শুক্রবার , ১৯শে এপ্রিল, ২০২৪ , ৬ই বৈশাখ, ১৪৩১ , ৯ই শাওয়াল, ১৪৪৫

হোম > জাতীয় > দুর্নীতিজাল রোধিবে কে

দুর্নীতিজাল রোধিবে কে

শেয়ার করুন

স্টাফ রিপোর্টার ॥
ঢাকা: রাজপথে আইনশৃঙ্খলা রাকারী বাহিনীর চাঁদাবাজির সংবাদ সম্প্রতি অনলাইন পত্রিকা ও খবরের কাগজগুলোর শিরোনাম হয়েছে। দুর্নীতি কি কেবল পথে-ঘাটে? অফিসে-আদালতে, থানায়-বন্দরে, পাহাড়ে-সমুদ্রে সবখানে বাংলাদেশের মানুষকে দুর্নীতির শিকার হতে হচ্ছে। দণি এশিয়ার অন্য সব দেশের মতো বাংলাদেশও যেন দুর্নীতির এক অন্ধ গুহায় আটকা পড়েছে। এ থেকে যেন রা নেই।

প্রতিবেশী দেশ ভারতে ক্রমে ছড়িয়ে পড়া দুর্নীতিজাল নিয়ে সম্প্রতি দেশটি থেকে প্রকাশিত ‘ইন্ডিয়া টুডে’ সাময়িকী বিশেষ প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, ভারতের শহুরে মানুষেরা প্রতিবছর ছয় লাখ কোটি রুপিরও (প্রায় আট লাখ কোটি টাকা) বেশি অর্থ ঘুষ দেয়।

১৯৮৬ সালে বোফোর্স কেলেঙ্কারি নিয়ে ব্যাপক তোলপাড় হয়েছিল ভারতে। সুইজারল্যান্ডের অস্ত্রপ্রতিষ্ঠান বোফর্স ফরমাশ পেতে ভারতের তত্কালীন কংগ্রেস সরকারের মন্ত্রীদের ৬৪ কোটি রুপি ঘুষ দিয়েছিল। ২০১২ সালে দেশটির শহুরে মানুষদের দেওয়া ঘুষের পরিমাণ বোফর্স কেলেঙ্কারিতে লেনদেন হওয়া ঘুষের চেয়ে নয় হাজার ৮৩৮ গুণ বড়। দুর্নীতির বিরুদ্ধে দেশটিতে আন্দোলন-বিােভ যত বেশি চলছে, দুর্নীতি যেন সেসবের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে আরও বেশি বাড়ছে।

‘ইন্ডিয়া টুডের’ প্রতিবেদনে দাবি করা হয়, ভারত এখন কার্যত একটি ‘ঘুষ প্রজাতন্ত্রে’ পরিণত হয়েছে। সম্প্রতি ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের বৈশ্বিক দুর্নীতি প্রতিবেদন ২০১৩-তে বলা হয়েছে, ‘ভারতে দুর্নীতি একটি শিল্পকলায় পরিণত হয়েছে।’ দেশটির বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে কাজ করতে গিয়ে প্রতি দুজনের একজন ঘুষ দেন।

আই পেইড আ ব্রাইব (আমি ঘুষ দিই) নামের একটি সংস্থা ভারতের শহুরে লোকেদের মধ্যে দুর্নীতির চল পরিমাপ করতে শুরু করেছে। এ সংস্থাটির একটি অনলাইন ডেটাবেজ আছে। যাঁরা ঘুষ দিচ্ছেন, তাঁরা আই পেইড আ ব্রাইবের অনলাইনে ঢুকে সেখানে নিজেদের কাজের বিবরণ দিতে পারেন।

সংস্থাটি বলছে, গত তিন বছরে ভারতের ৫৪৪টি শহরের ২৩ হাজার ৯১ জন নাগরিক ১৮৬ কোটি ৫৭ লাখ ২০ হাজার ৬৪২ রুপি ঘুষ দিয়েছেন। এর অর্থ হলো, প্রত্যেক ভারতীয় প্রতিবছর গড়ে ২৬ হাজার ৯৩২ রুপি ঘুষ দেন।

ভারতের সবচেয়ে বেশি মানুষ ঘুষ দেয় পুলিশকে। এ েেত্র পাসপোর্ট যাচাইবাছাই ও ট্রাফিক আইন ভঙ্গের অভিযোগই প্রধান।

আই পেইড আ ব্রাইব বলছে, ভারতে সরকারি চাকরি পেতে কমপে এক লাখ, গাড়ি চালানোর লাইসেন্স পেতে কমপে ৬০০, বিয়ের সনদ পেতে চার থেকে পাঁচ হাজার, পাসপোর্ট নতুন করতে ২০০ থেকে ১০ হাজার, সম্পত্তি রেজিস্ট্রেশনের জন্য কমপে পাঁচ হাজার, গ্যাস-সংযোগ পেতে ৫০০ থেকে এক হাজার, শিশুদের স্কুলে ভর্তি করাতে ২০ হাজার থেকে এক লাখ রুপি ঘুষ দিতে হয়।

‘টাইমস অব ইন্ডিয়ার’ প্রতিবেদনে দাবি করা হয়, সবাই যে অযোগ্য বলে ঘুষ দেয়, তা নয়। কেউ দিচ্ছে কাজের গতি বাড়াতে, কেউ সম্ভাব্য ঝামেলা এড়াতে, কেউ যথাযথ উপায়ে সেবা পেতে। ঘুষ দিচ্ছেন তো সব ঠিক, না হলে বাড়তি ঝামেলা। আবার অনেকে বাধ্য হচ্ছেন।

চেন্নাইয়ের ৩৬ বছর বয়সী নারী স্থপতি শশীরেখা বলেন, শহরের বাড়ি তৈরির জন্য তিনি পঞ্চায়েত-প্রধানের কার্যালয়ে অনুমতি চাইতে গিয়েছিলেন। তাঁর বাড়িটি ছিল সরকার অনুমোদিত একটি প্রকল্পের অধীনে। সেখানে পঞ্চায়েত-প্রধানের অনুমতি পাওয়ার বিষয়টি ছিল আনুষ্ঠানিকতা মাত্র। অথচ পঞ্চায়েত-প্রধান তাঁদের কাছে ঘুষ দাবি করে বসেন। শশীরেখা বলেন, ‘তিনি আমাদের এ বলে হুমকি দেন যে, যদি আমরা তাঁকে ঘুষ না দিই, তবে তিনি আমাদের প্রকল্পের কাজ বন্ধ করে দেবেন।’

ব্যাঙ্গালুরুর ব্যবসায়ী ইস্কান্দার মির্জার ভাষ্য, তিনি একটি রেস্তোরাঁ কিনেছিলেন। কিন্তু সেটি চালু করার জন্য নতুন করে কর্তৃপরে কাছ থেকে অনুমতি নেওয়ার প্রয়োজন ছিল। যখন তিনি অনুমতি চান, তখন তাঁর কাছ থেকে এক লাখ পাঁচ হাজার রুপি ঘুষ চাওয়া হয়। তিনি বলেন, ‘তিনি (সরকারি কর্মকর্তা) জানতেন, আমি ততদিনে ৩৫ লাখ রুপি বিনিয়োগ করে ফেলেছি। সেখান থেকে ফিরে আসা আমার পে ছিল অসম্ভব।’

বাংলাদেশে দুর্নীতি

সম্প্রতি ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ দুর্নীতির যে প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে, এতে বেশকিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য বেরিয়ে এসেছে। জরিপভিত্তিক প্রতিবেদনটিতে বলা হয়, উত্তরদাতাদের ৬০ শতাংশ মনে করেন, গত দুই বছরে (জানুয়ারি ২০১১ থেকে ডিসেম্বর ২০১২) বাংলাদেশের দুর্নীতি বেড়েছে। ২০১০ সালের জরিপে উত্তরদাতাদের ৪৬ শতাংশ দুর্নীতির মাত্রা বেড়েছে বলে মত প্রকাশ করেছিলেন।

দেশের ৯৩ শতাংশ মানুষ মনে করেন, সরকারি প্রতিষ্ঠানসমূহে সেবা পেতে ব্যক্তিগত সম্পর্ক ও যোগাযোগের বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ। তাঁদের মধ্যে ৪০ শতাংশ মনে করেন, বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল তার জরিপে অংশগ্রহণকারীদের বাংলাদেশের ১২টি খাতের দুর্নীতির মাত্রা চিহ্নিত করতে অনুরোধ করেছিল। এসব খাতের মধ্যে ছিল রাজনৈতিক দল, সংসদ, সামরিক বাহিনী, এনজিও, গণমাধ্যম, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান, ব্যবসা, শিাব্যবস্থা, আদালত, স্বাস্থ্য ও চিকিত্সাসেবা, পুলিশ ও সরকারি প্রশাসন।প্রতিবেদন বলছে, সর্বোচ্চ সংখ্যক উত্তরদাতা (৯৩%) রাজনৈতিক দল ও পুলিশকে দুর্নীতিগ্রস্ত খাত হিসেবে চিহ্নিত করেছে।

সরকারি খাতগুলোর সেবা নিয়ে ঘুষ দিতে হয়েছে, এমন ব্যক্তিই এ দেশে বেশি। জরিপের প্রতিবেদন থেকে দেখা যায়, পুলিশের কাছ থেকে সেবা নিয়ে ৭২ শতাংশ মানুষকে ঘুষ দিতে হয়েছে। এ ছাড়া বিচারিক সেবা নিয়ে ৬৩ এবং ভূমিসংক্রান্ত সেবা নিয়ে ৪৪ শতাংশ নাগরিককে ঘুষ দিতে হয়েছে। এ দেশের মানুষের ৫৮ শতাংশ মনে করেন, সেবা পাওয়ার েেত্র এটিই একমাত্র পথ। এসব ব্যক্তিবর্গের কেউ ঘুষ দিয়েছেন কাজ ত্বরান্বিত করার জন্য, কেউ উপঢৌকন হিসেবে, কেউ বা কম খরচে সেবা পেতে। তবে বাংলাদেশের জন্য আশার ব্যাপার হলো, যেসব ব্যক্তির কাছে ঘুষ চাওয়া হয়েছিল, তাঁদের ৫১ শতাংশ ঘুষ দিতে অস্বীকার করেছেন।

এর চেয়ে আশা জাগানিয়া ঘটনা হলো, বাংলাদেশের উত্তরদাতাদের শত ভাগই কোনো না কোনো উপায়ে দুর্নীতিবিরোধী কার্যক্রমে ভূমিকা রাখতে আগ্রহী।

দুর্নীতির কারণ

ভারতের সমাজবিজ্ঞানী দীপঙ্কর গুপ্ত ‘ইন্ডিয়া টুডে’কে বলেন, দুর্নীতির সঙ্গে সমাজ বিকাশের প্রত্য সম্পর্ক আছে। তিনি বলেন, ‘যত দিন দেশে মধ্যবিত্ত শ্রেণী অবিকাশিত থাকবে, তত দিন ব্যাপক মাত্রার দুর্নীতির অস্তিত্বও থাকবে।’ তিনি বলেন, সমাজের সব নাগরিক যখন একই মাত্রায় কর্তৃপ, সম্পত্তি, তথ্য ও আইনের সেবা পাবে না, তখনই দুর্নীতির সুযোগ তৈরি হবে।

দীপঙ্কর বলেন, ‘মধ্যবিত্ত শ্রেণীর পরিসর বাড়ার অর্থ হলো অনেক মানুষ একই ধরনের স্কুল ও কলেজে গিয়ে পড়বে, একই ধরনের বিপণি থেকে খরচ করবে এবং কাছাকাছি মানের পেশায় যুক্ত হবে। একটি গণতান্ত্রিক সমাজের কাজ হলো, এ জন্য সচেতনভাবে হস্তপে করা ও মধ্যবিত্ত শ্রেণি তৈরি করা। উনিশ শতকের শেষের দিকে পশ্চিম ইউরোপের রাষ্ট্রগুলো সবার জন্য স্বাস্থ্য ও চিকিত্সার ব্যবস্থা করে একটি সচেতন হস্তপে করেছিল। … নাগরিক অধিকার নিয়ে সচেতনতা ও রাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক কৌশলের কারণে সেসব দেশে মধ্যবিত্তের আকার বেড়ে দুর্নীতি প্রশমিত করেছিল।’

দীপঙ্কর আরও বলেন, ‘আমাদের (ভারতে) রাজনীতিকরা দারিদ্র্য দূর করার কথা বললেও এখানে (রাষ্ট্র পরিচালনায়) রাজনীতিক ও আমলাদের তত্ত্বাবধানে যে বিষয়টি কার্যকর আছে তা হলো কর্তা-গ্রহীতার সম্পর্ক।’…এ ধরনের সামন্তীয় সম্পর্কের মধ্যে থেকে ভালো কিছু করা সম্ভব নয়। … গণতন্ত্রের পথে এগোতে হলে আমাদের ততণ পর্যন্ত রাষ্ট্রব্যবস্থা বদলানোর দাবি জানাতে হবে, যতণ তা না বদলাচ্ছে।’

দুর্নীতি প্রতিরোধে কী করবেন

১. আইন জানুন: বিভিন্ন ধরনের আইন, বিধি ও নাগরিক অধিকার সম্পর্কে জানার চেষ্টা করুন। সেবা পাওয়ার দাবি জানান।

২. অভিযোগ দাখিল করুন: যথাযথ কর্তৃপরে কাছে আপনার দাবি ও সমস্যা জানাতে থাকুন।

৩. নিজেই করুন: প্রতারক, এজেন্ট ও মধ্যস্বত্বভোগীদের ওপর নির্ভর না করে নিজেই কাজটি করার চেষ্টা করুন।

৪. রেকর্ড করুন: নিজের ফোনে বা রেকর্ডারে ঘুষ চাওয়া ব্যক্তিটির বক্তব্য রেকর্ড করুন। সম্ভব হলে ছবি তুলে রাখুন বা মুঠোফোনে ভিডিও করে রাখুন। ফেসবুকের মতো সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে শেয়ার করুন।

৫. রসিদ নিন: যখনই কাউকে কোনো অর্থ দিতে হচ্ছে, তখনই তার কাছ থেকে রসিদ চেয়ে নিন। দিতে রাজি না হলে চাপাচাপি করুন। যখন কোনো অফিসের কোনে কর্মকর্তা বা কর্মচারী আপনার কাজ করে দিচ্ছে না, তখন লিখিতভাবে কারণ জানতে চান এবং তাদের কাছ থেকেও লিখিত জবাব চেয়ে নিন।

৬. ভয় পাবেন না: যিনি আপনার কাছে ঘুষ চাচ্ছেন, তিনি সব সময়ই এক পা পিছিয়ে আছেন। তাই তাঁকে চ্যালেঞ্জ করতে ভয় পাবেন না। তবে চ্যালেঞ্জ করুন কৌশলে, যাতে এসব অপরাধী হঠাত্ করে আপনার কোনো তি করতে না পারে। আপনার মতো ভুক্তভোগীদের নিয়ে জোটবদ্ধ হয়ে দাবি তুলতে পারেন।

৭. নিজের দায়িত্ব ও অধিকার চাইতে থাকুন: জানার চেষ্টা করুন, আপনি রাষ্ট্রকে কত ধরনের ও কী পরিমাণের কর, রাজস্ব, ভ্যাট ইত্যাদি দিচ্ছেন; এসব অর্থ কোথায় যাচ্ছে; কোনো কাজের জন্য যখন ফি দিচ্ছেন, তখন সেসবের খাত জেনে নিন। এসব প্রশ্নের উত্তর পাওয়া আপনার সাংবিধানিক অধিকার। বিভিন্ন পরিবেশে ও পরিস্থিতি সংগঠিত হওয়ার কথা চিন্তা করুন। মনে রাখবেন, সংগঠিত মানুষের সামনে দুনিয়ার আর সব শক্তিই তুচ্ছ। (প্রথম আলো)