শনিবার , ২০শে এপ্রিল, ২০২৪ , ৭ই বৈশাখ, ১৪৩১ , ১০ই শাওয়াল, ১৪৪৫

হোম > Uncategorized > পৌনে ৭ লাখ গাড়ি অবৈধ চালকের হাতে!

পৌনে ৭ লাখ গাড়ি অবৈধ চালকের হাতে!

শেয়ার করুন

বাংলাভূমি২৪ ডেস্ক ॥
ঢাকা : রাজধানীর বনানীর চেয়ারম্যানবাড়ি এলাকায় গত ৩০ অক্টোবর একটি প্রাইভেট কারের ধাক্কায় ঘটনাস্থলেই সঞ্জয় আচার্য নামের এক পোশাক শ্রমিক মারা যান। সাদা রঙের গাড়িটির সামনের কাচে লেখা ছিল ‘পুলিশ’। চালকের আসনে ছিলেন জাফর সাদিক (২৩)। তিনি পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) অতিরিক্ত উপমহাপরিদর্শক মোজাম্মেল হোসেনের ছেলে। তবে বাবা আইনের লোক হলেও ছেলে গাড়ি চালাচ্ছিলেন আইন ভেঙেই। কারণ বনানী থানার পুলিশ কর্মকর্তাদের ভাষ্য মতে, গাড়ি চালানোর জন্য জাফরের লাইসেন্স ছিল না।

জাফর নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। বনানী থানার ওসি ভূঁইয়া মাহবুব হোসেন জানান, জাফর গাড়ি চালিয়ে কাকলীর দিকে যাচ্ছিলেন। সঞ্জয় সে সময় রাস্তা পার হচ্ছিলেন। জাফরের গাড়িটি সঞ্জয়কে চাপা দিয়ে সড়ক বিভাজকের ওপর উঠে যায়। জাফরকে পুলিশ গ্রেপ্তার করেছে, তাঁর বিরুদ্ধে বনানী থানায় মামলা হয়েছে।
জাফরের মতো লাইসেন্সবিহীন চালকের হাতে এখন দেশে চলছে পৌনে সাত লাখ গাড়ি। তাদের মধ্যে কারো লাইসেন্সই নেই, আবার কেউ কেউ বেআইনি পথে বানিয়ে নিয়েছে জাল লাইসেন্স। সব ধরনের যানবাহনের স্টিয়ারিংয়েই বসছে তারা। আর তাদের বেপরোয়া গাড়ি চালানোর কারণে সড়কে অঝোরে ঝরছে প্রাণ। বেসরকারি হিসাবে, দেশে বছরে ১৫ হাজার সড়ক দুর্ঘটনা ঘটছে। আর এর অন্যতম কারণ লাইসেন্সহীন চালকের হাতে গাড়ি চালানোর ভার দেওয়া।
বাস ও হিউম্যান হলারের ক্ষেত্রে দেখা গেছে, ‘ওস্তাদের’ কাছে কোনো রকমে হাতেখড়ি নিয়ে অনেকেই চালকের সহকারী থেকে কিছুদিনের মধ্যে নিজেই চালকের আসনে বসছে। গাড়ি নিয়ে মহাসড়কেও নামছে তারা। গাড়ি চালানোর আইন না মেনে চালকের সহকারী হিসেবে কাজ নিয়ে এখন কিশোররাও ধরছে স্টিয়ারিং। বাস ও ট্রাক থেকে শুরু করে সিএনজি অটোরিকশা বা ব্যাটারিচালিত রিকশার বড় একটি অংশেরই চালক ‘বনে’ গেছে তারা। লক্কড়ঝক্কড় মার্কা গাড়ির মালিকরা কম বেতনে ও নিয়োগপত্র ছাড়া সহজেই গাড়ি চালাতে তাদের ওপর নির্ভর করছেন।
গত ২০ অক্টোবর নাটোরের বড়াইগ্রামে দেশের সবচেয়ে দামি মহাসড়ক হাটিকুমরুল-বনপাড়ায় দুই বাসের সংঘর্ষে ঝরে যায় ৩৬ প্রাণ। দুর্ঘটনা তদন্তে গঠিত কমিটি অনুসন্ধানে জানতে পারে, দুর্ঘটনার জন্য দায়ী ছিলেন চালকরা। তাঁরা বেপরোয়াভাবে বাস চালাচ্ছিলেন। ঢাকা থেকে রাজশাহীগামী কেয়া পরিবহনের বাসটির ফিটনেস সনদ ও রুট পারমিট ছিল না। নাটোর-গুরুদাসপুর পথে চলাচলকারী অথৈ পরিবহনের বাসটির নিবন্ধনই ছিল না।
স্থানীয় সূত্র জানায়, অথৈ পরিবহনের গাড়ির চালক আলম মণ্ডলের ড্রাইভিং লাইসেন্স ছিল না। মাঝেমধ্যে তাঁর কাছে জাল লাইসেন্স পাওয়া যেত। কমিটি তাদের প্রতিবেদনে ড্রাইভিং লাইসেন্স দেওয়ার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষকে (বিআরটিএ) আরো দায়িত্বশীল ও সচেতন হওয়ার সুপারিশ করেছে।
লাইসেন্সবিহীন চালকের হাতে পৌনে সাত লাখ গাড়ি : বিআরটিএর সর্বশেষ গত সেপ্টেম্বর মাসের প্রতিবেদন অনুসারে, দেশে বাস, ট্রাকসহ ২০ ধরনের নিবন্ধিত গাড়ি আছে ২১ লাখ পাঁচ হাজার ১৪০টি। একই সময়ে এসব গাড়ির বিপরীতে চালকের লাইসেন্স দেওয়া হয়েছে ১৪ লাখ ৩১ হাজার। একটি গাড়ির কমপক্ষে একজন করে চালক আছেন- এমন হিসাবে ২১ লাখ পাঁচ হাজার ১৪০টি গাড়ি চালানোর জন্য বৈধ লাইসেন্সধারী চালক আছেন ১৪ লাখ ৩১ হাজার। বাকি ছয় লাখ ৭৪ হাজার ১৪০টি গাড়ি চলছে জাল লাইসেন্সেধারী কিংবা লাইসেন্সবিহীন চালকের হাতে। অর্থাৎ প্রায় পৌনে সাত লাখ গাড়ি চলছে বৈধ লাইসেন্সধারী চালক ছাড়াই। বিআরটিএর হিসাব অনুযায়ী, নিবন্ধিত গাড়ির বাইরে সারা দেশে চলাচল করছে অন্তত দুই লাখ গাড়ি। সেগুলোর বেশির ভাগও চলছে লাইসেন্সবিহীন চালকদের হাতেই।
বিআরটিএ নিয়ে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের এক গবেষণায় দেখা গেছে, ৯৭ শতাংশ চালক ওস্তাদের সঙ্গে সহকারী হিসেবে কাজ করে গাড়ি চালানো শেখেন। পরীক্ষা না দিয়েই ৬১ শতাংশ চালক লাইসেন্স নিয়েছেন।
ট্রাফিক পুলিশের দেওয়া তথ্যানুসারে, ঢাকা মহানগরীতে ট্রাফিক পুলিশ প্রতিদিনই লাইসেন্সবিহীন বা জাল লাইসেন্সধারী চালকদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিচ্ছে। প্রতিদিন নগরীতে গড়ে আড়াই থেকে তিন হাজার মামলা হচ্ছে। এর মধ্যে লাইসেন্সবিহীন বা জাল লাইসেন্স দিয়ে গাড়ি চালানোর অপরাধ উল্লেখযোগ্য। গড়ে ১০টি মামলার মধ্যে চার থেকে পাঁচটিই হচ্ছে বৈধ লাইসেন্স না থাকার অভিযোগে।
এ ব্যাপারে ঢাকা মহানগর ট্রাফিক পুলিশ পশ্চিম জোনের উপপুলিশ কমিশনার ইমতিয়াজ আহমেদ বলেন, “ট্রাফিক আইন অমান্য করায় আমাদের ট্রাফিক জোনের অধীনে গত বছরের চেয়ে এ বছর মামলা বেশি হচ্ছে। জাল লাইসেন্স পাওয়া গেলে আইনানুসারে থানায় মামলা করা হচ্ছে। চালকরা এমনভাবে জালিয়াতি করে যে, সহজে তা বোঝাও যায় না। কিছুদিন আগে এক গাড়িচালকের কাছে কোনো কাগজপত্র পাওয়া যায়নি। পাওয়া গেছে ‘পুলিশের জাল স্লিপ’। অথচ মালিক কিছুই জানেন না।” ট্রাফিকের উত্তর জোনের উপপুলিশ কমিশনার কুদ্দুস আমীন বলেন, ‘জাল লাইসেন্স সন্দেহ হলে আমরা সেটা বিআরটিএতে পরীক্ষার জন্য পাঠাই, জাল প্রমাণিত হলে মামলা হয়।’
সরেজমিন : রাজধানীর তেজগাঁও ট্রাকস্ট্যান্ডে টানা কয়েক দিন গিয়ে চালকদের অনেকের কাছেই লাইসেন্সের খোঁজ করলে তাঁরা কোনো লাইসেন্স দেখাতে পারেননি। কেউবা বের করেছেন জাল লাইসেন্স, কারোটার মেয়াদ শেষ হয়েছে অন্তত চার বছর আগে।
শাহজীবী এন্টারপ্রাইজের ট্রাক চালান রফিক। রফিকের বন্ধু মো. হোসেন (১৮), তিনি কাজ করেন রফিকের সহকারী হিসেবে। বন্ধুর কাছে দেখতে দেখতে ট্রাক চালানো শিখেছেন হোসেন, কোনো লাইসেন্সও নেননি। রাতে রফিকের বদলে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে ট্রাক নিয়ে নামেন তিনি। হোসেন জানান, মাসে তিন হাজার টাকা বেতন পান। তিনি দাবি করলেন, রাতের বেলায় মাঝেমধ্যে ঘুম পায়, ওই অবস্থায়ই ট্রাক চালান, কোনো অসুবিধা হয় না। লাইসেন্সের কথা উঠতেই হেসে বলেন, ‘আমাদের নাইসেন্স (লাইসেন্স) নাগে না।’
কিছুদিন আগে মহাখালী বাস টার্মিনালের পাশের সড়কে ঢাকা-কিশোরগঞ্জ রুটের অন্যন্যা পরিবহনের একটি বাসের (নম্বর-ঢাকা মেট্রো-জ-১১-২৮৫১) ভেতর বসে মোবাইলে গেম খেলছিলেন জুয়েল হোসেন (২২)। ১০ বছর ধরে হেলপারি করেছেন, এখন নিজেই চালক হয়েছেন। তবে লাইসেন্স করাননি।
হোসেন কিংবা জুয়েলের মতো অসংখ্য যুবক হেলপার থেকে চালক হয়েছেন, লাইসেন্সের তোয়াক্কা করেন না তাঁরা।
রাজধানীর জিরো পয়েন্টসংলগ্ন রাস্তা থেকে গুলশান-২ নম্বরে যাতায়াত করে বেশ কিছু হিউম্যান হলার, এসব গাড়ির ফিটনেস নেই, চালকের আসনে থাকে কিশোররা, কোনো লাইসেন্স নেই তাদের। গত সপ্তাহে ঢাকা মেট্রো-ছ ১১-২৪১৯ নম্বরের একটি হিউম্যান হলারে উঠে দেখা গেল, গাড়িতে বসার মতো আসন নেই। স্টিয়ারিংয়ে যে বসেছে তার নাম দেলোয়ার। লাইসেন্স আছে কি না জানতে চাইলে এই কিশোরের উত্তর, ‘পরিবহন সমিতির নেতাদের কাছে আছে।’ নেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে চাইলে বলল, ‘এসব জাইন্যা কী করবেন।’ কথায় কথায় জানাল, তিন বছর ধরে সে গাড়ি চালাচ্ছে। গাড়ি চালিয়ে পাওয়া আয়ের প্রতি হাজার টাকার ১০ ভাগ পায় সে। দুর্ঘটনা ঘটলে ক্ষতিগ্রস্ত গাড়ি পুলিশ থানায় আটকে রাখে। রামপুরা থানায় এ ধরনের গাড়ি আছে। টাকা দিয়ে পরে গাড়ি ছাড়িয়ে আনা যায়।
বিআরটিএ সূত্রে জানা গেছে, এখন কম সময়েই বিআরটিএ থেকে পাওয়া যাচ্ছে স্মার্ট কার্ড ড্রাইভিং লাইসেন্স। ২০১১ সালের ১৭ অক্টোবর থেকে ডিজিটাল স্মার্ট কার্ড ড্রাইভিং লাইসেন্স চালু করা হয়েছে। এ পর্যন্ত ছয় লাখেরও বেশি এ রকম লাইসেন্স দেওয়া হয়েছে। এর পরও জাল লাইসেন্স নিয়ে বা লাইসেন্স ছাড়া গাড়ি চালানোর প্রবণতা থামেনি।
সড়ক পরিবহন শ্রমিক সমিতিগুলোর কাছ থেকে জানা গেছে, সমিতির নেতারা প্রতিবছর পরীক্ষা না দিয়ে লাইসেন্স নেয়। পরীক্ষা না দিয়ে লাইসেন্স পাওয়ার আশায় চালকদের বড় একটি অংশ লাইসেন্স নিচ্ছে না। বিভিন্ন পরিবহন শ্রমিক সমিতি ও ইউনিয়নের চাপে গত এক যুগে চার লাখ চালককে পরীক্ষা না নিয়েই লাইসেন্স দিয়েছে বিআরটিএ। বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক ওসমান আলী অবশ্য বলেন, ‘বহুদিন ধরে ওস্তাদের কাছে গাড়ি চালাচ্ছেন এমন চালকদের সংখ্যা আমাদের দেশে বেশি। বিআরটিএ প্রশিক্ষণের যথেষ্ট সুযোগ তৈরি করতে পারেনি। এ কারণে আমরা বলে আসছি, যেসব চালক গাড়ি চালাতে পারে তাদের কাছ থেকে শুধু ব্যবহারিক পরীক্ষা নিয়ে লাইসেন্স দেওয়া হোক। কারণ ওস্তাদের কাছে গাড়ি চালানো শিখে গাড়ি চালাচ্ছে এমন চালকের বেশির ভাগ স্বাক্ষর দিতে জানে না। তারা লিখিত পরীক্ষা দিতে পারবে না। তবে আমরা শুধু এ দাবিই জানিয়ে আসছি। কোনো ধরনের চাপ আমরা তৈরি করি না।’
বিশেষজ্ঞরা দক্ষ চালক তৈরির জন্য বিআরটিএর উদ্যোগে সব জেলায় প্রশিক্ষণকেন্দ্র প্রতিষ্ঠার সুপারিশ করেছেন। সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের সচিব এম এ এন ছিদ্দিক বলেন, ‘আমরা যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয় এবং প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ে গাড়ি চালানোর ট্রেড কোর্স চালুর জন্য চিঠি দিয়েছি। এ ছাড়া বিআরটিসির ১৭টি প্রশিক্ষণকেন্দ্রে চালকদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে।’
রাজধানীর মহাখালী বাস টার্মিনালের সামনে সম্প্রতি দেখা হয় ঢাকা-ময়মনসিংহ রুটের বাসচালক আমজাদ মিয়ার সঙ্গে। তিনি জানান, ছয় বছর ধরে চালাচ্ছেন গাড়ি। টেম্পো থেকে শেষে বাসের স্টিয়ারিং ধরেছেন। বিআরটিএর দালালদের দুই হাজার টাকা দিয়ে লাইসেন্স পেয়েছিলেন। এর বাইরে কিভাবে লাইসেন্স পেতে হয় তা জানা নেই তাঁর। তাঁর ধারণা, পরীক্ষা দিলেও বিআরটিএ থেকে লাইসেন্স পেতে দেড় থেকে দুই বছর লেগে যায়। এই লাইসেন্স নিতে তাঁর এত অনীহা।
-কালের কন্ঠ