শনিবার , ২০শে এপ্রিল, ২০২৪ , ৭ই বৈশাখ, ১৪৩১ , ১০ই শাওয়াল, ১৪৪৫

হোম > Uncategorized > তোমার ঘরে বসত করে কয় জনা

তোমার ঘরে বসত করে কয় জনা

শেয়ার করুন

বাংলাভূমি২৪ ডেস্ক ॥

‘তোমার ঘরে বাস করে কারা ও মন জানোনা

তোমার ঘরে বসত করে কয় জনা
একজনে ছবি আঁকে এক মনে, ও মন
আরেকজনে বসে বসে রঙ মাখে
আবার সেই ছবিখান নষ্ট করে কোন জনা কোন জনা’
একজন মানুষের ভেতরে কি একইসাথে একের অধিক মানুষ বাস করতে পারে? নাকি প্রতিটি মানুষই শুধু একটি সত্ত্বা? তার ভেতরে সে ছাড়া আর কেউ বাস করেনা। বাংলাদেশের বিখ্যাত লোকগীতির গানের লাইনে কিন্তু মানুষের ভেতরে একইসাথে অনেক মানুষের বসবাসের ইঙ্গিত রয়েছে। কিন্তু দর্শন যাই বলুক না কেন, এক্ষেত্রে বিজ্ঞান কি বলে?

একটা সময় ছিল যখন মানুষের জন্ম বা উৎস বোঝাটা খুব স্বাভাবিক একটা বিষয় ছিল। যে কেউ সহজেই বলে দিত- একদা তার বাবা এবং মার মধ্যে দেখা হয়েছিল, তারা ভালোবেসেছিল এবং তারপর একসময় চিৎকার করে কাঁদতে কাঁদতে পৃথিবীতে এসে হাজির হয়েছিল সে। সেই কারণে তার ৫০ ভাগ হচ্ছে বাবা, আর ৫০ ভাগ মা। দুটো মিলেমিশে ১০০ ভাগ হচ্ছে সে সম্পূর্ণ নিজে।

তবে এই অতি সাধারণ গল্প এখন আর মোটেও সাধারণ নেই। গল্প এখন জটিল। মানুষ আসলে তার বাবা-মার কাছ থেকে পাওয়া জিনের পাশাপাশি বহুবিধ ভাইরাস এবং ব্যাকটেরিয়ার মিলিত একটি শিল্পকর্ম। কার্যত তার ভেতরে রয়েছে অন্য মানুষের মিশেল। অবশ্য কেউ যদি যমজ হয় তারমানে তার শরীরে কিংবা মস্তিষ্কে যমজ ভাই কিংবা বোনের কিছু অংশ উপস্থিত রয়েছে। মজার বিষয় হচ্ছে, এই মিশ্রিত অংশগুলো কিন্তু মানুষের কর্মকাণ্ডকে প্রভাবিত করে।

ইটালির পাদোয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞানী অধ্যাপক পিটার ক্রেমার বলেন, ‘মানুষ একক কোনো ব্যক্তিসত্ত্বা নয়। সে আসলে অনেক জৈবদেহের সমন্বয়ে সৃষ্ট জীব বা সুপার অর্গানিসম। একইসাথে বিপুল সংখ্যক ভিন্ন ধরনের মানুষ এবং অ-মানুষ আমাদের অভ্যন্তরে সংগ্রাম করছে অবিরত। এরা সবাই নিয়ন্ত্রণ হাতে চায়।’ মনোবিজ্ঞানী পিটার এবং পাওলা ব্রেসান একত্রে এই বিষয়ে একটি মনস্তাত্ত্বিক গবেষণা প্রকাশ করেছেন ‘পারসপেকটিভ’ জার্নালে। একজন মানুষের ভেতরে যে একের অধিক মানুষের বাস এবং কিভাবে তারা মানুষের ব্যবহারকে প্রভাবিত করে সেটাই এই গবেষণার মূল বিষয়।

ঃড়ি-রহ-ড়হব-২বিষয়টা উদ্বেগের হলেও, আমাদের শরীর যে বিভিন্ন ধরনের জৈবদেহের একটা মিশ্রণ সেটা অনেক আগে থেকেই বিজ্ঞানীরা জানেন। মানুষের শরীরের অন্ত্রে যে সমস্ত অতিক্ষুদ্র জীবকোষ বসবাস করে তারা যে ধরনের নিউরোট্রান্সমিটার (স্নায়ু অনুপ্রেরক) তৈরি করে সেটা আমাদের মনের গতিধারা পরিবর্তন করে দিতে পারে। অনেক বিজ্ঞানী বলেছেন, এই অতি ক্ষুদ্র জীবকোষ আমাদের ক্ষুধা বোধকেও আন্দোলিত করে যাতে আমরা খাবারের জন্য আকুলতা বোধ করি। এমনকি টক্সোপ্লাসমা গণ্ডী নামের একটি এককোষী জীবাণু যদি আমাদের অন্ত্রে সংক্রমণ ঘটায় তাহলে আমাদের মৃত্যু পর্যন্ত ঘটতে পারে। প্রকৃতিতে টক্সোপ্লাসমা গণ্ডী নামের এই জীব কোষের কার্যক্রম কিন্তু অদ্ভুত। যেমন ইদুর প্রকৃতিগতভাবেই বিড়াল ভয় পায়। কিন্তু এই জীবাণু ইদুরের মনের বেড়াল ভীতি নষ্ট করে দিতে পারে। অর্থাৎ বিড়ালের প্রতি ইদুরের চিরায়ত আচরণ পরিবর্তন করার ক্ষমতা এই জীবকোষের রয়েছে এবং এই পরিবর্তন স্থায়ী। এতে করে টক্সোপ্লাসমা বংশবিস্তারের আরও ভালো জায়গা পেয়েছে কারণ ইদুর চলে আসছে বিড়ালের সংস্পর্শে। কিন্তু মানুষও এই জীবাণুতে একইভাবে সংক্রমিত হতে পারে। সংক্রমণের পরে তাদের মানসিক গঠনে বড় ধরনের পরিবর্তন ঘটতে পারে। যেমন, এটা মানুষের ভেতরে আত্মঘাতী বিষণ্ণতা এবং স্কিজোফ্রেনিয়া নামের মানসিক রোগের ঝুঁকি বাড়িয়ে তোলে। অথচ এই ঝুঁকি সত্ত্বেও বর্তমানে ব্রিটিশ বাজারে যত খাওয়ার মাংস রয়েছে তার এক তৃতীয়াংশই এই জীবাণু বহন করছে।

কাজেই দেখা যাচ্ছে আমাদের ভেতরে এমন কিছু জৈব কোষের বাস রয়েছে যারা আমাদের চিন্তা-চেতনা পরিবর্তন করে দিতে পারে। আমাদের কার্যক্রম পুরোপুরি আমাদের উপর নির্ভর করে নেই। এটা আমাদের ব্যাক্তি স্বত্বা এবং পরিচয় নিয়ে একটা প্রশ্ন তোলে। সেই প্রশ্ন আরও ভীতিকর আকার ধারণ করে যদি আমার অনুধাবন করি যে, আমাদের মস্তিষ্ক শুধু ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র জীব কোষ দ্বারাই অনুপ্রবেশের শিকার হয়না, অন্য মানুষও আমাদের মস্তিষ্কে অনুপ্রবেশ করে।

ঃড়ি-রহ-ড়হব-৩ক্রেমার বলেন, এর সবচেয়ে প্রত্যক্ষ উদাহরণ হতে পারে শারিরিকভাবে সংযুক্ত যমজদের ক্ষেত্রে যারা একই মস্তিষ্ক ভাগভাগি করে বেঁচে আছে। এমনকি স্বাভাবিক যমজ ভাইবোনও একই ধরনের অঙ্গ প্রত্যঙ্গ নিয়ে বেঁচে থাকে কিন্তু বুঝতে পারেনা। সাম্প্রতিক গবেষণায় দেখা গেছে, যমজদের শরীরে ভিন্ন ধরনের কোষ স্থানান্তরিত হয়। একটা সময় এটা ছিল বিরল একটা চিন্তা, কিন্তু এখন আমরা জানছি এটা আশ্চর্যজনকভাবে সাধারণ। ভিন্ন দেখতে প্রায় ৮ ভাগ যমজ(নন-আইডেনটিক্যাল টুইনস) এবং ২১ ভাগ ত্রয়ীর (ট্রিপলেটস) শরীরে একটা নয়, দুটো রক্তের গ্রুপ থাকে : একটা তাদের নিজেদের কোষ থেকে উৎপন্ন হয়, আরেকটি তাদের যমজ থেকে পাওয়া ‘ভিনদেশী’ কোষ থেকে উৎপন্ন হয়। অন্য কথায় বলতে গেলে তারা দুই শরীরের সংমিশ্রণে তৈরি এক ধরনের কাল্পনিক মানুষ। এই সংমিশ্রণ যে কোনো অঙ্গ প্রত্যঙ্গের ক্ষেত্রেই হতে পারে, এমনকি মস্তিস্কও।

এই ধরনের একীভূত মস্তিষ্ক থাকার পরিণতি মারাত্মক হতে পারে। যেমন, আমরা জানি যে মস্তিষ্কের বিভিন্ন অংশের বিন্যাস এর কার্যক্রমে ভূমিকা রাখে। কিন্তু যদি সেখানে অন্য কোষের উপস্থিতি থাকে তাহলে সেটা মস্তিষ্কের জটিল নকশাকে ছত্রভঙ্গ করে দিতে পারে। এটা থেকে বোঝা যায়, যমজদের ডানহাতি হওয়ার সম্ভাবনা কেন কম? ডানহাতি কিংবা বামহাতি হওয়ার ব্যাপারটা নির্ভর করে মস্তিষ্কের ডান এবং বাম অংশের আপেক্ষিক সংহতির উপরে। সম্ভাবনা রয়েছে যে, যমজদের মস্তিষ্কের সংমিশ্রণের ফলে এই ভারসাম্য বাধাগ্রস্থ হয়।

যমজদের এ ধরনের মিল বাদ দিলে অন্যভাবেও ভিন্ন মানুষের দেহ কোষ দ্বারা আক্রান্ত হতে পারে মানুষ। যেমন, এরকম হতে পারে যে, মাতৃগর্ভে দুটো ভ্রূণ ছিল, কিন্তু এই দুই ভ্রূণ পরিণত হওয়ার প্রাথমিক পর্যায়ে যুক্ত হয়ে পড়েছে। যেহেতু এটা মানব দেহ গঠনের প্রাথমিক পর্যায়ে ঘটেছে সেহেতু কোষগুলো দেহকলার সাথে এমনভাবে মিশে যেতে পারে যে তারা হয়তো স্বাভাবিক ভাবেই বেড়ে উঠবে কিন্তু শরীরে অন্য মানুষের জিনগত নকশা ঠিকই থেকে যাবে। অর্থাৎ তারা দেখতে হবে একজনের মত, কিন্তু শরীরে থাকবে অন্য একজনের কোষ। এরকম কোনো নারী যদি গর্ভধারণ করে তখন তার সন্তানের মধ্যে সেই ভিন্ন কোষ চলে যাবে। সেই কোষ হয়তো এসেছিল মায়ের কোনো ভাই বোনের থেকে। গর্ভধারনের আগ পর্যন্ত তার ভেতরে সেটা ছিল, কিন্তু সন্তান জন্ম দেয়ার সময় সেটা চলে গেছে সন্তানের ভেতর। সেক্ষেত্রে জৈবক্রমে সন্তানের মা আসলে তিনি নন। বিপরিতক্রমে সন্তানের কোন দেহ কোষও থেকে যেতে পারে মায়ের শরীরে এবং সেটা পরবর্তী সন্তান জন্মের সময় স্থানান্তরিত হতে পারে। এরকম ব্যাতিক্রম ঘটনার প্রমাণও রয়েছে।

ওয়াশিংটন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক লি নেলসন বলেন, এরকম যদি ঘটে তাহলে অন্য মানুষের শরীর কোষ দিয়ে মস্তিষ্কের গঠন হতে পারে অনাকাঙ্ক্ষিত ভাবে। মায়ের শরীর কোষ কী শিশুর মস্তিষ্কে রোপণ করা যায় কিনা সেটা নিয়ে বর্তমানে তিনি পরীক্ষা নিরীক্ষা করছেন। তিনি বলেন, ‘কোষের পরিমাণের তফাৎ, কোষের ধরণ কিংবা শিশুর শরীর গঠনের সময়ের উপরে ভিত্তি করে মানব দেহে অনেক ধরনের অসঙ্গতি তৈরি হতে পারে।’

ঃড়ি-রহ-ড়হব-৪নেলসন তার গবেষণায় দেখেছেন, এমনকি একজন পূর্ণবয়স্ক মানুষও অন্য মানুষের দেহ কোষ প্রতিরোধ করতে পারে না। তিনি এবং তার আরেক সহকারী উইলিয়াম চ্যান মিলে একজন নারীর মস্তিষ্কের কোষের কিছু অংশ নিয়ে পরীক্ষা করেন এবং ঐ কোষের জিনোমে তারা পুরুষের ণ ক্রোমসমের সন্ধান করেন। এতে দেখা যায় প্রায় ৬৩ ভাগ কোষে পুরুষের ডিএনএ উপস্থিতি রয়েছে। তিনি বলেন, ‘ঐ নারীর মস্তিষ্কের একটি নির্দিষ্ট অংশের সাধারণ নিরীক্ষণ থেকে আমরা পুরুষের ডিএনএ উপস্থিতি পেয়েছি। শুধু তাই না, মস্তিষ্কের অন্যান্য অংশেও আমরা এটা পেয়েছি।’ অন্য কথায় বলতে গেলে মস্তিষ্ক বোঝাই হয়ে ছিল কোনো পুরুষের কোষে। এর একটা যুক্তিযুক্ত ব্যাখ্যা হতে পারে যে, এই ডিএনএগুলো এসেছে কোনো শিশুর শরীর থেকে। হয়তো তার ছেলের শরীরের কোনো কোষ নাড়ি বেয়ে উঠে এসেছে তার শরীরে এবং জমা হয়েছে মস্তিষ্কে। অনেক গবেষক এও চিন্তা করছেন যে, গর্ভাবস্থায় এই জাতীয় কোষই কী মায়ের মনোজগতে প্রভাব ফেলে কিনা।

একথা স্বীকার না করে উপায় নেই যে, বহু কোষের সমন্বয়ে তৈরি এই জটিল মানব দেহের উপরে আমাদের যে জ্ঞান সেটা নেহায়েতই অল্প। অনেক গবেষণাই এখনো শিশুতুল্য অবস্থায় রয়েছে। এই মুহূর্তে এগুলোকে তত্ত্ব ছাড়া আর কিছু বলা যাবে না। মনোবিজ্ঞানী ক্রেমার বলেন, ‘মানুষের সার্বিক মনোজগত বুঝতে হলে শুধুমাত্র একজন বা দুইজন মানুষকে বিবেচনা করে বোঝা সম্ভব না। পুরোটা বুঝতে হলে আমাদেরকে গোটা ব্যাপারটা আগে জানতে হবে। অনেক কিছুই এখনো অজানা।’ বিজ্ঞানীরা অনেক সময় একজোড়া যমজদের উপরে তুলনামূলক গবেষণা করেন তাদের আচরণের সামঞ্জস্যতার কারণ খুঁজতে। অথচ ভিন্ন ধরনের যমজরাও (নন-আইডেনটিক্যাল) যদি মস্তিষ্কের কিছু কোষ নিজেদের মধ্যে ভাগাভাগি করে থাকে, তাহলে গবেষণার ফলাফল ভুল হবে। সার্বিকভাবে চিন্তা করলে আমাদের ভেতরে এই ভিনদেশী কোষের অনুপ্রবেশকে বাধা দেয়া ঠিক হবে না। কারণ কোষের এই সংমিশ্রণই আমাদের সম্মিলিত স্বকীয়তা প্রদান করেছে। সেটা খারাপ ভালো যাই হোক না কেন। ভেতরে অনেক মানুষ নিয়েই আমরা মানুষ হয়েছি। আমাদের একেকটি কোষ হয়তো একেক সময় একেক কথা বলে। এতো কথা বলে বলেই হয়তো আমরা মানুষ, জীব জগতের আর কোনো জীবের মত না। কিন্তু আরও মজার বিষয় হচ্ছে আমরা জানিনা আমাদের ভেতরে ঠিক কারা বাস করে। আমাদের লোকগীতিতে যে বলা হয়েছে- তোমার ঘরে বসত করে কয় জনা, তুমি জানো না- সেটা হয়তো যেকোনো কিছুই বোঝাতে পারে কিন্তু এক্ষেত্রে আমরা আসলেই জানিনা আমাদের ঘরে আসলে কারা বাস করে।