বাংলাভূমিটোয়েন্টিফোর.কম ডেস্ক ॥ পুঁজিবাজার কারসাজির তদন্ত প্রতিবেদনে এক ডজন রাঘববোয়াল অভিযুক্ত থাকলেও সবাই এখনও ধরাছোঁয়ার বাইরে। তদন্ত প্রতিবেদনে তাদের সম্পর্কে সুস্পষ্ট প্রমাণ উপস্থাপন করা হলেও গত তিন বছরে এ বিষয়ে সরকার বা বিএসইসি কোনো উদ্যোগ নেয়নি।
অর্থ মন্ত্রণালয় প্রকাশিত প্রতিবেদনের ওপর অধিকতর তদন্ত করলে সেখানে স্থান পায় মাত্র দুইজন ব্যক্তির নাম। তাও তাদের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ প্রমাণিত না হওয়ায় শাস্তির আওতায় আনা হয়নি। মূল প্রতিবেদনে দুটি ঠিকানায় ১৯ ব্যক্তিকে ১৯ কোটি টাকার প্লেসমেন্ট দেয়ার অভিযোগ করা হয়। কিন্তু পরে অধিকতর তদন্তে বলা হয়েছে, রিপোর্টে ভুল তথ্য দেয়া হয়েছে।
প্রতিবেদনে ৫০টি কোম্পানির বিষয়ে অভিযোগ দেয়া হলেও সম্পন্ন হয়েছে মাত্র একটি কোম্পানির তদন্ত। এমন পরিস্থিতিতে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সরকার তদন্ত প্রতিবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে যথাযথ ভূমিকা নিতে আন্তরিক নয়। এজন্য তাদের বিরুদ্ধে কোনো আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা সম্ভব হয়নি। খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ তদন্ত প্রতিবেদনে প্রায় ২০ জন ব্যক্তিশ্রেণী বিনিয়োগকারীর বিরুদ্ধে মানিলন্ডারিং, আবার কারও বিরুদ্ধে ব্লক প্লেসমেন্টের মাধ্যমে কোটি টাকার শেয়ার হাতিয়ে নেয়ার অভিযোগ আনা হয়। অধিকতর তদন্তে তাদের অধিকাংশের বিরুদ্ধে কোনো প্রমাণ পায়নি অর্থ মন্ত্রণালয়।
ফলে এ সময়ে অর্জন শুধু পুঁজিবাজার সংশ্লিষ্ট নীতিমালা পরিবর্তন আর বিএসইসির নির্বাহী পরিচালক আনোয়ারুল কবীর ভূঁইয়াকে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানো। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, পুঁজিবাজার কারসাজির তদন্ত প্রতিবেদনের উল্লেখযোগ্য ২৮টি বিষয়ে অধিকতর তদন্ত পরিচালনা করেছে অর্থ মন্ত্রণালয়। এর মধ্যে কার্যক্রম সম্পন্ন হয়েছে ১৫টির।
মূল তদন্ত প্রতিবেদনে মানিলন্ডারিংয়ের অভিযোগ আনা হয় ব্যক্তিশ্রেণী বিনিয়োগকারী মোঃ আবদুস সালামের বিরুদ্ধে। তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়, আবদুস সালাম লংকাবাংলা ফিন্যান্স লিমিটেডে অমনিবাস (শ্যাডো) অ্যাকাউন্টে শেয়ার ব্যবসা করেন। এছাড়া বেসিক ব্যাংক লিমিটেডের প্রধান শাখায় আরও একটি হিসাব পরিচালনা করেন। তিনি ২০১০ সালে এপ্রিলে বেসিক ব্যাংকে দুটি চেকের মাধ্যমে ১ কোটি ৩৯ লাখ ৮০ হাজার টাকা জমা করেন। পরে একই অ্যাকাউন্ট থেকে একটি পে-অর্ডারের মাধ্যমে ২ কোটি টাকা জিএমজি এয়ারলাইন্স লিমিটেডকে প্রদান করেন। এ সময় অবশ্য জিএমজি এয়ারলাইন্স আইপিও অনুমোদন লাভ করেনি। তদন্ত কমিটি এসইসি পুনর্গঠনের পর বিষয়টি আরও তদন্ত করার সুপারিশ করেন।
এছাড়া লংকা বাংলা ফিন্যান্স লিমিটেডের মাধ্যমে শামিমা শরিফ ২০১০ সালে ফেব্রুয়ারির ৪ থেকে ১৬ তারিখ এবং অক্টোবরের ৫ তারিখে ট্রেড করে কমার্শিয়াল ব্যাংক অব সিলোনের মাধ্যমে ১ কোটি ৫২ লাখ টাকা ক্যাশ উত্তোলন করেন। যা পরে দুটি সিকিউরিটিজ হাউসে জমা করা হয়। ব্যাংক থেকে ১ কোটি ৫২ লাখ টাকা নগদ উত্তোলন মানিলন্ডারিং হিসেবে বিবেচিত হয় কিনা তা বাংলাদেশ ব্যাংকের মাধ্যমে তদন্ত করার সুপারিশ করেছিল তদন্ত কমিটি। এর পরিপ্রেক্ষিতে অর্থ মন্ত্রণালয় অধিকতর তদন্ত করে জানিয়েছে, তদন্তে কোনো অনিয়ম পাওয়া যায়নি।
মানিলন্ডারিংয়ের বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক জানিয়েছে, দুটি ঘটনার কোনোটিতেই মানিলন্ডারিং হয়নি। ফলে তাদের বিরুদ্ধে যে অভিযোগ আনা হয়েছে তা সম্পূর্ণ ভ্রান্ত। তদন্ত প্রতিবেদনে পুঁজিবাজার উত্থান-পতনে যেসব প্রতিষ্ঠানের সরাসরি সম্পৃক্ততা পাওয়া গিয়েছে এবং যাদের কারণে বাজারে ধস নেমেছিল তাদের তদন্ত প্রতিবেদনে নিশ্চিত করা হলেও তাদের বিষয়ে অর্থ মন্ত্রণালয়ের অধিকতর তদন্তে কিছুই বলা হয়নি। প্রতিষ্ঠানগুলো হচ্ছে, উত্তরা ফাইন্যান্স, ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি, পূবালী ব্যাংক, এবি ব্যাংক, উত্তরা ব্যাংক, স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংক, দি সিটি ব্যাংক, শাহজালাল ইসলামী ব্যাংক এবং ব্যক্তি পর্যায়ে চিহ্নিত ব্যক্তিরা ছিলেন আরিফুর রহমান, সৈয়দ সিরাজুদ্দৌলা, আমজাদ হোসেন ফকির, মোঃ শহীদুল্লাহ, গোলাম মোস্তফা, মোঃ খলিলুজ্জামান, ইয়াকুব আলী খোন্দকার। তাদের বিষয়ে তদন্ত প্রতিবেদনে স্পষ্ট উল্লেখ করা হয়েছে, পুঁজিবাজার উত্থানের দুটি পর্বে যেসব প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তি ক্রেতা ছিলেন তাদের অধিকাংশই নভেম্বর-ডিসেম্বর ২০১০ পতন পর্বে শীর্ষ বিক্রেতা ছিলেন। বাজার উত্থান-পতন উভয়কালে তারাই শীর্ষ সক্রিয় ব্যক্তি ছিলেন।
অধিকতর তদন্তের বাস্তবায়ন সম্পর্কে অর্থ মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, সে সময়ের সন্দেহজনক যেসব লেনদেন চিহ্নিত করা হয়েছিল তাদের জরিমানা করা হয়েছে। আর তদন্ত কমিটির সুপারিশ অনুযায়ী মোসাদ্দেক আলী ফালুসহ সম্পৃক্তদের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগে অস্পষ্টতা থাকায় তা আবার তদন্ত করার নতুন কমিটি গঠন করা হয়েছে। ব্লক প্লেসমেন্টের মাধ্যমে মাত্র দুটি ঠিকানায় ১৯ ব্যক্তির ১৯ কোটি টাকার শেয়ার বরাদ্দ বিষয়ে তদন্ত কমিটি সুপারিশের ভিত্তিতে অর্থ মন্ত্রণালয়ের অধিকতর তদন্ত করে জানিয়েছে, তদন্ত রিপোর্টে ভুল তথ্য দেয়া হয়েছে। ১৯ ব্যক্তি ১৯ কোটি টাকার বদলে মাত্র ১ কোটি ৯০ লাখ টাকার প্লেসমেন্ট শেয়ার নিয়েছেন। তখনকার বিদ্যমান আইনে তা কোনো অনিয়ম ছিল না। এ বিষয়ে তদন্ত কমিটির প্রধান কৃষি ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান খোন্দকার ইব্রাহীম খালেদ বলেন, পুঁজিবাজারে ১৯৯৬ সালেও কারসাজি হয়েছিল। সে সময়ও তদন্ত প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়েছিল।
২০১০ সালের বাজার কারসাজির পরিপ্রেক্ষিতে তদন্ত প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়েছে। কোনোটির বিষয়েও সরকার আন্তরিক হয়নি। ফলে বাজারের যেভাবে ঘুরে দাঁড়ানোর কথা ছিল তা হয়নি। তিনি বলেন, সে সময় আমাকে তদন্ত করতে দেয়া হয়েছিল। আমি যা যা পেয়েছি সবই সেখানে সন্নিবেশিত করেছি। এখন সরকার কোন কোন বিষয়কে গুরুত্ব দেবে তা একান্তই সরকারের বিষয়।
অধিকতর তদন্ত সম্পর্কে কোনো মন্তব্য করতে চাচ্ছি না। পুঁজিবাজার বিশ্লেষক ও অর্থনীতিবিদ আবু আহম্মেদ বলেন, আমাদের দুর্ভাগ্য পুঁজিবাজার কারসাজির সম্পর্কে একটি প্রতিবেদন তৈরি করা হয়েছিল। কিন্তু তা বাস্তবায়ন করা হয়নি। সেখানে ভুল থাকতে পারে। কিন্তু সবকিছুই যে ভুল ছিল তা বলা ঠিক হবে না। তদন্ত প্রতিবেদন অনুযায়ী বাজার পুনর্গঠন করা প্রয়োজন ছিল।