বৃহস্পতিবার , ২৮শে মার্চ, ২০২৪ , ১৪ই চৈত্র, ১৪৩০ , ১৭ই রমজান, ১৪৪৫

হোম > গ্যালারীর খবর > ডেসটিনির তিগ্রস্তদের মোহ কাটেনি

ডেসটিনির তিগ্রস্তদের মোহ কাটেনি

শেয়ার করুন

বাংলাভূমি২৪ ডেস্ক ॥ দ্রুত অর্থ লাভের মন্ত্রে সাধারণ মানুষকে আকর্ষণ করতে ডেসটিনির দ্বারস্থ হয়নি প্রচলিত প্রচারমাধ্যম— পোস্টার, লিফলেট কিংবা বিলবোর্ডের। কাছের মানুষের সঙ্গে বিশ্বস্ততার যে সম্পর্ক, তার ওপর ভর করে ডেসটিনির জাল বিস্তারলাভ করে দেশব্যাপী। লাখ লাখ মানুষ নেমে পড়ে টাকা বানানোর অদ্ভুত এক খেলায়। এসব মানুষের সবাই আজ তিগ্রস্ত। তবে এখনো মোহ কাটেনি তিগ্রস্তদের; বিশ্বাস করতে চায় না— তারা প্রতারিত।

অথচ প্রতিষ্ঠানটির কার্যক্রম বন্ধ প্রায় দেড় বছর। অর্থ পাচারের অভিযোগে এর প্রতিষ্ঠাতা ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. রফিকুল আমীন আটক আছেন কারাগারে। ব্যাংক হিসাবও প্রায় শূন্য। তার পরও ডেসটিনির বেশির ভাগ সদস্য কোনো তি হয়নি— এমন বিশ্বাসে অর্থ ফিরে পাওয়ার স্বপ্নে বিভোর।

সরেজমিনে দেখা মেলে ডেসটিনির এক সদস্য ফেনীর শফিউল আলীমের। সবচেয়ে কাছের মানুষটির হাত ধরে তিনি ডেসটিনির সেমিনারে গিয়েছিলেন। তার দৃঢ় বিশ্বাস, তিনি প্রতারিত হননি। শিগগিরই ডেসটিনির অবস্থা আবার স্বাভাবিক হবে, ফিরে পাবেন বিনিয়োগকৃত অর্থ। তিনি মনে করেন, ডেসটিনির টার্নওভার ছিল মাসে ১২০ কোটি টাকা, যা অনেক বড় কোম্পানিরই ছিল না। মিরপুর ইনডোর স্টেডিয়াম, বনানী আর্মি স্টেডিয়ামে ডেসটিনি আয়োজিত অনুষ্ঠানে উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাসহ মন্ত্রীরাও যোগ দিয়েছিলেন। এত বড় প্রতিষ্ঠান ধুলোয় মিশে যেতে পারে না।

ডেসটিনির কর্ণধাররা দুর্নীতি করতে পারেন— এমন কথা বিশ্বাস করতে নারাজ স্কুলের বন্ধু জাহাঙ্গীরের সঙ্গে ডেসটিনির কার্যক্রমে অংশ নেয়া মুন্সীগঞ্জের সুমন শেখ। একই ভাবনার ঘোরে সুদিনের অপোয় আছেন, এমন শতাধিক মানুষের দেখা মেলে শ্রীনগর উপজেলায়। সুমন শেখের মতোই ডেসটিনির এসব সদস্যের ধারণা, রফিকুল আমীন এক বিরাট ব্যক্তিত্ব; দেশের বেকারদের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করে তিনি একদিন সমাজটাকেই বদলে দেবেন।

ডেসটিনির তিগ্রস্ত সদস্যদের এমন মানসিক অবস্থা সম্পর্কে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোরোগ বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. সালাহউদ্দিন কায়সার বিপ্লব বলেন, নিকটজনের কাছ থেকে তারা শুনছেন, টাকা আছে। কাজেই যতণ পর্যন্ত না তারা নিজেরা দেখবেন টাকা নেই, ততণ তাদের এ ভুল ধারণা ভাঙবে না। এমনকি আদালতে প্রমাণ হওয়ার পরও তাদের মধ্যে এ বিশ্বাস থেকে যেতে পারে, কোম্পানি তাদের সঙ্গে কোনো ধরনের প্রতারণা করেনি।

দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে পাওয়া তথ্যে দেখা যায়, ডেসটিনির সদস্যদের মধ্যে রয়েছেন সরকারি-বেসরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক-ছাত্র, ব্যবসায়ী, গ্রামীণ নারী, এমনকি বেকাররাও। বিভিন্ন অফিস-আদালতে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাকে খুশি করতেও সদস্য হয়েছেন অধস্তন অনেকেই। কোম্পানি প্রতারণা করে অর্থ আত্মসাত্ করেছে, এমনটা মানতে নারাজ এদের বেশির ভাগই।

ডেসটিনির দুই শতাধিক সদস্যের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, তারা সবাই রফিকুল আমীনের কথায় বিশ্বাস স্থাপন করেছেন; অনেকের মধ্যেই যা এখনো অটুট। রফিকুল আমীন কোনো ধরনের প্রতারণা করতে পারেন, বিশ্বাসই করেন না মোহাবিষ্ট এসব সদস্য। এমনই একজন বন ও পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘আত্মীয়, বন্ধু ও অফিসের সহকর্মী মিলে ৬ লাখ টাকা বিনিয়োগ করেছি। আশা ছাড়িনি। শেষ পর্যন্ত অপো করতে চাই। আমার বিশ্বাস, টাকা মার যাবে না।’

মানুষ ভীষণভাবে আঘাতপ্রাপ্ত হলে তা এড়িয়ে চলার চেষ্টা করে। ডেসটিনির তিগ্রস্ত সদস্যদের অনেকেরই সে অবস্থা হয়েছে— এমন মন্তব্য করে সাইকোট্রমা ম্যানেজমেন্ট স্পেশালিস্ট ও মনোবিকাশ ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক একেএম সাখাওয়াত শরীফ ভূঞা জানান, কোনো কিছু খুইয়েছেন, তা তারা ভাবতেই চান না। এ অবস্থায় শারীরিক ও মানসিক দৃঢ়তা হারিয়ে এক ধরনের বৈকল্যে আক্রান্ত ডেসটিনির কার্যক্রমে তিগ্রস্তরা।

এদিকে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) প্রাথমিক অনুসন্ধান বলছে, বিনিয়োগকারীদের অর্থের প্রায় পুরোটাই আত্মসাত্ করেছেন ডেসটিনির পরিচালকরা। সংস্থাটির মতে, ডেসটিনি ২০০০ লিমিটেড কর্তৃপ ডেসটিনি ট্রি প্লান্টেশন ও ডেসটিনি মাল্টিপারপাস কো-অপারেটিভ সোসাইটির মাধ্যমে প্রায় সাড়ে ৩ হাজার কোটি টাকা সংগ্রহ করে। বর্তমানে তাদের পৃথক দুটি ব্যাংক হিসাবে অর্থ পাওয়া গেছে মাত্র ৫৬ লাখ ও ৪ কোটি ৮৭ লাখ টাকা। বাকি অর্থ তারা মানি লন্ডারিংয়ের মাধ্যমে আত্মসাত্ করেছে। কিছু অর্থ ব্যক্তিগত ব্যাংক হিসাবে স্থানান্তরের মাধ্যমেও আত্মসাত্ করেছেন পরিচালকরা।

তবে এ ঘটনায় মামলা দায়েরের পর এক বছরের বেশি সময় পেরিয়ে গেলেও তদন্ত শেষ করতে পারেনি দুদক। ডেসটিনি ট্রি প্লান্টেশন লিমিটেড ও ডেসটিনি পাল্টিপারপাস কোঅপারেটিভ লিমিটেডের বিরুদ্ধে গত বছরের ৩১ জুলাই মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইনে দুটি মামলা করে দুদক। ডেসটিনি মাল্টিপারপাস কোঅপারেটিভ লিমিটেডের বিরুদ্ধে করা মামলা তদন্তের দায়িত্বে আছেন দুদকের উপপরিচালক মোজাহার আলী সরদারের নেতৃত্বে পাঁচ সদস্যের একটি দল। আর ডেসটিনি ট্রি প্লান্টেশন লিমিটেডের মামলাটি তদন্তের নেতৃত্ব দিচ্ছেন সহকারী পরিচালক মো. তৌফিকুল ইসলাম।

উল্লেখ্য, ২০১২ সালের ৫ এপ্রিল জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) ডেসটিনির কার্যালয়ে অভিযান চালিয়ে নথিপত্র জব্দ করে। এরপর ৮ মে ডেসটিনি ট্রি প্লান্টেশন লিমিটেডের ব্যাংক হিসাব জব্দ করা হয়। ২৩ মে জব্দ হয় ডেসটিনি ২০০০ লিমিটেডের ব্যাংক হিসাব। ২৪ মে বাংলাদেশ ব্যাংক গ্রুপের ৩৫টি প্রতিষ্ঠানের লেনদেন স্থগিত করে। ২ অক্টোবর ব্যবস্থাপনা পরিচালক রফিকুল আমীনসহ ২২ কর্মকর্তার ৫৩৩টি ব্যাংক হিসাব জব্দ করা হয়। এর পরই বন্ধ হয়ে যায় ডেসটিনির সব কার্যক্রম।