শুক্রবার , ২৯শে মার্চ, ২০২৪ , ১৫ই চৈত্র, ১৪৩০ , ১৮ই রমজান, ১৪৪৫

হোম > Uncategorized > ছাত্রলীগের তাণ্ডবে ইবি রণক্ষেত্র গুলিবৃষ্টি বোমা হামলায় আহত ৫০

ছাত্রলীগের তাণ্ডবে ইবি রণক্ষেত্র গুলিবৃষ্টি বোমা হামলায় আহত ৫০

শেয়ার করুন

বিশ্ববিদ্যালয় রিপোর্টার ॥ ছাত্রদল-শিবিরের প্রতিরোধের মুখে ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস ছেড়ে পালিয়েছে ক্ষমতাসীন ছাত্রলীগ ক্যাডাররা। ক্যাম্পাসের আধিপত্য নিতে চাপাতি, রামদা, হকিস্টিক নিয়ে বৃষ্টির মতো গুলি ও ককটেল ছুড়ে ক্যাম্পাসে আতঙ্ক সৃষ্টি করলে তারা গতকাল এ প্রতিরোধের মুখে পড়ে।
এর আগে তুচ্ছ ঘটনার জেরে ক্যাম্পাসে ক্ষমাতার দাপট দেখাতে ছাত্রলীগ সন্ত্রাসীরা দুই ছাত্রদল কর্মীকে নির্মমভাবে
পিটিয়ে হাত ভেঙে দিলে উভয়পক্ষে দফায় দফায় সংঘর্ষ বাধে। এক পর্যায়ে ছাত্রদলের সঙ্গে শিবির ও সাধারণ শিক্ষার্থীরা যোগ দিলে এ সংঘর্ষ তুমুল আকার ধারণ করে। এতে উভয়পক্ষের অন্তত ৫০ নেতাকর্মী আহত হয়।
সংঘর্ষ চলাকালে পুলিশ সদস্যরা ছাত্রলীগের সহযোগীর ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়ে পুলিশ ছাত্রশিবির ও ছাত্রদল নেতাকর্মীদের ওপর অর্ধশতাধিক শটগানের গুলি ও টিয়ারশেল নিক্ষেপ করেও ছাত্রলীগের শেষ রক্ষা করতে পারেনি।
সংঘর্ষের পর ছাত্রদল ও শিবিরের ৩-৪শ’ নেতাকর্মীকে আসামি করে মামলা দায়ের করেছে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। একই সঙ্গে তারা ঘটনা তদন্তে বিকালে ৬ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করেছে।
সংঘর্ষের পর ক্যাম্পাসজুড়ে থমথমে পরিস্থিতি বিরাজ করছে। ক্যাম্পাসজুড়ে অবস্থান করছে পুলিশ। এ অবস্থায় পুলিশের গ্রেফতার এড়াতে ছাত্রদল ও শিবির নেতাকর্মীদের সঙ্গে ক্যাম্পাস ছেড়ে গা-ঢাকা দিয়েছে অনেক সাধারণ শিক্ষার্থীও।
প্রত্যক্ষদর্শী ও পুলিশ সূত্রমতে, গতকাল সকাল ৯টায় ঝিনাইদহ থেকে ছেড়ে আসা ক্যাম্পাসের বাস শেখপাড়া বাজারে পৌঁছলে স্থানীয় ছাত্রলীগের এক কর্মী গাড়ি থামিয়ে চালককে মারধর করে। এ সময় বাসে অবস্থানকারী শিক্ষার্থীরা এর প্রতিবাদ করে। গাড়িতে থাকা ছাত্রদলের কর্মী রনি ও সোহাগ ছাত্রলীগের ওই কর্মীকে বাধা দিলে সে তাদের দেখে নেয়ার হুমকি দেয়।
এ ঘটনার জেরে সকাল ১০টার দিকে ইবি ছাত্রলীগের ক্যাডার রাসেল জোয়ার্দার বহিরাগত ছাত্রলীগ সন্ত্রাসীদের নিয়ে ছাত্রদল কর্মী রনি ও সোহাগকে বিশ্ববিদ্যালয় অনুষদ ভবনের সামনে উপর্যুপরি পিটিয়ে আহত করে। এতে ছাত্রদল কর্মী সোহাগের বাম হাত ভেঙে যায়। এ সময় অনুষদ ভবনের সামনে উপস্থিত ছাত্রদল কর্মীরা ছাত্রলীগ কর্মীদের বাধা দিতে গেলে ধাক্কাধাক্কি হয়। এ সময় ছাত্রলীগ কর্মীরা ছাত্রদলকে ধাওয়া দিলে তারা কেন্দ্রীয় ক্যাফেটেরিয়ার পাশে অবস্থান নেয়।
পরে সকাল সাড়ে ১১টার দিকে ছাত্রদল নেতাকর্মীরা সংগঠিত হয়ে বিশ্ববিদ্যালয় অনুষদ ভবনের সামনে তাদের দলীয় টেন্টে অবস্থান নিতে গেলে ছাত্রলীগ ক্যাডাররা আবারও ছাত্রদলের ওপর হামলার চেষ্টা চালায়। ছাত্রদলও পাল্টা প্রতিরোধ গড়ে তুললে উভয়পক্ষে ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া শুরু হয়।
সংঘর্ষ চলাকালে উভয় সংগঠনের নেতাকর্মীরা আগ্নেয়াস্ত্র, চাপাতি, রামদা, হকিস্টিক, লাঠিসোটা, ইটপাটকেল নিয়ে একে অপরের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। ছাত্রলীগের অন্তত ৮ ক্যাডার পুলিশের সামনেই আগ্নোস্ত্র হাতে ছাত্রদল কর্মীদের লক্ষ্য করে গুলি চালায়। ছাত্রলীগের ধাওয়ার মুখে ছাত্রদল পিছু হটে ছাত্রদের আবাসিক এলাকার দিকে চলে যায়। সেখান থেকে আবারও সংগঠিত হয়ে ছাত্রদল কর্মীরা ছাত্রলীগকে ধাওয়া করার চেষ্টা করলে পুলিশ বিনা উসকানিতে হলের সামনে অবস্থান করা ছাত্রশিবির ও ছাত্রদল নেতাকর্মীদের লক্ষ্য করে নির্বিচারে টিয়ারশেল ও শটগানের গুলি ছোড়ে।
এ সময় শিবির কর্মীরা ছাত্রদলের সঙ্গে যোগ দিয়ে পুলিশ ও ছাত্রলীগ সন্ত্রাসীদের ধাওয়া করে। এ সময় পুরো ক্যাম্পাসে সংঘর্ষ ছড়িয়ে পড়ে। শিবির-ছাত্রদলের সম্মিলিত ধাওয়ার মুখে ছাত্রলীগের একাংশ ক্যাম্পাস থেকে পালিয়ে যায়।
অপর অংশ প্রশাসন ভবনে আশ্রয় নিয়ে তালা লাগিয়ে দেয়। সংঘর্ষ চলাকালে ছাত্রদল ও শিবির কর্মীরা প্রশাসন ভবনের সামনে থাকা ৫টি মোটরসাইকেল ভাংচুর করে। বেলা দেড়টার দিকে শিবির কর্মীরা আবাসিক হলে ও ছাত্রদল কর্মীরা ক্যাম্পাসের বাইরে চলে গেলে পরিস্থিতি শান্ত হয়।
সংঘর্ষে ইবি ছাত্রদলের সহ-সভাপতি মোহাইমিনুল ইসলাম সোহাগ, সাংগঠনিক সম্পাদক আবুল খায়ের, অর্থ সম্পাদক কামরুল ইসলাম গুলিবিদ্ধসহ উভয় দলের কমপক্ষে ৫০ নেতাকর্মী আহত হন বলে জানা গেছে।
আহতদের মধ্যে ছাত্রদলের সাধারণ সম্পাদক রাশিদুল ইসলাম রাশেদ, সহ-সভাপতি আনিসুল ইসলাম, যুগ্ম সম্পাদক সিরাজুল ইসলাম, সহ-সাধারণ সম্পাদক জাহাঙ্গীর হোসেন, শামিম, রাসেল, দফতর সম্পাদক শাহেদ, প্রচার সম্পাদক সৌরভ, রাজু, হুমায়ুন, বোরহান, বকুল, রনি, সোহাগসহ অন্তত ২৫ জন আহত হয়েছেন।
ছাত্রলীগের যুগ্ম আহ্বায়ক আবুজর গিফারী গাফফার, সজিব, রতন, সাইফুল, রানু, সোহেল, হালিমসহ অন্তত ২০ নেতাকর্মী আহত হন। শিবির কর্মীদের মধ্যে মইনুল ইসলাম খান, খলিল, ইকবালসহ ৬ জন আহত হয়েছে। আহতদের ইবি মেডিকেল সেন্টারে প্রথমিক চিকিত্সা শেষে কুষ্টিয়া ও ঝিনাইদহের বিভিন্ন হাসপাতাল এবং ক্লিনিকে ভর্তি করা হয়েছে।
সংঘর্ষ চলাকালে পুলিশ অর্ধশতাধিক টিয়ারশেল ও শটগানের গুলি ছোড়ে। এছাড়া ছাত্রলীগও প্রতিপক্ষকে লক্ষ্য করে আগ্নোস্ত্র থেকে অন্তত ৪০ রাউন্ড গুলি ও ২০টির মতো ককটেল বিস্ফোরণ ঘটায়। গুলি ও ককটেলের শব্দে ক্যাম্পাসের শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের মাঝে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। অনেক ছাত্রছাত্রী দিগ্বিদিক ছোটাছুটি করে ক্যাম্পাস থেকে চলে যায়।
ছাত্রদল সভাপতি ওমর ফারুক বলেন, ‘ছাত্রলীগ সন্ত্রাসীরা বহিরাগত সন্ত্রাসীদের নিয়ে বিনা উসকানিতে আমাদের ওপর হামলা চালিয়েছে। আমরা সাধারণ ছাত্রদের নিয়ে তাদের প্রতিরোধ করেছি। একইভাবে ভবিষ্যতেও ছাত্রলীগের যে কোনো অন্যায় প্রতিরোধ করা হবে।’
ইবি ছাত্রলীগের আহ্বায়ক শামীম হোসেন খান বলেন, ‘ছাত্রদল সন্ত্রাসীরা প্রধানমন্ত্রীকে নিয়ে অশালীন মন্তব্য করায় নেতাকর্মীদের সঙ্গে বাকবিতণ্ডা হয়। পরে তারা শিবিরকে সঙ্গে নিয়ে আমাদের ওপর সশস্ত্র হামলা চালিয়েছে। এতে ছাত্রলীগের অন্তত ২০ নেতাকর্মী আহত হয়েছে।’
ইবি শিবিরের সাধারণ সম্পাদক আসাদুল্লাহ বলেন, ছাত্রদল-ছাত্রলীগের সংঘর্ষ চলাকালে অপ্রত্যাশিতভাবে পুলিশ ও ছাত্রলীগ ছাত্রশিবিরের নেতাকর্মী এবং সাধারণ ছাত্রদের ওপর গুলি চালিয়েছে। আমরা এই ঘটনার প্রতিবাদ করেছি।
তিনি ক্যাম্পাসে শিক্ষার সুষ্ঠু পরিবেশ নিশ্চিত করার জন্য প্রশাসনের প্রতি আহ্বান জানান। একই সঙ্গে এ ঘটনায় জড়িতদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি করেন।
ইবি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মনিরুজ্জামান বলেন, পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে পুলিশ শটগানের গুলি ও টিয়ারশেল নিক্ষেপ করেছে। তবে এখনও হিসাব করা হয়নি কী পরিমাণ গুলি ছোড়া হয়েছে।
প্রক্টর প্রফেসর ড. জাহাঙ্গীর হোসেন বলেন, তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে এ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। বর্তমানে সব কিছু প্রশাসনের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। যে কোনো ধরনের অস্থিতিশীল পরিবেশের মোকাবিলায় ক্যাম্পাসে অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে।
ছাত্রদল-শিবিরের ৩-৪শ’ নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে মামলা, তদন্ত কমিটি গঠন : এদিকে ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে (ইবি) সংঘর্ষের ঘটনা তদন্তের জন্য ইংরেজি বিভাগের প্রফেসর ড. মো. হারুন-উর রশিদ আসকরীকে আহ্বায়ক করে ৬ সদস্যবিশিষ্ট তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে।
বেলা ৩টার দিকে ভিসি প্রফেসর ড. আবদুল হাকিম সরকারের সভাপতিত্বে তার সভাকক্ষে অনুষ্ঠিত আইনশৃঙ্খলা কমিটির সভায় এ কমিটি গঠন করা হয়। কমিটির অন্য সদস্যরা হলেন প্রফেসর ড. মো. আনোয়ার হোসেন, প্রফেসর ড. মুহাম্মদ রুহুল আমীন ভূঁইয়া, প্রফেসর ড. মো. গোলাম মওলা ও ছাত্র উপদেষ্টা প্রফেসর ড. মো. মাহবুবর রহমান। প্রক্টর প্রফেসর ড. মো. জাহাঙ্গীর হোসেনকে তদন্ত কমিটির সদস্য সচিব করা হয়েছে।
তদন্ত কমিটিকে দ্রুত সময়ের মধ্যে ঘটনার সঠিক তদন্ত সাপেক্ষে রিপোর্ট প্রদান করতে বলা হয়েছে। তদন্ত কমিটি গঠন ছাড়াও এ ঘটনায় বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে রেজিস্ট্রার মসলেম উদ্দিন বাদী হয়ে ইবি থানায় একটি মামলা (মামলা নং-০২) দায়ের করেছেন। মামলায় ছাত্রদল ও শিবিরের অজ্ঞাতনামা ৩-৪শ’ নেতাকর্মীকে আসামি করা হয়েছে।