শনিবার , ২০শে এপ্রিল, ২০২৪ , ৭ই বৈশাখ, ১৪৩১ , ১০ই শাওয়াল, ১৪৪৫

হোম > Uncategorized > ঘুষ বাণিজ্যের হেড কোয়ার্টার শিক্ষা ভবন

ঘুষ বাণিজ্যের হেড কোয়ার্টার শিক্ষা ভবন

শেয়ার করুন

স্টাফ রিপোর্টার ॥ ঘুষ বাণিজ্যের হেড কোয়ার্টারে পরিণত হয়েছে শিক্ষা ভবন। কারও কাগজপত্রে একটু ভুল থাকলে যেন খুশি হন এ ভবনের কর্মকর্তারা। বেড়ে যায় ঘুষের রেট। সমপ্রতি স্কুল-কলেজ, মাদরাসাসহ দেশের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে গ্রন্থাগারিক নিয়োগে ব্যাপক ঘুষ বাণিজ্য হয়েছে। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নতুন নিয়ম অনুযায়ী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে গ্রন্থাগারিক নিয়োগে তথ্যবিজ্ঞান ও গ্রন্থাগার বিভাগের আনুষ্ঠানিক ডিগ্রি থাকতে হবে। যেটি আগে ছিল না। দেশের বিভিন্ন স্কুল-কলেজ ও মাদরাসায় কর্মরত ৬৪৪৩ জন গ্রন্থাগারিক এমপিওভুক্তির জন্য আবেদন করেছিলেন মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তরে (মাউশি)। গত কয়েক বছর ধরে তারা চাকরি করে আসছেন। আবেদনকারীদের বেশির ভাগই সার্টিফিকেট নিয়েছেন বিভিন্ন প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের অবৈধ শাখা থেকে। যেগুলোর অনুমোদন নেই বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) বা শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের। এ সুযোগে শিক্ষা ভবনের কর্মকর্তারা আবেদনকারীদের কাছ থেকে দাবি করেন মোটা অঙ্কের ঘুষ। শিক্ষা ভবনের তৃতীয় শ্রেণীর কর্মকর্তা-কর্মচারী সমিতির একজন নেতা বলেন, কাগজপত্র ঠিক নেই বিষয়টি জেনে এমপিওভুক্তির সঙ্গে জড়িত কর্মকর্তারা আবেদনকারীদের কাছ থেকে মোটা অঙ্কের ঘুষ নিয়েছে। সূত্র জানায়, একেকজনের কাছ থেকে ৫০ হাজার থেকে এক লাখ টাকা পর্যন্ত ঘুষ নেয়া হয়েছে। ব্যাপক ঘুষ বাণিজ্য হলেও ইউজিসি ও শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের শক্ত অবস্থানের কারণে এমপিও হয়নি এসব আবেদনকারীর। আবেদনকারীদের মধ্যে মাত্র ১২৯ জনের এমপিও হয়েছে। বাকিদের এমপিও হয়নি। আবেদনকারীদের মধ্যে ৭০০ জন জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডিগ্রি নিয়েছেন। আর পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডিগ্রি নেয়া ৪/৫ জন আবেদন করেছিলেন। তাদের সবারই এমপিও হয়েছে। আর বাকি বেশির ভাগ আবেদনকারীই দারুল ইহসান ইউনিভার্সিটি থেকে সার্টিফিকেট নিয়েছেন। এমপিওভুক্তির সঙ্গে জড়িত কর্মকর্তারা বলেছেন, দারুল ইহসান ইউনিভার্সিটির  দেশব্যাপী রয়েছে অবৈধ শাখা ক্যাম্পাস। আর সার্টিফিকেট নেয়া হয়েছে এসব অবৈধ শাখা থেকেই। এ জন্য দারুল ইহসান ইউনিভার্সিটি থেকে ডিগ্রি নেয়া শিক্ষার্থীদের এমপিও হয়নি। একজন আবেদনকারী বলেন, আমরা দীর্ঘদিন ধরে চাকরি করছি এমপিও’র আশায়। আবেদন করার পর আবার ঘুষ দিতে হয়েছে। এখন আমাদের সার্টিফিকেট নিয়েই প্রশ্ন উঠেছে। তিনি বলেন, আমাদের অপরাধ কি? বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) চেয়ারম্যান অধ্যাপক একে আজাদ চৌধুরী বলেছেন, দারুল ইহসানসহ আর কয়েকটি প্রাইভেট ইউনিভার্সিটির সার্টিফিকেট ভুয়া। টাকা দিয়ে এসব সার্টিফিকেট নিয়েছেন শিক্ষার্থীরা। তারা এসব সার্টিফিকেট নিয়ে অপরাধ করেছেন। আমরা দারুল ইহসান ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি না হতে নিষেধ করে বিজ্ঞাপন দিয়েছি। মাউশি’র মহাপরিচালক অধ্যাপক ফাহিমা খাতুন বলেন, যাদের আবেদন সঠিক ছিল তাদের এমপিও হয়েছে। তিনি বলেন, বাকি আবেদনগুলো আমরা ইউজিসিতে পাঠিয়েছি। ফাহিমা খাতুন বলেন, বিভিন্ন প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের অবৈধ শাখা রয়েছে। আবেদনকারীরা অবৈধ শাখা থেকে সার্টিফিকেট নিয়েছে। এ জন্য তাদের এমপিও হয়নি। এদিকে মাধ্যমিক উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তরের (মাউশি) বিভিন্ন ভবনে ৩৩টি সিসি ক্যামেরা বসানো হয়েছে। গত বছরের ১১ই জুলাই সিসি ক্যামেরা বসানো হয় বিভিন্ন স্পটে। এর উদ্দেশ্য ছিল কর্মকর্তারা কাজ করছেন কিনা বা শিক্ষকদের কাছ থেকে ঘুষ নিচ্ছেন কিনা তার তদারকি করা। কিন্তু সিসি ক্যামেরার কারণে দুর্নীতি আরও বেড়েছে। ওই গোপন ক্যামেরার কারণে এখন কর্মকর্তারা রুমে বসে আর ঘুষের টাকা নেন না। টাকা নেন ওয়াশরুম বা চা খাওয়ার নাম করে বাইরে গিয়ে। বেড়েছে রেটও। শিক্ষা ভবনে সিসি ক্যামেরার পাশাপাশি বেশ কিছু পরিবর্তনও হয়েছে। দেয়ালে লেগেছে নতুন রং। সিঁড়ির  গোড়ায় শোভা পাচ্ছে বিভিন্ন জনের ছবি এবং ভবনের বাইরে দেয়ালে লাগানো হয়েছে ফেস্টুন। ফেস্টুনে লেখা টাইম স্কেলের জন্য ১০৪ নম্বর কক্ষে প্রয়োজনীয় কাগজপত্র জমা দিন, ব্যক্তিগত যোগাযোগ করবেন না। শিক্ষা ভবনে দুর্নীতি, অনিয়ম ও শিক্ষকদের হয়রানি ঠেকাতে নানা  কৌশল গ্রহণ করা হলেও সবই যেন অপকৌশলে পরিণত হয়েছে। কমেনি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক-কর্মচারীদের হয়রানি। বাড়েনি কাজের অগ্রগতি। কর্মকর্তা-কর্মচারীরাই ঘুষের টাকা আগে পকেটে নিয়ে হাতে হাতে ফাইল ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাকে দিয়ে  সই করান। আর তদবির না করা ফাইল পড়ে থাকে বছরের পর বছর কর্মকর্তাদের ফাইল কেবিনেট নামক আলমারির তলায়। শিক্ষা ভবনের সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে। ‘ফ’ আদ্যক্ষরের এক শিক্ষক দীর্ঘ ৪ বছর ধরে রাজধানীর একটি বিখ্যাত গার্লস কলেজে শিক্ষকতা করছেন। এখনও তার এমপিও হয়নি। এমপিও না হওয়ার কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমি মোটা অঙ্কের ঘুষ দিতে পারিনি বলে আমার এমপিও হচ্ছে না। ‘এই কথা সেই কথা’ বলে তাকে ঘুরানো হচ্ছে বলে জানান ওই শিক্ষক। সূত্র জানায়, ভবনের চেহারা পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে বদলেছে দুর্নীতির ধরন। থেমে নেই দুর্নীতি আর অনিয়ম। প্রতিদিন চলছে তদবির বাণিজ্য। টাইম স্কেল, এমপিওভুক্তি এবং প্রাতিষ্ঠানিক প্রয়োজনে বিভিন্ন জেলা  থেকে শিক্ষকরা মাউশিতে প্রতিনিয়ত এসে হয়রানির শিকার হচ্ছেন। প্রত্যন্ত অঞ্চল  থেকে সাক্ষাৎ করতে আসা শিক্ষক-কর্মকর্তাদের নিজ কক্ষ থেকে বের করে দিয়ে একশ্রেণীর তদবির নিয়ে আসাদের সঙ্গে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা মেতে উঠেন। ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থেকেও সাক্ষাৎ করতে পারেন না অনেকে। একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের পরিচালনা পর্ষদের একজন  চেয়ারম্যান বলেন, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে শিক্ষক নিয়োগ করার সময় চাকরিপ্রার্থীর কাছ থেকে অর্থ আদায় করতে বাধ্য। তিনি হিসাব দিলেন, কিভাবে কোন কারণে ওই শিক্ষকের কাছ থেকে অর্থ গ্রহণ করতে হয়। তার কথা, একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষক নিয়োগ করতে হলে শিক্ষা ভবনে ধরনা দিতে হয়। নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি দিতে হয় এবং এমপিওভুক্তি বিষয়েও সরকারি দপ্তরের অনুমোদন আনতে হয়। যদি প্রথম বিজ্ঞপ্তি  দেয়ার পর যোগ্য প্রার্থী পাওয়া না যায়, তাহলে দ্বিতীয়বার বিজ্ঞাপন প্রকাশ করতে হয় পত্রিকায়। কখনো কখনো এই বিজ্ঞাপন তিন বা তারও বেশি সময়ও প্রকাশ করতে হয়। এটা নিয়ম। এই নিয়ম রক্ষার জন্য যে অর্থের প্রয়োজন হয়, তা আসবে কোথা  থেকে? সেই অর্থও না হয় সংস্থান করা  গেল। কিন্তু এটাই যদি একমাত্র ব্যয় হতো তাহলেও কোন কথা ছিল না। প্রথমেই আসে এমপিওভুক্তির বিষয়টি। এমপিওবিষয়ক জটিলতা কাটানোর জন্য শিক্ষা ভবনে গেলে ৩০ হাজার থেকে ৫০ হাজার টাকা পর্যন্ত চোখ বুজে দিয়ে আসতে হয়।  যে শিক্ষককে নিয়োগ দিতে হচ্ছে,  সেই নিয়োগ প্রক্রিয়ার মধ্যেই প্রাসঙ্গিক ব্যয়গুলো ধরে নিতে হয় বাধ্য হয়ে। সাক্ষাৎকার ও নিয়োগ পরীক্ষায় ভালোভাবে উত্তীর্ণ হওয়ার পরও কোন যোগ্য শিক্ষক চাকরি লাভ করতে পারছেন না অনেক সময়। সেখানে বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে অর্থ। মাউশি’র মহাপরিচালক অধ্যাপক ফাহিমা খাতুন বলেন, আমরা চেষ্টা করছি হয়রানি কমাতে। এখানে সব অফিসার সৎ তা বলবো না। তিনি বলেন, এখানে দীর্ঘদিন ধরে গড়ে ওঠা দুর্নীতি একদিনে বন্ধ করা সম্ভব নয়।