শুক্রবার , ২৬শে এপ্রিল, ২০২৪ , ১৩ই বৈশাখ, ১৪৩১ , ১৬ই শাওয়াল, ১৪৪৫

হোম > ভ্যারাইটিজ > জয় বাংলা ধ্বনি দিয়েই নিভে গেল একজন শহীদ বীর মুক্তিযোদ্ধার জীবন প্রদীপ

জয় বাংলা ধ্বনি দিয়েই নিভে গেল একজন শহীদ বীর মুক্তিযোদ্ধার জীবন প্রদীপ

শেয়ার করুন

মুক্তিযোদ্ধা এস এম মাহফুজুল হক নুরুজ্জামান, আইজি, ঢাকা রেঞ্জ, বাংলাদেশ পুলিশ ॥

একজন মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে বিবেকের তাড়নায় ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনার দায়বদ্ধতা থেকে একজন শহীদ বীর মুক্তিযোদ্ধার জীবনের শেষ স্মৃতিগুলো দেশবাসী, সতীর্থ মুক্তিযোদ্ধা ও তার পরিবারকে জানানোটা নৈতিক দায়িত্ব বলে মনে করি। এই শহীদ বীর মুক্তিযোদ্ধার নাম মজিবর রহমান মুন্সি, পিতা-মরহুম আঃ খালেক মুন্সি, গ্রাম- কাগ্দী, থানা- কাশিয়ানী, জেলা- গোপালগঞ্জ (ফরিদপুর)। সহযোদ্ধা শহীদ মজিবর রহমান মুন্সির সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয় হয় সকল প্রকার প্রশিক্ষণ শেষে পশ্চিম বাংলার কল্যানী রেস্ট ক্যাম্পে। মজিবরের উচ্চতর প্রশিক্ষণ হয়েছে চাকুলিয়াতে আর আমার বীরভূমে। কল্যানী থেকে আমরা একই কোম্পানী ও একই প্লাটুনে অন্তর্ভূক্ত হই। ভারতীয় সেনাবাহিনীর নিয়ন্ত্রণে তাদের ছাউনীতে আমরা বাগদা ভারতীয় সীমানায় (যশোরের বর্ডারে) ক্যাম্প স্থাপন করি। তখন শহীদ মজিবর আমার পাশের সীটে থাকতেন। সে ছিল সদা হাস্যজ্জ্বল, সদালাপী ও বন্ধু বৎসল। বয়সে আমার থেকে প্রায় ২ বছরের বড় হলেও শরীরের গঠনে ও আকৃতিতে একটু ছোট ছিল। বয়স ও গ্রামের বাড়ী কাছাকাছি এবং ভারতীয় সেনাবাহিনীর সাথে মিত্রবাহিনী হিসেবে একসাথে প্রায় প্রতিটি যুদ্ধেই অংশগ্রহণ করার কারণে আমার সাথে মজিবর এর এক অবিচ্ছেদ্য বন্ধুত্বের সম্পর্ক গড়ে উঠে। যে কোন অপারেশন কিংবা রণপাহারায় আমি না গেলে সে যেতনা, তেমনি সে না গেলে আমিও কোন অজুহাতে ঝরপশ জবঢ়ড়ৎঃ করতাম। একদিন সন্ধ্যার পর আমরা পাকিস্তানী আর্মিদের এ্যাম্বুশে পড়লে সম্মুখ যুদ্ধ চলাকালে আমাদের (মুক্তিযোদ্ধাদের) কোন রকম সিগন্যাল/বার্তা না দিয়েই ভারতীয় সেনাবাহিনীর সদস্যরা আমাদের ফেলে তাদের ক্যাম্পে চলে যায়। ঐ যুদ্ধে কোন ক্ষয়ক্ষতি ছাড়াই ভাগ্যক্রমে আমরা বেঁচে যাই। প্রায় প্রতিটি অপারেশনেই আমাদের সামনে রাখা হ’ত, তাতে পাক আর্মি ও ভারতীয় আর্মি উভয় পক্ষের গুলিতে আমাদের জীবন নাশের আশঙ্কা ছিল। ২৬ দিন আমাদের এক কোম্পানী (মুক্তিযোদ্ধা) ভারতীয় সেনাবাহিনীর সাথে অঙ্গীভূত করে রাখে। একদিন ভারতীয় কর্ণেলসহ কয়েকজন উর্ধ্বতন অফিসার ও জয় বাংলার মেজর জলিল আমাদেরকে সীমান্তবর্তী ক্যাম্পে দেখতে আসলে শহীদ মজিবর এবং আমি একযোগে আমাদের দেশে গিয়ে যুদ্ধ করার অনুমতি প্রার্থনা করি। ফলে আমরা ঐদিনই দেশে আসার অনুমতি পাই। আমাদের কোম্পানী কমান্ডার ছিলেন মেজর হুদা এবং প্লাটুন কমান্ডার ছিলেন আমিনুর রহমান তালুকদার। এ/৪, ই-ঈড়ু এৎড়ঁঢ় ঘড়. কঝ-২৮, জবম. ঘড়- ঔ-১৫৪ ঋধৎরফঢ়ঁৎ. ভারতীয় সেনাবাহিনীর সাথে মিত্রবাহিনী হিসেবে কর্মকালীন আমরা বিনামূল্যে ২ প্যাকেট চার্মিনার সিগারেট পেতাম। ধুমপায়ী সহযোদ্ধারা আমাদের সিগারেট নিয়ে নিত। একদিন দেখলাম শহীদ মজিবর বেশ কিছু সিগারেট জমিয়ে রেখেছে। কারণ জিজ্ঞাসা করায় বলল, দেশ স্বাধীন হলে মুক্ত বাতাসে এই সিগারেট ফুকব। নরপিশাচ, নরঘাতক বর্বর পাক হায়েনার দল তাকে মুক্ত স্বাধীন দেশের নতুন সূর্যোদয় দেখার সুযোগ দিলনা।

বাগদা বর্ডারস্থিত ভারতীয় সেনাবাহিনীর ছাউনি থেকে আমাদের মুক্তিযোদ্ধাদের নামে অস্ত্র, গুলি, এক্সপ্লোসিভ, গ্রেনেড ইস্যু করে ২ মাসের খরচের টাকাসহ প্রয়োজনীয় ব্রিফিং দিয়ে ২জন গাইডসহ বিদায় দিলে অপরাহ্নে আমরা মৃত্যুকে আলিঙ্গন করেই যশোর জেলার ভিতর দিয়ে তৎকালীন ফরিদপুর জেলার উদ্দেশ্যে পায়ে হেটে রওনা হই। দীর্ঘদিন পরে দেশে ফেরার এক অনাবিল আনন্দ অনুভব করলেও বুকের ভিতর এক অজানা শংকা কাজ করে। দেশের অভ্যন্তরে মা-বাবা, ভাই-বোন বেঁচে আছে কিনা; ঘরবাড়ী জ্বালিয়ে পুড়িয়ে দিয়েছে কিনা; গিয়ে কি দেখব তা আল্লাহই জানেন বলতেই হাটতে হাটতে শহীদ মজিবর অদম্য সাহসে আমার ঘাড়ে হাত রেখে বলল, তুই চিন্তা করিসনা, একজন মুক্তিযোদ্ধা ১০০ জন পাক আর্মিকে গুলি করে মারব। এখন আমাদের ট্রেনিং আছে; অস্ত্র আছে; ভয় কিসের !

প্রায় ১৫ বছর বয়সে রাইফেলসহ এতভারী সরঞ্জাম নিয়ে পায়ে হেটে সাত-সাগর তেরো নদী পাড়ি দেওয়ার মত আমাদের জন্ম জন্মান্তের সাধনার মাতৃভূমিতে আসতে পেরে পৃথিবীর সবচেয়ে ভাগ্যবান বলে মনে হয়েছিল। আমাদের কমান্ডার আমিনুর রহমান তালুকদার এর পরামর্শে ও কোম্পানী কমান্ডার মেজর হুদার নির্দেশে কাশিয়ানী থানার রাতইল গ্রামে মধুমতি নদীর পাড়ে বৃটিশ আমলের উঝচ সাবান মিয়ার বাড়ীতে ক্যাম্প স্থাপন করি। রাতইল গ্রাম থেকে পাক আর্মিদের ঐতিহাসিক ঘাটি ভাটিয়াপাড়ার দূরত্ব প্রায় ০৩ মাইল। আমরা ঘরের মেঝেতে বিছানা পেতে বিশ্রাম নিতাম। এখানেও মজিবরের বিছানা ছিল আমারই পাশে। রাতইল গ্রাম, রাতইল স্কুল, চাপ্তা স্কুল ও চাপ্তা গ্রামের অনেক বাড়ীতেই মুক্তিযোদ্ধা ও মুজিব বাহিনীর সদস্যরা ক্যাম্প স্থাপন করে ভাটিয়াপাড়াসহ বিভিন্ন যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে। মুক্তিযুদ্ধের কাশিয়ানী থানা কমান্ডার মরহুম জগলুল কাদির সকল দলের সদস্যদের ডিউটি বন্টন করতেন। আমাদের গ্রামের কাওছার কাজী, ইদ্রিস মোল্লা ও আমাকে এক শিফট্-এ এবং এক জায়গায় ডিউটি দেয়ার জন্য শহীদ মজিবর রহমান থানা কমান্ডারকে অনুরোধ করে। কারণ আমরা শপথ নিয়েছিলাম, যে কেউ মারা গেলে যত ঝুঁকিই থাকুক না কেন লাশ যেন ফেলে না আসি। পাক আর্মিরা যেন আমাদের মৃত লাশ লাঞ্ছিত না করতে পারে, আর আমাদের কবরের চিহ্ন যেন থাকে। সকাল-সন্ধ্যা ও সন্ধ্যা-সকাল এই দুই শিফট্-এ আমরা ডিউটি করতাম। সেক্টর কমান্ডার মেজর মঞ্জুরের নির্দেশে কাশিয়ানী, মুকসুদপুর, লোহাগড়া (নড়াইল) আলফাডাঙ্গা ও বোয়ালমারীর প্রায় সকল মুক্তিফৌজ ও মুজিব বাহিনী একযোগে ভাটিয়াপাড়ার চতুর্দিকে অবস্থান নেয়। ডিসেম্বর এর প্রথম দিক থেকেই ভাটিয়াপাড়ার পাক আর্মি, রাজাকার ও আলবদররা অবরুদ্ধ হয়ে পড়ে। পাক আর্মিদের সকল প্রকার মুভমেন্ট বন্ধ করে দেওয়া হয়। ইতোমধ্যে যশোর ক্যান্টনমেন্ট মিত্রবাহিনীর নিয়ন্ত্রণে আসলে ভাটিয়াপাড়ার পাক আর্মিদের মনোবল ভেঙ্গে পড়ে। পাক আর্মিরা আমাদের ঘাটিতে পাকা বাংকার থেকেই হালকা ও ভারী অস্ত্রের গুলি বর্ষন করত। মাঝে মাঝে আমরা দেখতাম চতুর্দিক থেকে হাজার হাজার গুলি ছুড়লেও পাক আর্মিরা গুলি ফুরিয়ে যাওয়ার আশংকায় গুলি বর্ষণ থেকে বিরত থাকত।

৮ ডিসেম্বর ১৯৭১ আমাদের সকাল-সন্ধ্যা ডিউটি পড়ল ভাটিয়াপাড়া রেলস্টেশনের পূর্বদিকে। আমিন গ্রুপে আমি, শহীদ মজিবর, কাওছার, ইদ্রিস, মোদাচ্ছের, আবুলসহ আরো কয়েকজন (নাম মনে নেই) রেল লাইন ঘেষে পজিশন নিলাম। উল্লেখ্য রেল লাইনের পর খাল এবং খালের পরেই পাক আর্মিদের পাকা বাংকারসহ শক্তিশালী ঘাটি। আমাদের থেকে তাদের দূরত্ব খুবই নিকটে থাকলেও রেললাইনটা আড় হিসেবে ব্যবহার করতাম। ঐদিন আমরা শত শত গুলি ছুড়লেও পাক হায়েনাদের দল সারাদিন একটি গুলিও ছুড়েনি। ওদের বাংকারে মেশিনগান ঐগএ/ গগএ/ খগএ দেখা যায়, কিন্তু গুলি না করে কাওয়ালী গান গায়। প্রচন্ড ক্ষুধার্ত আমরা, পড়ন্ত বিকাল বেলায় ভাবছি একটু পরে আমাদের রিলিভার (অন্যদল) আসলে ক্যাম্পে ফিরে গিয়ে পেট পুরে খেয়ে গানের আসর বসাব। শহীদ মজিবর বলছিল আমাদের আজকের ডিউটি শেষ হতে চলল, একটা পাক আর্মি না মেরে ক্যাম্পে ফিরে যাবনা। বাংকারের ছিদ্র পথে দেখতে পাওয়া পাক আর্মিদের গুলি করার উদ্দেশ্যে হঠাৎ দেখলাম শহীদ মজিবর আমার পাশ থেকে রেল লাইনে উঠে বসে বলল, শালাদের গুলি শেষ হয়ে গেছে বলেই গুলি করার উদ্যোগ নিতেই একটা বুলেটে মজিবরের বক্ষ বিদীর্ন হ’ল। মজিবর গগণ বিদারী জয় বাংলা ধ্বনিতে চিৎকার দিয়ে রেল লাইনের উপর লাফ দিয়ে পড়ে গেল। ফিনকি দিয়ে লাল রক্ত বের হতে লাগল। তখন পাক আর্মিরা বৃষ্টির মত গুলি বর্ষন করতে লাগল। আমাদের সহযোদ্ধারা অনেকেই বুঝতে না পেরে পালাতে শুরু করল। মজিবরকে টেনে নীচে নামালাম, রাইফেলটা নিলাম। তখন তার গলার স্বর নীচু হয়ে গেছে, আস্তে আস্তে বলল “লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ।” বিড় বিড় করে তার মায়ের কথা, বাবার কথা, কবরের কথা কি যেন বলছিল বোঝা যাচ্ছিলনা। আমরা চিকিৎসার ব্যাপারে কথা বলার কারণে তার শেষ ইচ্ছা বা কথাগুলো ভাল করে শুনতে পারলাম না। অল্প কিছুক্ষণের মধ্যেই নিভে গেল সম্ভাবনাময় সদাহাস্য দেশ প্রেমিক বীর মুক্তিযোদ্ধা মজিবর রহমান মুন্সির জীবন প্রদীপ। বীর শহীদদের তালিকায় আর একটি নাম অন্তর্ভূক্ত হ’ল।

রাতেই মজিবরের লাশ কাঁধে করে আমরা সহযোদ্ধারা রেল লাইন ধরে ৭/৮ কিঃমিঃ পায়ে হেটে কাগ্দি গ্রামে তার বাড়িতে পৌঁছলাম। অকস্মাৎ মজিবরের লাশ দেখে তার মা-বাবা, ভাই-বোন, আত্মীয় স্বজনের চিৎকার কান্নায় রাতের আধারে বাতাস ভারী হয়ে উঠল। রাতেই বাড়ীর দক্ষিণ পূর্ব প্রান্তে রেল লাইন ঘেষে মজিবরকে সমাহিত করা হ’ল। তার মা শুকুরন নেছার আহাজারী আজও আমার হৃদয়কে ক্ষত-বিক্ষত করে। মা শুকুরন নেছা ২০১২ সালে ইহলোক ত্যাগ করেন। বাবা আব্দুল খালেক মুন্সি ১৯৮৬ সালে মৃত্যুবরণ করেন। বড় ভাই আজিজুর রহমান মুন্সিও আর বেচে নেই। ভাই তৈয়বুর রহমান মুন্সী কৃষি কাজ করে এবং অপর ভাই হাবিবুর রহমান (অবঃ সেনা সদস্য) ঢাকায় শ্যামলীতে কোন এক প্রাইভেট ফার্মে চাকুরী করে। মজিবরের বড় বোন সালেহা বেগম বিধবা হয়ে বেচে আছে। ছোট বোন হাসিনা বেগম পার্শ্ববর্তী ব্যাসপুর গ্রামে স্বামীর বাড়ীতে বসবাস করছেন।

এখানে একটি কথা না বললে সত্য গোপন করা হবে। আমাদের দলের মুক্তিযোদ্ধাদের প্রায় সকলেই হয় ছুটি নিয়ে না হয় ডিউটির ফাঁকে রাতের অন্ধকারে বাড়ীতে গিয়ে মা-বাবার সাথে সাক্ষাৎ করেছে। একমাত্র মজিবরই মা-বাবার সাথে সাক্ষাৎ করেনি। সে বলত: দেশকে শত্রুমুক্ত করে স্বাধীন দেশের পতাকা নিয়ে জয় বাংলা ধ্বনি দিতে দিতে বীরের বেশে একবারে বাড়ীতে যাব। শহীদ বীর মুক্তিযোদ্ধা মজিবর রহমান মুন্সির সেই অদম্য ইচ্ছা আর পূরণ হ’ল না।

আজ স্মৃতির অতলে হারিয়ে গেছে শহীদ বীর মুক্তিযোদ্ধা মজিবর রহমান মুন্সির নাম। নতুন প্রজন্মের কেউ তাকে আর চিনেনা আর জানবার কৌতুহলও নেই কারোর। যাদের রক্তে মুক্ত স্বদেশ, তাদের অসম্মান করলে জাতির গৌরবের পরিবর্তে দীনতা প্রকাশ পায়। আমি তার বিদেহী আত্মার শান্তি কামনা করছি। দেরীতে হলেও পদক প্রাপ্ত জাতীয় বীরদের তালিকায় এই শহীদদের নাম অন্তর্ভূক্ত করে রাষ্ট্রীয় খেতাবসহ মর্যাদা দেওয়া উচিৎ বলে মনে করি।