লাভ করা কঠিন। বাংলাদেশে কোনো সরকারই ক্ষমতায় থেকে নির্বাচন দিলে সেখানে বিরোধী দলের বিজয়ী হওয়ার রেকর্ড নেই। বিরোধী দল সে কারণেই দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনে না যাওয়ার ব্যাপারে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।
সরকারি দল সূত্রে জানা গেছে, নির্বাচনে বিএনপি না আসার বিষয়টি তাদের চিন্তায়ও আছে। সে ক্ষেত্রে তারা জাতীয় পার্টিসহ কয়েকটি ছোট বামপন্থী দলকে এগিয়ে এনে নির্বাচন সম্পন্ন করার চিন্তা মাথায় রাখছে। ক্ষমতাসীন জোটের মূল শরিক আওয়ামী লীগ বারবারই বলে আসছে, বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অধীনেই হবে দেশের আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন। দেশের সংবিধানে প্রায় দুই বছর আগে এমনই সংশোধনী আনা হয়েছে। সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতার কথা বলা হলেও প্রধান বিরোধী দল বিএনপিসহ দলটির নেতৃত্বাধীন ১৮ দলীয় জোট কোনোভাবেই আওয়ামী লীগের অধীনে নির্বাচন হতে দেয়া হবে না বলে ঘোষণা দিয়েছে। সরকারি মহল মনে করছে বিরোধী জোটের সাংগঠনিক দুর্বলতা রয়েছে। তারা বিগত দিনগুলোতে বড় কোনো কর্মসূচি দিতে পারেনি; যা সরকারকে বেকায়দায় ফেলতে পারে। এ দুর্বলতার সুযোগে তারা নিজেদের পছন্দমতো দলকে নিয়ে একটি নির্বাচন করে ফেলতে চাইছে।
সূত্র জানায়, এ ক্ষেত্রে বর্তমান সংবিধান অনুসারে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের অধীনে নির্বাচনে বিএনপি না এলে এককভাবে নির্বাচন করবে এরশাদের জাতীয় পার্টি। জাতীয় পার্টিকে ৭০-৭৫টি আসন ছেড়ে দেয়া হতে পারে। জাতীয় পার্টিকে তাদের বর্তমান ২৭টি আসনের সাথে বিএনপি জোটের ৩২টিসহ আরো কয়েকটি আসন ছেড়ে দেয়া হবে। দলটি হবে প্রধান বিরোধী দল। এ ছাড়া ক্ষমতাসীন জোটের ছোট শরিক দলগুলোকেও কিছু আসন ছেড়ে দেয়া হবে। পাশাপাশি নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধনের জন্য সদ্য আবেদনকারী দল বাংলাদেশ ন্যাশনালিস্ট ফ্রন্টকে (বিএনএফ) শক্তিশালী করা হবে। এ দলটিকে নিবন্ধন দিতে সরকার ইতোমধ্যে জোর প্রচেষ্টা চালাচ্ছে।
জামায়াতে ইসলামীর নিবন্ধন বাতিলের পর তা নিয়ে আইনি লড়াইয়ে কী হতে পারে তা-ও মাথায় রেখে এগোচ্ছে তারা। বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোটের অন্যতম শরিক দল বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীকে যুদ্ধাপরাধের মামলায় ইতোমধ্যে ঘায়েলের চেষ্টা করা হচ্ছে। নির্বাচনের আগে কয়েকটি মামলার রায় কার্যকর করার বিষয়ে ইতোমধ্যে ঘোষণা করা হয়েছে। সরকারের কয়েকজন মন্ত্রী ইতোমধ্যে এ আভাসও দিয়েছেন। পরিকল্পনা অনুসারে জামায়াতের সামনে দু’টি বিকল্প রাখা হবে। হয় তাদেরকে আওয়ামী লীগের অধীনে নির্বাচনে যেতে হবে, অন্যথায় নিষিদ্ধ হওয়ার ঝুঁকিতে পড়তে হবে। ইতোমধ্যে ট্রাইব্যুনাল থেকে আসা কয়েকটি রায়ে জামায়াতকে অপরাধী দল হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। দলটি নিষিদ্ধ করতে এ বিষয়টি কাজে লাগানো হতে পারে।
অতীতের কয়েকটি নির্বাচনের ফলাফল বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, ক্ষমতাসীনেরা সব সময় নির্বাচনে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে। দলীয় সরকারের অধীনে দেশের বিগত পাঁচটি নির্বাচনের ফলাফলও এমনই। জাতীয় নির্বাচন দলীয় সরকারের অধীনে করতে এ ক্ষেত্রে সিটি নির্বাচনকে ট্রাম্প কার্ড হিসেবে ব্যবহার করা হতে পারে। নির্বাচন কমিশন ইতোমধ্যে ঘোষণা দিয়েছে, তারা দলীয় সরকারের অধীনেও নির্বাচন করার জন্য প্রস্তুত। পাশাপাশি সর্বশেষ ডিসি সম্মেলনেও প্রধানমন্ত্রীসহ সরকারের কর্তাব্যক্তিরা দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের জন্য তাদের প্রস্তুতি নেয়ার পরামর্শ দেন।
তবে প্রধান বিরোধী দল বিএনপিকে বাদ দিয়ে নির্বাচন করা হলে তা শেষ পর্যন্ত গ্রহণযোগ্য হবে না বলেই মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা। তারা বলছেন, দেশের প্রধান বিরোধী দল বিএনপিকে বাদ দিয়ে নির্বাচন হলে পরিণাম ভালো হবে না। দীর্ঘ মেয়াদে দেশ এক অস্থিরতার দিকে চলে যাবে।
তবে সরকারি মহলের ধারণা, কোনো রকম একটা নির্বাচন করে শপথ নিতে পারলে আগের মতো আন্দোলন করে আওয়ামী লীগকে ক্ষমতা থেকে নামানো কঠিন হবে। কারণ এ ধরনের নির্বাচনকে গ্রহণযোগ্য করাতে সরকার ইতোমধ্যে আন্তর্জাতিক মহলে জোর লবিং চালিয়ে যাচ্ছে। এ ব্যাপারে উন্নয়ন সহযোগীদের নানা ধরনের প্রতিশ্রুতিও দেয়া হচ্ছে। তবে রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা বলছেন, আখেরে এমন নির্বাচন দেশের জন্য শুভ ফল বয়ে আনবে না।
বাংলাদেশ বার কাউন্সিলের ভাইস চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট খন্দকার মাহবুব হোসেন মনে করেন, সরকার যদি সংবিধানের দোহাই দিয়ে একতরফাভাবে দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন করার চেষ্টা চালায় তাহলে আন্তর্জাতিক জনমত সম্পূর্ণভাবে ওই নির্বাচনের বিপরীতে যাবে। বিরোধী দলকে ছাড়া নির্বাচন করা হলে, বিরোধী দল যদি বর্তমান জনমতকে সাথে নিয়ে গণ-আন্দোলনের ডাক দেয়, তবে সে আন্দোলনের মুখে সরকারের করুণ পরিণতি হবে। তাই আমি আশা করব সরকার একগুঁয়েমি পরিত্যাগ করে সব দলের অংশগ্রহণের মাধ্যমে একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন করবে। তিনি বলেন, সরকার সংবিধানের যে ধারাগুলোর দোহাই দিচ্ছে সেগুলো বর্তমান সরকারই ক্ষমতা চিরস্থায়ীভাবে থাকার জন্য করেছে। জনমতের বিরুদ্ধে গিয়ে সরকার কেবল সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে এসব সংশোধনী করেছে। এসব সংশোধনী কখনোই জনগণের কাছে গ্রহণযোগ্য হয়নি। তাই সংবিধানের দোহাই দিয়ে দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের চেষ্টা দেশকে সঙ্ঘাতময় পরিস্থিতির দিকে নিয়ে যাবে বলে আমি মনে করি।
বিশিষ্ট রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. পিয়াস করিম বলেছেন, কেবল সংবিধানের দোহাই দিয়ে প্রধান বিরোধী দলকে বাদ দিয়ে দেশে কোনো নির্বাচনের ফল হবে অগ্রহণযোগ্য। জাতিসঙ্ঘসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার কাছে নির্বাচন গ্রহণযোগ্য হওয়ার অন্যতম পূর্বশর্ত হলো সব দলের অংশগ্রহণের ভিত্তিতে নির্বাচন অনুষ্ঠান। তবে এ শর্ত কোনো দেশকে মানতেই হবে এমন বাধ্যবাধকতা নেই। কিন্তু বাংলাদেশে যদি বর্তমান ক্ষতাসীনেরা ক্ষমতায় থেকে এবং বিএনপিকে বাদ দিয়ে নির্বাচন করে তবে এর পরিণতি ১৯৯৬ সালের মতোই হবে। তা টেকসই হবে না। তিনি আরো বলেন, এমন ধরনের নির্বাচনের পরিণতি নির্ভর করবে মূলত প্রধান বিরোধী দল বিএনপি কতটা আন্দোলনমুখী হতে পারবে, অন্যান্য রাজনৈতিক দল ও সুশীলসমাজের ভূমিকা কী হবে, অসাংবিধানিক শক্তির ভূমিকা কী হবে এবং আন্তর্জাতিক চাপ আওয়ামী লীগ কতটা সামলাতে পারবে তার ওপর। এই চারটি বিষয় আওয়ামী লীগ কিভাবে সামলাবে তার ওপরই এমন ধরনের নির্বাচনের পরিণতি নির্ভর করবে। আমার মনে হয় শেষ পর্যন্ত আওয়ামী লীগ এই চারটি বিষয় সামাল দিয়ে টিকে থাকতে পারবে না।