শনিবার , ২০শে এপ্রিল, ২০২৪ , ৭ই বৈশাখ, ১৪৩১ , ১০ই শাওয়াল, ১৪৪৫

হোম > জাতীয় > তিনদিনের সফরে পোপ ফ্রান্সিস ঢাকায় আসছেন আজ

তিনদিনের সফরে পোপ ফ্রান্সিস ঢাকায় আসছেন আজ

শেয়ার করুন

বাংলাভূমি ডেস্ক ॥
সারাবিশ্বের ক্যাথলিক খ্রিষ্টান সম্প্রদায়ের সর্বোচ্চ ধর্মগুরু, ভ্যাটিকান সিটির রাষ্ট্রপ্রধান পোপ ফ্রান্সিস আজ বৃহস্পতিবার ঢাকায় পদার্পণ করছেন। শান্তি ও সম্প্রীতির বার্তাবাহক মহামান্য পোপকে বর্ণাঢ্য ও উষষ্ণ অভ্যর্থনা প্রদান করা হবে। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির ঐতিহ্যের দেশ বাংলাদেশে মহামান্য পোপকে সুস্বাগত।

২৬৬তম পোপকে আজ বেলা ৩টায় হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে স্বাগত জানাবেন রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আমন্ত্রণে রাষ্ট্রীয় সফরে আসছেন তিনি। পোপ আসছেন তিন দিনের সফরে।

তিরিশ বছর আগে ১৯৮৬ সালে পোপ দ্বিতীয় জন পল এবং ১৯৭০ সালে প্রলয়ঙ্করী উপকূলীয় সাইক্লোন-জলোচ্ছ্বাসের পটভূমিতে পোপ ষষ্ঠ পল এসেছিলেন বাংলাদেশে। পোপ ফ্রান্সিস এই ভূখণ্ডে তৃতীয় পোপ। বিমানবন্দর থেকে প্রথমেই পোপ যাবেন সাভারে জাতীয় স্মৃতিসৌধে এবং ধানমণ্ডির ৩২ নম্বরে বঙ্গবন্ধু স্মৃতি জাদুঘরে। তিনি জাতির পিতার প্রতিকৃতিতে পুষ্পস্তবক অর্পণ করবেন। তার সঙ্গে রয়েছেন বাংলাদেশে খ্রিষ্টান সম্প্রদায়ের ধর্মীয় গুরু কার্ডিনাল প্যাট্রিক ডি রোজারিও। শুক্রবার সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে খ্রিষ্টধর্মাবলম্বীদের সমাবেশে বক্তৃতা ছাড়াও একাধিক সমাবেশে বক্তব্য দেবেন পোপ। বৈঠক করবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে। পরিচালনা করবেন আন্তঃধর্মীয় প্রার্থনা সভা। এরই মধ্যে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে চিরায়ত বাংলার ঐতিহ্যের প্রতীক কুঁড়েঘরের আদলে ছনের তৈরি আসন স্থাপন করা হয়েছে। এ আসনে বসেই পোপ ফ্রান্সিস যাজকদের অভিষেক অনুষ্ঠান পরিচালনা করবেন, শান্তির বাণী শোনাবেন খ্রিষ্টান সম্প্রদায়ের ভক্তকুলসহ লাখো মানুষের উদ্দেশে।

পোপের ঢাকা সফর বিশ্ব প্রেক্ষাপটে অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। বিশ্বের যে কোনো দেশে পোপের সফরকে অত্যন্ত মর্যাদাসম্পন্ন বিবেচনা করা হয়। চলতি বছরসহ গত তিন বছরের মধ্যে তার তিনটি দেশ সফরের তালিকার একটি বাংলাদেশ। ঢাকা সফরে আসার আগে পোপ ফ্রান্সিস মিয়ানমার সফর করেছেন। রাখাইনে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর ভয়াবহ নিষ্ঠুরতা, গণহত্যায় প্রাণভয়ে রোহিঙ্গা সম্প্রদায়ের মানুষের বিপুল সংখ্যায় বাংলাদেশে পালিয়ে আসার ঘটনার প্রেক্ষাপটে ইয়াঙ্গুন ও নেপিদোতে পোপের সফর ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। মিয়ানমারের রাজনৈতিক-সামাজিক কঠোর বাস্তবতা ও স্পর্শকাতরতার কারণে পোপ ফ্রান্সিস সেখানে তার ভাষণে ‘রোহিঙ্গা’ শব্দটি উচ্চারণ করেননি। তবে তার ভাষণে মিয়ানমারের সব ধর্মসম্প্রদায়ের মানুষের ঐক্য ও সম্প্রীতির পথে সমাধানের কথা জোরালোভাবে বলেছেন। আগে ভ্যাটিকান থেকে দেওয়া বিবৃতিতে তিনি রোহিঙ্গা নির্যাতনের নিন্দা করেছেন এবং তাদের ‘ভাই ও বোন’ বলে উল্লেখ করেছেন। রাখাইনে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর গণনিষ্ঠুরতা শুরু হওয়ার পর থেকেই এর বিরুদ্ধে কঠোর নিন্দা জানিয়ে আসছেন পোপ ফ্রান্সিস। রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনে মিয়ানমার বাংলাদেশের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় চুক্তিতে সই করলেও রাখাইনে এখনও নির্যাতন বন্ধ হয়নি। ফলে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে মিয়ানমার সরকারের আন্তরিকতা নিয়ে সংশয় থেকেই গেছে। এ পরিস্থিতিতে পোপ ফ্রান্সিসের মিয়ানমার সফর বিশেষ তাৎপর্য বহন করছে বলেই বিশ্নেষকদের অভিমত।

বাংলাদেশে আসার আগে পোপ ফ্রান্সিস মিয়ানমার সফর করেছেন। তিনি সেখানে জাতিগত নির্যাতন বন্ধের আহ্বান জানালেও ‘রোহিঙ্গা’ শব্দটি উচ্চারণ করেননি। এ নিয়ে বিশ্বব্যাপী মানবাধিকার সংগঠনগুলোর সমালোচনার মুখে পড়েছেন পোপ। তবে এ দেশে এসে তিনি রোহিঙ্গা নির্যাতনের বিরুদ্ধে নিজের অবস্থান তুলে ধরবেন বলেই আশা করা হচ্ছে। তিনি রোহিঙ্গাদের একটি প্রতিনিধি দলের সঙ্গেও কথা বলবেন। কক্সবাজার থেকে আজই রোহিঙ্গাদের ১৮ জন প্রতিনিধিকে ঢাকায় নিয়ে আসা হচ্ছে বলে জেলা প্রশাসকের কার্যালয় নিশ্চিত করেছে। পোপের সঙ্গে তাদের দেখা হবে আগামীকাল শুক্রবার।

শান্তি ও সম্প্রীতির বাণীবাহক :পোপ ফ্রান্সিসের আগমন উপলক্ষে বাংলাদেশে ক্যাথলিক খ্রিষ্টান সম্প্রদায়ের সর্বোচ্চ ধর্মগুরু কার্ডিনাল প্যাট্রিক ডি রোজারিও বলেছেন, পোপের আগমন বাংলাদেশে বড় ঘটনা। তিনি সম্প্রীতি ও শান্তির বাহক হিসেবে আসবেন এবং ভালোবাসা দিয়ে মানুষকে সেবা করার আহ্বান জানাবেন। বাংলাদেশ ও ভ্যাটিকান সিটির মধ্যে বিরাজমান সুসম্পর্ক আরও সুদৃঢ় হবে জানিয়ে তিনি বলেন, বাংলাদেশকে যেন একটু বেশিই ভালোবাসেন পোপ। গত তিন বছরে তার মাত্র তিনটি সফরের তালিকা রয়েছে। তিনটির মধ্যে একটি বাংলাদেশ। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার এক বছরের মধ্যে ভ্যাটিকান সিটি ও বাংলাদেশের মধ্যে সুসম্পর্ক গড়ে ওঠে, যা এখনও বিদ্যমান রয়েছে। দু’দেশের সম্পর্ক যতটা না বাণিজ্যিক ও রাজনৈতিক, তার চেয়ে মানবতার সম্পর্কই বেশি দৃঢ়।

প্যাট্রিক ডি রোজারিও আরও বলেন, পোপ ফ্রান্সিস বিশ্বের প্রায় ১৩০ কোটি ক্যাথলিক সম্প্রদায়কে নেতৃত্ব দিয়ে থাকেন। শুধু খ্রিষ্টান সম্প্রদায়ের জন্য নয়, দেশের সব মানুষের জন্যই তিনি শান্তির বার্তা বয়ে আসবেন। তিনি যিশুখ্রিষ্টের দৃশ্যমান প্রতিনিধি, তিনি সবার। আপন ধর্মের মাধ্যমে তিনি সব ধর্মের মর্মমূলে প্রবেশ করেন। তিনি সার্বজনীন। তিনি কাজ করছেন বিশ্বশান্তির প্রতীক হিসেবে। সব মানুষের কথা বলেন তিনি। সব ধর্মের প্রতি তার রয়েছে অগাধ শ্রদ্ধা। শান্তি আর সম্প্রীতির মহান বাণী তিনি ছড়িয়ে দেবেন সবার মধ্যে। এ কারণেই পোপ ফ্রান্সিসের ঢাকা সফরের মূল প্রতিপাদ্য ‘সম্প্রীতি ও শান্তির সফর’।

এ সফরের উদ্দেশ্যে রোম ত্যাগের মুহূর্তে এক ভিডিওবার্তায় পোপ বলেন, ‘বাংলাদেশ সফরের প্রস্তুতির লগ্নে আমি দেশটির গোটা জনগোষ্ঠীকে শুভেচ্ছা ও বন্ধুত্বের বার্তা দিতে চাই। আমি এমন একটি মুহূর্তের জন্য অপেক্ষা করছি, যখন আমরা সবাই একত্র হব।’

বর্ণাঢ্য জীবন :ভ্যাটিকান সিটিতে খ্রিষ্টযাগ অনুষ্ঠানে ‘ফ্রান্সিস’ নামধারী প্রথম পোপ হিসেবে ২০১৩ সালের ১৩ মার্চ পোপ নির্বাচিত হন আর্জেন্টিনার কার্ডিনাল জর্জ মারিও বেরগোল্লিও। পোপ নির্বাচিত হওয়ার পর থেকেই তিনি পরিচিত হন পোপ ফ্রান্সিস নামে। তিনিই প্রথম ইউরোপের বাইরে দক্ষিণ গোলার্ধ এবং আমেরিকা অঞ্চলের মানুষ হিসেবে পোপ নির্বাচিত হন। তার অভিষেকের মধ্য দিয়েই ইউরোপ ঐতিহ্যের ‘জন পল’-এর পরিবর্তে দক্ষিণ আমেরিকার ঐতিহ্যের ‘ফ্রান্সিস’ নামে অভিহিত হয় পবিত্র পোপের নাম। তাকে বলা হয় প্রথম জেজুইট পোপও।

পোপ ফ্রান্সিস হিসেবে পরিচিত জর্জ মারিও বেরগোল্লিও ১৯৩৬ সালের ১৭ ডিসেম্বর আর্জেন্টিনার বুয়েন্স আয়ার্সে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা মারিও হোসে বেরগোল্লিও পেশায় রেল শ্রমিক ছিলেন আর মা রেজিনা মারিয়া সিভরি ছিলেন আদর্শ গৃহিণী।

১৯৫৮ সালের জর্জ মারিও বেরগোল্লিও (পরে পোপ ফ্রান্সিস) যিশু সংঘের সেমিনারিতে প্রবেশ করেন। ১৯৬৯ সালের ১৩ ডিসেম্বর তার যাজকীয় অভিষেক হয়। ১৯৭৩ থেকে ১৯৭৯ সাল পর্যন্ত তিনি আর্জেন্টিনার প্রদেশপাল হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৯২ সালে তিনি বুয়েন্স আয়ার্সের সহকারী বিশপ হিসেবে যোগ দেন। ১৯৯৮ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি বুয়েন্স আয়ার্সের আর্চডায়োসিসের আর্চবিশপ হিসেবে অভিষিক্ত হন। ২০০১ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি পোপ দ্বিতীয় জন পল তাকে কার্ডিনাল পদে উন্নীত করেন। ২০১৩ সালের ১৩ মার্চ তিনি পোপ হিসেবে অভিষিক্ত হন। ‘ফ্রান্সিস’ নামধারী প্রথম পোপ হিসেবে তিনি ‘পোপ ফ্রান্সিস’ নামেই পরিচিত হন বিশ্বজুড়ে।

ঢাকায় কর্মসূচি :আজ ঢাকায় পৌঁছার পর বিকেল ৪টায় পোপ ফ্রান্সিস সাভারে জাতীয় স্মৃতিসৌধ পরিদর্শনে যাবেন। বিকেল পৌনে ৫টায় তিনি বঙ্গবন্ধু স্মৃতি জাদুঘরে জাতির জনকের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করবেন। সন্ধ্যা সাড়ে ৫টায় বঙ্গভবনে রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদের সঙ্গে সাক্ষাৎ এবং ৬টায় বঙ্গভবনে রাষ্ট্রের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ, সুশীল সমাজ ও ঢাকায় কর্মরত মহলের সঙ্গে সাক্ষাৎ করবেন পোপ। এখানে তার সম্মানে রাষ্ট্রপতির নৈশভোজে অংশ নেবেন।

১ ডিসেম্বর সকাল ১০টায় তিনি রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে খ্রিষ্টধর্মীয় উপাসনা এবং যাজক অভিষেক অনুষ্ঠানে অংশ নেবেন। ওই দিন দুপুর সোয়া ২টায় তিনি ভ্যাটিকান দূতাবাসে যাবেন। সেখানেই তিনি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে সাক্ষাৎ করবেন। দূতাবাস থেকে ফিরে বিকেল ৪টায় রমনার প্রবীণ যাজক ভবনে বাংলাদেশের বিশপদের বিশেষ সভায় বক্তব্য দেবেন পোপ। বিকেল ৫টায় আর্চবিশপ হাউসের মাঠে শান্তির জন্য আন্তঃধর্মীয় ও আন্তঃমাণ্ডলিক সমাবেশেও বক্তব্য দেবেন তিনি।

২ ডিসেম্বর পোপ ফ্রান্সিস তেজগাঁও মাদার তেরেসা ভবন, তেজগাঁও কবরস্থান, পুরাতন গির্জা পরিদর্শন এবং সবশেষে নটর ডেম কলেজে যুব সমাবেশে বক্তব্য দেবেন। তিন দিনের সফর শেষে ২ ডিসেম্বর বিকেল ৫টায় রোমের উদ্দেশে ঢাকা ত্যাগ করবেন পোপ ফ্রান্সিস। সূত্র: সমকাল।