শনিবার , ২০শে এপ্রিল, ২০২৪ , ৭ই বৈশাখ, ১৪৩১ , ১০ই শাওয়াল, ১৪৪৫

হোম > শীর্ষ খবর > দুই বছরে ২ কোটি ৯০ লাখের বেশি ইয়াবা জব্দ > বাংলাদেশে ইয়াবার অন্ধকার অধ্যায়

দুই বছরে ২ কোটি ৯০ লাখের বেশি ইয়াবা জব্দ > বাংলাদেশে ইয়াবার অন্ধকার অধ্যায়

শেয়ার করুন

বাংলাভূমি ডেস্ক ॥
২০০৬ সালে বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকায় প্রথমবারের মতো ইয়াবা হিসেবে পরিচিত রঙিন ট্যাবলেটটি আসে। সে সময় ট্যাবলেটটি সেবনকারী ছিলো ধনী লোকের সন্তানরা। আর এখন ইয়াবা সর্বত্র ছড়িয়ে পড়েছে।

মেটামফেটামিন ও ক্যাফেইন দিয়ে তৈরি হয় ইয়াবা। লজেন্সের মতো দেখতে ট্যাবলেটগুলো বিভিন্ন ফ্লেভার ও উজ্জ্বল রঙের হয়। ব্যবহাকারী সাধারণত অ্যালুমিনিয়ামের ফয়েল পেপারে রেখে ট্যাবলেটটি জ্বালিয়ে ধোঁয়া নেয়। কেউ কেউ আবার ট্যাবলেটটিকে গুঁড়ো করে নাক দিয়ে শ্বাস নেয়।

মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) একের পর এক পাচারকারীকে ধরছে। বাহিনীটি গত বছর দুই কোটি ৯০ লাখের বেশি ইয়াবা ট্যাবলেট জব্দ করেছে। ২০১০ সালের তুলনায় গত বছর জব্দ করা ইয়াবার এই সংখ্যা ৩৫ গুণেরও বেশি।

জাতিসংঘের অপরাধ ও নেশাবিষয়ক দপ্তর ইউএনওডিসির ২০১৫ সালের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘মেকং নদীর আশপাশের অঞ্চল (মেকং সাব-রেজিওন) এবং পূর্ব ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বিভিন্ন দেশে জব্দ হওয়া মেটামফেটামিন ট্যাবলেটগুলোর প্রধান উৎপত্তিস্থল হিসেবেই মিয়ানমারকেই ধরা হয়।’

ওই প্রতিবেদনে আরো বলা হয়, ২০১৩ সালে চীনে জব্দ হওয়া ৯০ শতাংশ ইয়াবা ট্যাবলেট মিয়ানমারে তৈরি।

বেসরকারি সংস্থা ন্যাশনাল গোলস টু বি অবটেইনড অ্যান্ড রিটেইনডেড (এনওএনজিওআর)-এর হয়ে মিয়ানমারের সীমান্তসংলগ্ন এলাকায় কক্সবাজারে একটি মাদক নিরাময় কেন্দ্র চালান দিদারুল আলম রাশেদ। সেখানে ২৪ জনের মতো মাদকসেবীর চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। ইয়াবাসেবী বাড়ার বিষয়টি খুব কাছ থেকে দেখেছেন তিনি।

ইয়াবার আগে লোকজন গাঁজা ও হেরোইন সেবন করত জানিয়ে রাশেদ বলেন, ‘২০০২ সালে আমরা একটি অনানুষ্ঠানিক জরিপ করে দেখেছি, জেলাটিতে (কক্সবাজারে) ২০ হাজার লোক মাদকাসক্ত। কিন্তু তাঁদের কেউই ইয়াবাসেবী নন।’

‘কিন্তু ২০০৭ সাল ও এর পর থেকে সর্বত্র ইয়াবায় সয়লাব হয়ে গেছে। ২০১৬ সালে আমরা জরিপ করে দেখেছি, ৮০ হাজার লোক মাদকসেবী, যাদের প্রায় ৮০ শতাংশ ইয়াবা সেবন করে।’

রাশেদ বলেন, ‘ইয়াবা আমাদের তরুণদের ধ্বংস করে দিচ্ছে।’

২০১৩ সালে ১৭ বছর বয়সী কিশোরী ঐশী রহমান ইয়াবায় আসক্ত ছিল। আদরের সন্তানকে নিয়ে চিন্তিত ছিল মা-বাবা এবং তাঁরা তার (ঐশী) ফোনটি কেড়ে নিয়ে ঢাকার ফ্ল্যাটে আটকে রেখেছিল। এতে ক্ষুব্ধ ঐশী মা-বাবার কফির কাপে ঘুমের ওষুধ মিশিয়ে দেয়। এর পর ঘুমে এলে পড়েন বাবা-মা। পরে একটি ছুরি নিয়ে আঘাত করে দুজনকেই হত্যা করে সে।

মা-বাবাকে হত্যার সময় ছোট ভাইকে শৌচাগারে আটকে রাখে ঐশী। পরে তাকে ওই বাসা থেকে নিয়ে যেতে এক বন্ধুকে কল দেয়। পরবর্তী সময়ে সে পুলিশের কাছে ধরা দেয় এবং দোষ স্বীকার করে বলে জানা যায়। ২০১৫ সালের নভেম্বরে ঐশীকে মৃত্যুদণ্ডাদেশ দেন নিম্ন আদালত। রায়ে আদালত বলেন, ঐশী তার মা-বাবাকে ‘পরিকল্পিতভাবে হত্যা করেছে’। এই রায়ের সময় ঐশীর বয়স ছিল ১৯ বছর।

চলতি বছরের জুনে বয়স ও মানসিক স্বাস্থ্যের বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে ঢাকার উচ্চ আদালত মৃত্যুদণ্ডাদেশ কমিয়ে ঐশীকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডাদেশ দেন। ঐশীর এ ঘটনায় বাংলাদেশে তরুণদের মধ্যে ইয়াবা আসক্তি নিয়ে তোলপাড় শুরু হয়। অনেকেই ঐশীর এই মানসিক বিকৃতির জন্য ইয়াবাকে দায়ী করেন।

জাতীয় মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের ২০১৪ সালের বার্ষিক প্রতিবেদনে বলা হয়, ৮৮ শতাংশ মাদকসেবীর বয়স ৪০ ব্ছরের নিচে। সিলেট শহরে চলতি বছরের একটি গবেষণায় দেখা গেছে, ৫৫ শতাংশ মাদকসেবীর বয়স ২২ থেকে ২৯ বছর।

ইয়াবা ট্যাবলেটে সাধারণত মেটামফেটামিন, ক্যাফেইন ও আরো কিছু উপাদান থাকে। এই ট্যাবলেট সেবনের পর শারীরিক শক্তি দ্রুত বেড়ে যায় বলে মনে হয়। এ বিষয়ে একজন ইয়াবা আসক্ত রাফি বলেন, ‘এতে ভ্যানিলার ফ্লেভার আছে এবং এর ধোঁয়ার যে কী তৃপ্তি, তা বলে বোঝাতে পারব না।’

‘প্রথমে আমার বুকে এক ধরনের উষ্ণতা অনুভব করবেন। এর পর শারীরিক শক্তি বাড়া শুরু হবে।’

ঢাকার একটি ডিজে পার্টিতে গিয়ে প্রথমবারের মতো ইয়াবা নেওয়া শুরু করেন রাফি। সেখানে পুরো রাত কাটান তিনি। নেশার ঘোর বাড়তে থাকলে সমাজ নিয়ে চিন্তাভাবনা বাদ দিয়ে বন্ধুদের সঙ্গে উন্মাতাল হয়ে ছুটতে থাকেন ইয়াবার নেশায়।

প্রচণ্ড নেশাগ্রস্ত একটি দিনের কথা স্মরণ করে রাফি জানান, তিনি দিনে সর্বোচ্চ চারটি পর্যন্ত শক্তিশালী এই ট্যাবলেট সেবন করেছেন।

‘মাত্র কয়েক ঘণ্টা জোর করে ঘুমিয়ে আমি সকাল ৯টা কিংবা ১০টায় ঘুম থেকে উঠতাম। এর পর ইয়াবা সেবন করে কাজে ছুটতাম এবং অনেক দেরি করে ফিরতাম’, বলেন রাফি।

‘কাজ শেষে আমি বন্ধুকে কল করতাম এবং সন্ধ্যা ৬টার দিকে তাঁর বাড়িতে যেতাম। একজন এসে ইয়াবা দিয়ে যেত এবং আমরা তখন এর ধোঁয়া নিতাম এবং প্লে স্টেশনে এক বসায় ২০ থেকে ৩০ বার ফিফার গেম খেলতাম।’

‘টানা দুই থেকে তিন বছর, প্রতিদিনই ছিল একই রুটিন।’

কক্সবাজারে এনওএনজিওআর নামক সংস্থার মাদক নিরাময় কেন্দ্রে চিকিৎসা নিয়েছেন কাশেম (যিনি নামের শেষের অংশ বলেননি) নামের একজন। তিনি এখন আর নেশাগ্রস্ত নন।

৩৭ বছর বয়সী এই যুবক যৌবনের দিনগুলো কীভাবে বদলে গেল, তার বর্ণনা দিচ্ছিলেন।

কাশেম বলেন, ‘১৯৯০-এর দশকে আমাদের দেশে শুধু হেরোইন কিংবা গাঁজা ছিল।’

‘আমার জানামতে, ৫ থেকে ১০ শতাংশ লোকজন মাদক নিত। কিন্তু এখন তরুণদের অর্ধেকই ইয়াবাসেবী।’

কাশেম বলেন, ‘নতুন কোনো মাদক এলেই সবাই তা সেবনে হুমড়ি খেয়ে পড়ে।’

‘তুলনামূলকভাবে হেরোইন কম ক্ষতিকর ছিল। কারণ, এটি আপনাকে দুর্বল করে দিত। কিন্তু ইয়াবা রক্ত গরম করে ফেলে এবং শরীরকে সিংহের মতো তেজি করে।’

এ মুহূর্তে নিজের সন্তানের ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তিত কাশেম। স্কুল শেষ করা বড় ছেলেকে তিনি সৌদি আরবে পাঠাচ্ছেন, যেখানে মাদক পাওয়া দুষ্কর।

‘আমি চাই না, সে আমার মতো ধ্বংস হয়ে যাক’, বলেন কাশেম।

আমাদের সময়.কম