শুক্রবার , ১৯শে এপ্রিল, ২০২৪ , ৬ই বৈশাখ, ১৪৩১ , ৯ই শাওয়াল, ১৪৪৫

হোম > গ্যালারীর খবর > গার্মেন্ট শিল্প লোকসানে বিপর্যস্ত

গার্মেন্ট শিল্প লোকসানে বিপর্যস্ত

শেয়ার করুন

বাংলাভূমি২৪ ডেস্ক ॥ নারায়ণগঞ্জ ফতুল্লা বিসিক অঞ্চলের তৈরি পোশাক শিল্প ‘এমবি নিটওয়্যার’ নভেম্বরে নির্দিষ্ট সময়ে পোশাক ডেলিভারি দিতে ব্যর্থ হলে স্পেনের ক্রেতা ১ লাখ ৫৪ হাজার মার্কিন ডলার ও ৩০ হাজার ডলারের পৃথক দুটি অর্ডার এবং অস্ট্রেলিয়ার ক্রেতা ৯৬ হাজার ডলারের আরও একটি অর্ডার বাতিল করে। ওই কোম্পানি যথাসময়ে পণ্য সরবরাহ করতে না পারায় ক্রেতাকে ৫৪ হাজার ডলার ডিসকাউন্ট (ছাড়) দিয়েছে। শুধু তাই নয়, ক্রেতা মন রক্ষা করতে গিয়ে প্রতিষ্ঠানটি সাড়ে ৪ লাখ ডলারের মূল্যের ২৪ হাজার কেজি পোশাক বিমানে পাঠিয়েছেন। এতে বিমান ভাড়া বাড়তি গুনতে হয়েছে ৭৬ হাজার ডলার, যা পুরোটাই লোকসান হিসাবে যোগ হয়েছে।

বিগত তিন মাসের রাজনৈতিক চরম সহিংসতা, অবরোধ, হরতাল ও অস্থিতিশীলতার কারণে পোশাক শিল্পের একটি প্রতিষ্ঠানকে এ লোকসান গুনতে হয়েছে। রাজনৈতিক এ অস্থিতিশীলতার শিকার এ শিল্পের সাড়ে তিন হাজার প্রতিষ্ঠান। তারা এখন লোকসান ঝুঁকির দুশ্চিন্তায় ভুগছে।

তৈরি পোশাক শিল্পের মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ গার্মেন্ট ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিজিএমইএ) সর্বশেষ হিসাবে গত তিন মাসে ৮১ দিনের অবরোধ ও হরতালের কারণে ১৬ হাজার ২০০ কোটি টাকার উৎপাদন পর্যায়ে ক্ষতি হয়েছে (১ দিনে উৎপাদন ক্ষতি ২০০ কোটি টাকা), নির্ধারিত সময়ে পণ্য ডেলিভারি দিতে ব্যর্থতার কারণে এ পর্যন্ত ক্রেতাদের ৫ হাজার কোটি টাকার ডিসকাউন্ট দেয়া হয়, ক্রেতাদের মন রক্ষা করতে ৭ হাজার কোটি টাকার পণ্য বিমানের মাধ্যমে রফতানি করতে হয়েছে। এই টাকা দেশে থাকার কথা। কিন্তু পুরোটাই চলে গেছে বিদেশী বিমান ও ক্রেতার পিছনে। গত ১২ জানুয়ারি নতুন সরকারের যাত্রা শুরু হয়েছে। অর্থনীতি সতেজ করে তাকে গতিময় করাটা নতুন সরকারের প্রধান চ্যালেঞ্জ। রাজনৈতিক থাবায় অর্থনীতি, ব্যবসা-বাণিজ্য, শিল্প উদ্যোক্তাদের কি পরিমাণ ক্ষতি হয়েছে, এই ক্ষতি উত্তরণে, অর্থনীতির গতি পুনরুদ্ধারে সরকারের কি পরিকল্পনা, কি ধরনের পদক্ষেপ নিচ্ছে উদ্যোক্তারা, দীর্ঘ মেয়াদে এই ক্ষতির প্রভাব কি দাঁড়াতে পারে, ধারাবাহিক চার পর্বে তা তুলে ধরছে যুগান্তর। আজ প্রথম পর্ব। বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ জানান, ব্যবসায়ীদের ক্ষতি শনাক্ত করা, বিদেশে ব্যবসা-বাণিজ্যের ইমেজ ফিরিয়ে আনতে শীর্ষ ব্যবসায়ীদের নিয়ে একটি উপদেষ্টা কমিটি গঠন করা হবে। ওই কমিটির মাধ্যমে এসব সমস্যার সমাধান করার উদ্যোগ নেয়া হবে। রাজনৈতিক সহিংসতা অনেকটা থেমে আসছে। কিন্তু শুকায়নি এই সহিংসতার ক্ষত। ক্ষত হয়েছে শীর্ষ রফতানি আয়ের খাত পোশাক শিল্প, ক্ষত হয়েছে শিল্প উদ্যোক্তাবৃন্দ, ক্ষত হয়েছে বিনিয়োগ ও অভ্যন্তরীণ বাণিজ্য। এসব ক্ষতের নেতিবাচক প্রভাব ক্রমশ দীর্ঘ হচ্ছে।

বিশ্বব্যাংকের ‘গ্লোবাল ইকোনমিক প্রসপেক্টাস’ শীর্ষক প্রতিবেদনে গত ১৫ জানুয়ারি সংস্থাটি বলছে, পোশাক খাতের বিরাজমান নিরাপত্তা সমস্যার সঙ্গে চলমান সামাজিক অস্থিরতা যোগ হয়ে বাংলাদেশের শিল্প ও রফতানি সক্ষমতায় নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে বলে হুশিয়ার করা হয়েছে। সংস্থাটি বলছে, নির্বাচনকেন্দ্রিক রাজনৈতিক অস্থিরতা ব্যবসায়ীদের আস্থা ও বিনিয়োগের স্থিতিশীলতা অর্জনের ক্ষেত্রে ক্ষতির কারণ হতে পারে।

২৪১৪ কোটি মার্কিন ডলার আয়ের শীর্ষ রফতানি খাত পোশাক শিল্প সবচেয়ে বেশি বিপর্যয়ের মুখে পড়েছে। ডিসেম্বর থেকে এই শিল্পের ৩৫ লাখ র্কর্মীর জন্য নয়া বেতন কাঠামো বাস্তবায়নের কথা থাকলেও এতে অনেকটা অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে। রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতায় ৩০০ বায়িং হাউসে কমপক্ষে ১৬ থেকে ২০ শতাংশ বাণিজ্য কমেছে। এমন তথ্য দিয়েছে বায়িং অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ। এমবি নিটওয়্যার গার্মেন্টের মালিক মোহাম্মদ হাতেম জানান, তিনি শ্রমিকদের প্রতিমাসের বেতন ৭ থেকে ৮ তারিখের মধ্যে দিয়ে থাকেন। বর্তমান ফ্যাক্টরিতে ৭শ’ শ্রমিক রয়েছে। কিন্তু ২ লাখ ৬১ হাজার মার্কিন ডলারের অর্ডার বাতিলের কারণে এখন বেতন দেয়াটা তার পক্ষে কঠিন হয়ে পড়েছে। তিনি বলেন বেতনের জন্য ব্যাংকে ঋণ চেয়েও পাচ্ছি না। বায়ার গ্রুপ অক্টোবর থেকে বাড়িয়ে নভেম্বর পর্যন্ত সময় দিয়েছিল। বন্দর থেকে কাঁচামাল আনতে না পারায় সময় অনুযায়ী পণ্য শিপমেন্ট করতে পারিনি। শেষ পর্যন্ত আমার তিনটি অর্ডার বাতিল হয়। এ ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে হিমশিম খেতে হচ্ছে।

এদিকে বারিধারা ‘ফরেন বায়িং হাউসের’ পক্ষ থেকে জানা গেছে, আগামী মৌসুমের অর্ডার দিতে জার্মানি ও নেদারল্যান্ডসের বায়ার গ্রুপকে তারা নিয়ে আসে। গ্রুপের তিন জন ক্রেতা গত ২১ ডিসেম্বর এসে ২৮ ডিসেম্বর ঢাকা ত্যাগ করার কথা ছিল। কিন্তু টানা অবরোধের কারণে এই তিন ক্রেতা বের হয়ে কোথাও যেতে পারেননি। তাদের জীবন বীমাও ছিল না। অনাকাক্সিক্ষত এ পরিস্থিতিতে পড়ে নির্ধারিত সময়ের ৪ দিন আগে অর্থাৎ ২৪ ডিসেম্বর বাংলাদেশ থেকে চলে যায় ওই তিন ক্রেতা। ইউকে এবং ইউএসএর বায়ার প্রতিষ্ঠান ‘ফুটলকার’ হরতাল ও অবরোধের কারণে বাংলাদেশ থেকে ৬ লাখ গার্মেন্ট পোশাকের অর্ডার বাতিল করেছে। ওই বায়ার এখন পাকিস্তানের দিকে ঝুঁকছে। প্রতি বছর এ বায়ারটি ২০ থেকে ২২ লাখ পিস পোশাকের অর্ডার দিলেও এ বছর ৩০ শতাংশ অর্ডার কম দিয়েছে। ‘টোটাল অ্যাপারেলস’ নামক বায়িং হাউস থেকে জানানো হয়, তারা স্পেনের ‘লিইউ’ এবং আমেরিকার ‘বিবি ক্লোথিং’ নামক ক্রেতা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে কাজ করছেন। কিন্তু এ বছর লিইউ ৫০ হাজার ডলারের অর্ডার সরিয়ে নিয়ে পাকিস্তান চলে গেছে। একইভাবে বিবি ক্লথিং বাংলাদেশ থেকে ৫০ ভাগ অর্ডার স্থানান্তর করেছে।

বিজিএমইএ সভাপতি আতিকুল ইসলাম জানান, শিল্পের নিরাপত্তা, ব্যবসা করার পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে ও সরবরাহ ঠিক রাখতে চট্টগ্রাম ও মংলাবন্দর ঠিক রাখতে হবে। তিনি আরও বলেন, এ পরিস্থিতি উত্তরণে ব্যাংক সুদের হার হ্রাস, নগদ সহায়তা প্রদান করারও দাবি জানান তিনি।

বায়িং হাউসগুলো এখন বিদেশী ক্রেতা আনতে হিমশিম খাচ্ছে। এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ গার্মেন্ট বায়িং অ্যাসোসিয়েশনের প্রেসিডেন্ট কেআই হোসাইন বাবুল যুগান্তরকে জানান, গার্মেন্ট বাণিজ্যের ৬০ শতাংশ নিয়ন্ত্রণ করছে বায়িং হাউসগুলো। কমপক্ষে ৩০০ প্রতিষ্ঠান রয়েছে। কিন্তু রাজনৈতিক পরিস্থিতির কারণে ৩০ শতাংশ ব্যবসা কমেছে। অর্ডার অন্যত্র স্থানান্তর হয়েছে ১৬ থেকে ২০ শতাংশ। বিশেষ করে ভিয়েতনাম, কম্বোডিয়া, মিয়ানমার ও পাকিস্তানে অর্ডার চলে যাচ্ছে।

তৈরি পোশাক শিল্পের ক্ষতিপূরণে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত এ শিল্পের উদ্যোক্তাদের আশ্বাস দিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে আলোচনা করে এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়া হবে বলে জানিয়েছেন। জানা গেছে, এর বাইরেও বাণিজ্য মন্ত্রণালয় থেকে পোশাক শিল্পকে সহায়তা দিতে একটি চিঠি দেয়া হয়েছে। ওই চিঠিতে বলা হয়, তৈরি পোশাক শিল্প বর্তমানে আন্তর্জাতিক অর্থনীতি ও অভ্যন্তরীণ বিভিন্ন চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করছে। সংশ্লিষ্ট বিভাগ, দফতর ও সংস্থাকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য অনুরোধ জানানো হয়।