শনিবার , ২০শে এপ্রিল, ২০২৪ , ৭ই বৈশাখ, ১৪৩১ , ১০ই শাওয়াল, ১৪৪৫

হোম > শীর্ষ খবর > গাজীপুর সিটি নির্বাচন > মেয়র পদে আ’লীগ-বিএনপি প্রার্থী জয়-পরাজয়ের নেপথ্যে

গাজীপুর সিটি নির্বাচন > মেয়র পদে আ’লীগ-বিএনপি প্রার্থী জয়-পরাজয়ের নেপথ্যে

শেয়ার করুন

স্টাফ রিপোর্টার ॥
গাজীপুর: গত মঙ্গলবার অনুষ্ঠিত হয়ে গেল বহু প্রতিক্ষিত গাজীপুর সিটি কর্পোরেশনের দ্বিতীয়বারের নির্বাচন। এ নির্বাচন নিয়ে দেশবাসীর যেমন ছিল ঔৎসক্য দৃষ্টি তেমনি ছিল ব্যাপক অলোচনা-পর্যালোচনা। নির্বাচনের ফলাফল কি হয় সেটা নিয়েও ছিল প্রবল জল্পনা-কল্পনা। নির্বাচনে আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী মোঃ জাহাঙ্গীর আলম বিপুল ভোটে মেয়র নির্বাচিত হয়েছেন। তিনি তার প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপির মনোনীত প্রার্থী হাসান উদ্দিন সরকারকে ২ লক্ষাধিক ভোটের ব্যবধানে পরাজিত করেছেন। সিটি কর্পোরেশনের ৪২৫টি কেন্দ্রের মধ্যে ৪১৬টি কেন্দ্রের ফলাফলে জাহাঙ্গীর আলমের প্রাপ্ত ভোটের সংখ্যা ৪ লক্ষ ১০টি। অপরদিকে হাসান উদ্দিন সরকার পেয়েছেন ১ লক্ষ ৯৭ হাজার ৬১১টি ভোট। নির্বাচনে উভয়ই ছিলেন শক্তিশালী প্রার্থী। প্রথম দিকে কার জয় কার পরাজয় এ নিয়ে দ্বিধাদ্বন্দ্ব থকলেও নির্বাচনের আগ মুহূর্তে জাহাঙ্গীর আলমের জয়ের ব্যাপারটাই অনেকের আলোচনায় চলে আসে। এ ব্যাপারে জাহাঙ্গীর আলম নিজেও ছিলেন যথেষ্ট আশাবাদী। কিন্তু এত বিশাল ভোটের ব্যবধানে তিনি জয়ী হবেন এটা অনেকের ধারণার বাইরে ছিল। নির্বাচনের পর রাজনৈতিক বিশ্লেষকগণ পর্যালোচনা করছেন জাহাঙ্গীর আলমের জয়ের নেপথ্যে আর হাসান উদ্দিন সরকারের পরাজয়ের নেপথ্যে কি কি ফ্যাক্টর কাজ করেছে।
নানান ঘাত-অভিঘাত পেরিয়ে গাজীপুরের আওয়ামী রাজনীতিতে বিশেষ স্থান দখল করা তারুণ্যের প্রতীক জাহাঙ্গীর আলম নিজের প্রচেষ্টায় নিজেকে অনেকের চেয়ে যোগ্য এবং গ্রহণযোগ্য এমন অবস্থান সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছেন। হাইব্রিড নেতাদের মতো নয়- তিনি ধাপে ধাপে ব্যাপক রাজনৈতিক কর্মকান্ডের মধ্য দিয়ে বর্তমান অবস্থানে ওঠে এসেছেন। এ জন্য ছিল তার স্বল্প ও দীর্ঘ মেয়াদী নানান পরিকল্পনা। মানুষের মন জয় করার জন্য তিনি প্রচুর জনকল্যাণমুখী কাজ করেছেন যা এখনও অব্যাহত আছে। নগরীর এমন কোন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বা ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান নেই যেখানে তার অনুদানের ছোঁয়া পড়েনি। তাছাড়া বিভিন্ন সামাজিক-সাং¯ৃ‹তিক কর্মকান্ডেও তার অনুদানের হাত ছিল প্রসারিত। ‘জাহাঙ্গীর আলম শিক্ষা ফাউন্ডেশন’ গঠন করে এর মাধ্যমে ছাত্র-ছাত্রীদের বৃত্তি ও অনুদানসহ বিভিন্ন সহযোগিতা করে তিনি ব্যাপক প্রশংসা অর্জন করেছেন। সমাজসেবামূলক কর্মকান্ডে তিনি যে ভূমিকা পালন করেছেন তাও প্রশংসিত হচ্ছে। উচ্চ থেকে উচ্চতর আসনে যেতে হলে যে শোভন ভূমিকা পালন করতে হয় তাও তিনি করেছেন। তার ব্যবহারেও ছিল অমায়িক ভাব ও শোভন আচরণ। এতে তিনি একটা ‘বিশেষ’ ব্যক্তি ইমেজ তৈরী করতে সক্ষম হন।
পাশাপাশি তিনি ভোটারদের কাছে নিজেকে একটি ‘ভরসা স্থল’ হিসাবেও গড়ে তুলতে সক্ষম হন। নির্বাচনী প্রচারণায় তিনি অনেক বড় বড় প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন- কিছু প্রতিশ্রুতি ‘অসাধ্য’ মনে হলেও জাহাঙ্গীর আলমই সক্ষম হবেন এমনটা মনে করে ভোটাররা তার উপর আস্থা স্থাপন করেছেন। গাজীপুরের জনদুর্ভোগ অনেক, সীমাহীন কষ্টের মধ্যে নগরবাসীদের দিন কাটাতে হচ্ছে। অতিষ্ঠ নগরবাসী এগুলো থেকে মুক্তি চায়। বিশেষ করে যানজট, জলাবদ্ধতা, আবর্জনার স্তুপ, পরিবেশ দূষণ, ভাঙ্গাচুরা রাস্তাঘাট- এসব দুর্ভোগের অবসান কামনা করে নগরবাসী। কিন্তু এমন দুর্ভোগ ও কষ্ট কে লাঘব করবে? সরকারের সহায়তা বা অনুদান ছাড়া এসব করা সম্ভব নয়। তাহলে কার উপর ভরসা করা যায়? নি:সন্দেহে তিনি জাহাঙ্গীর আলম। এসব ছাড়াও নগরীর সার্বিক উন্নয়নে জাহাঙ্গীর আলমই হতে পারেন কান্ডারী- এমন মনোভাব থেকেই ভোটাররা জাহাঙ্গীর আলমকে সমর্থন দিয়েছেন এমন অভিমত রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের। তাছাড়া রয়েছে নৌকা প্রতীক। যারা নৌকাকে মনপ্রাণ দিয়ে ভালোবাসেন তাদের ভোট জাহাঙ্গীরের বাক্স ছাড়া আর কার বাক্সে যাবে? আরেকটি লক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে এবারের নির্বাচনী প্রচারণায় নানান কৌশল অবলম্বন করে জাহাঙ্গীর সর্বশক্তি নিয়োগ করেছিলেন। নেতা-কর্মীদের তিনি এক করতে পেরেছিলেন। আর দলে যে গ্রুপিং বা বিভেদ ছিল তাও এবার অনেকাংশে অবসান করতে সক্ষম হয়েছিলেন তিনি। স্থানীয় নেতাদের মতো আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতাদের নির্বাচনী প্রচারণায় অংশগ্রহণও ইতিবাচক ভূমিকা পালন করেছে। অন্য আরো কারণের সঙ্গে এসব কারণ জাহাঙ্গীর আলমের নির্বাচনে জয়লাভ প্রভাবক ভূমিকা পালন করেছে বলে রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের অভিমত।
অপরদিকে বিএনপি মনোনীত মেয়র প্রার্থী হাসান উদ্দিন সরকারও শক্তিশালী প্রার্থী। দীর্ঘদিনের ক্যারিয়ার রয়েছে তাঁর। মুক্তিযোদ্ধা হাসান উদ্দিন সরকার ছাত্র নেতৃত্ব দেয়াসহ শ্রমিক রাজনৈতিতেও তিনি জড়িত। পৌরসভার চেয়ারম্যান, এমপি ও জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান হিসাবেও তিনি দায়িত্ব পালন করেছেন। অভিজ্ঞতা ও দক্ষতা পুঁজি করেই এবার মেয়র পদের নির্বাচনে তিনি অবতীর্ণ হয়েছিলেন। কিন্তু বয়সের ভার বহন করতে তিনি অক্ষম।
এ কারণে তার ক্যারিয়ার, অভিজ্ঞতা ও দক্ষতা কাজে লাগবে বলে যা মনে হয়েছিল তা কাজে লাগেনি। প্রতিপক্ষ তরুণ প্রার্থীর বিপরীতে প্রবীণ ও রাজনৈতিতে বিচক্ষণ হাসানউদ্দিন সরকার হয়তো তার প্রতি ভোটারদের সহানুভূতি থাকলেও সে তুলনায় তিনি তদের সমর্থন আদায় করতে পারেননি। অর্থাৎ ভোটাররা প্রবীণ নয় নবীনকেই প্রাধান্য দিয়েছে। গাজীপুরের ভোটাররা চেয়েছেন দীর্ঘদিনের জমে থাকা সমস্যা ও কষ্টের লাঘব। গাজীপুর সিটি কর্পোরেশনের তেমন কোন উন্নয়ন হয়নি। বরং সমস্যা দিনদিন আরো প্রকট হয়ে সেগুলো এখন অসহনীয় পর্যায়ে পৌঁছেছে। এ দুবির্ষই অবস্থা থেকে নগরবাসী যে কোন মূল্যেই হোক পরিত্রাণ চায়। এব্যাপারে সক্ষমতার দিক দিয়ে ভোটাররা পছন্দের প্রার্থী হিসাবে জাহাঙ্গীর আলমকেই বেছে নিয়েছে। বিরোধী দল থেকে নির্বাচিত হলে সিটির কাঙ্খিত উন্নয়ন হবে না এমন চিন্তা-চেতনাও হয়তো কাজ করেছে ভোটারদের মনে। বিভিন্ন কারণে হাসানউদ্দিন সরকারও প্রচার-প্রচারণায় প্রতিপক্ষের তুলনায় ছিলেন পিছিয়ে। তার হয়ে দলের কেন্দ্রীয় নেতাদের সাথে স্থানীয় নেতারা প্রচারণায় অংশ নিলেও সেগুলো ছিল আওয়ামী লীগ প্রার্থীর চেয়ে কম। এছাড়া জাহাঙ্গীর আলম শিল্প-কারখানায় কর্মরত শ্রমিদের ব্যাপারে যতটা সোচ্চার ছিলেন হাসান সরকার ততটা ছিলেন না। তাই প্রবীণ ও বিচক্ষণ রাজনীতিবিদ হওয়া সত্ত্বেও নির্বাচনের জয়ের দৌড়ে তিনি পিছিয়ে ছিলেন। তার পরাজয়ের নেপথ্যে এসবই নিয়ামক হিসাবে কাজ করেছে বলে মনে করছেন রাজনৈতিক পর্যবেক্ষরা।