শুক্রবার , ২৯শে মার্চ, ২০২৪ , ১৫ই চৈত্র, ১৪৩০ , ১৮ই রমজান, ১৪৪৫

হোম > Uncategorized > প্রবাসে শিল্প-সাহিত্য চর্চা

প্রবাসে শিল্প-সাহিত্য চর্চা

শেয়ার করুন

বাংলাভূািম ডেস্ক ॥ শুক্রবার রাতে সিডনিতে এক জন্মদিনের দাওয়াতে গিয়েছি। এ ধরনের অনুষ্ঠানে সাধারণত অতিথিরা গরু, মুরগী কিংবা খাসীর মাংসের নরম হাড্ডি চিবাতে চিবাতে বাংলাদেশের রাজনীতিবিদদের মাথা চিবাতে পছন্দ করেন। সেখানেও তাই হচ্ছিলো। ভিন্নতা দেখা গেল শুধু দুই একজনের মধ্যে। এক ভদ্রলোক একটি হাড্ডি চিবানো শেষ করে আরেক টুকরা নরম হাড্ডিওয়ালা মাংস প্লেটে নেয়ার সময় তার বন্ধুকে বললেন:

-কাল সন্ধ্যায় ‘কবিতা বিকেল’র ৭ম বর্ষপূর্তি অনুষ্ঠান আছে। যাবি?
-কবিতা বিকেলটা আবার কি জিনিস?
-এখানকার একটি আবৃতি সংগঠন। কবিতা চর্চা করে। এদের মধ্যে কেউ কেউ লেখেও।
-তাই নাকি? কই, কোন ওয়েবসাইটে তো কিছু দেখলাম না।
-ওরা সেভাবে প্রচার করেনি।
-এরকম প্রচার বিমুখতার কথা তো আগে শুনিনি। বাঙালিরা এরকম হয়?
-হু, হয়।
-কী হবে সেখানে? গলাবাজি নাকি স্বরচিত অকবিতার যন্ত্রণা?
-যদ্দূর জানি, সেরকম কিছু না। ‘যারা জেগেছিল আগুনের রাতে’ নামে ওরা একটি ফেইসবুক পেইজ খুলেছে। সম্ভবত কবিতা আলেখ্য টাইপের কিছু করবে?
-আচ্ছা! তোদের এখানে তাহলে কবিতা চর্চাও হয়?
-হয়। এখানে গম হয়, আঙ্গুর হয়, কবিতা চর্চাও হয়।
-আচ্ছা। কোথায় হবে?
-ব্যাংকসটাউন।
-আমি তো কিছু চিনি না। নতুন এসেছি, গাড়ি নাই। নিয়ে যাস। দেখি, কেমন হয়?

একজন নীরব দর্শকের ভূমিকায় কান পেতে শুনলাম। আমার বলার কিছু ছিল না। হয়তো বলতে পারতাম, কবিতা বিকেল’র অনুষ্ঠানে আমিও যাবো। কী জানি কী ভেবে তাও বললাম না। যথারীতি পরদিন সময়মত অনুষ্ঠানস্থলে পৌঁছালাম। হলরুমে ঢুকেই দেখি, সেই দুই ব্যক্তি দ্বিতীয় সারিতে বসে আছেন। আমি ডাবল উদ্দেশ্য নিয়ে আস্তে আস্তে তাদের ঠিক পিছনের সারিতে গিয়ে বসলাম। উদ্দেশ্য (১) অনুষ্ঠান দেখা (২) তাদের কথোপকথন শোনা। গুটুর গুটুর করে মিহি স্বরে তারা কথা বলছেন। সিডনিতে নবাগত লোকটি বলছেন:
-কি রে নয়টার ট্রেন কয়টায় ছাড়বে?

এই প্রশ্নে অন্যজন একটু বেকায়দায় পড়েছেন বলে মনে হলো। তিনি উত্তর দিলেন:
-একটু আধটু দেরি তো হতেই পারে। বাংলাদেশেও এরকম হয়, কি হয় না?
-তুই তো খুব জোর দিয়ে বলেছিলি। এরকম না, সেরকম না। মঞ্চ তো এখনো অন্ধকার। ৫টার অনুষ্ঠান, এখন বাজে ছয়টা। এই ঘণ্টা ডলারের দেশে সময় কি বাংলালিংক দামে পাইছোস?

তার কথার রেশ শেষ হতে না হতেই মঞ্চে আলো জ্বলে উঠলো। মঞ্চের ডানপাশের বেদীতে বসে দুটি মেয়ে চেতনা জাগানিয়া গান ধরলো। দর্শকদের পিছন থেকে দুই পাশ দিয়ে পারফর্মাররা একে একে মঞ্চে আরোহন করছে। অন্যরকম এক মঞ্চ। কেউ বসেছে মঞ্চে, কেউ বসেছে মঞ্চের বেদীতে। মঞ্চের ব্যাকগ্রাউন্ডে বামপাশে ভাষা আন্দোলন, ডানপাশে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস, মাঝখানে দিয়ে বয়ে যাচ্ছে রক্তের নদী। মুহূর্তেই অভূতপূর্ব এক দৃশ্যের অবতারণা হলো। কবিতায়, গানে, আলোক প্রপেণে এবং নেপথ্যে শব্দ ব্যবহারের শৈল্পিকতায় প্রতিটি মুহূর্তে সকলের সর্বোচ্চ মনোযোগ কেড়ে নিল। হলভরা দর্শক পিনপতন নীরবতায়, বিমোহিত মুগ্ধতায় অনুষ্ঠান উপভোগ করতে থাকে। কোনো রকম হেলে পড়া কিংবা ঝুলে পড়ার আগেই ৪৬ মিনিটের প্রযোজনাটিকে মনে হলো- এক পলকই শেষ। করতালিতে, অভিনন্দনে সিক্ত, চারদিক মুখরিত। পারফর্মাররা মঞ্চ থেকে নেমে এলে দর্শকরা কে কাকে অভিনন্দন জানাবে তা নিয়ে এক ধরনের মধুর প্রতিযোগিতা। নবাগত ভদ্রলোকটি সবার আগে গিয়ে পারফর্মারদের সাথে হ্যান্ডশেক করছেন আর বলছেন:

-এরকম একটি অনুষ্ঠান আরো বড় জায়গায় করলে ভালো হতো। এটা তো টিকিট কিনে দেখার মতো অনুষ্ঠান। অনেকেই বসার জায়গা পায়নি। এটা কি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখার অনুষ্ঠান?

একটু পরে তার বন্ধু তাকে একটু খোচা মেরে বললেন:
-এবার বুঝছিস?
-হু। বুঝলাম। দোস্ত, আমিও এদের সাথে যোগ দিতে চাই। আমাকে নিবে?
-কথা বলে দেখতে হবে।
-ভাব নিচ্ছিস? আচ্ছা, এই সংগঠনের নাম যেন কি?
-শালা! সারারাত রামায়ণ পড়ে সীতা কার বাপ?
-আরে মঞ্চের কোথাও তো সংগঠনের নাম লেখা নেই। তুই ভালো করে দ্যাখ।

আমিও ভালো করে তাকালাম। কোথাও কবিতা বিকেল নামটি খুঁজে পেলাম না। কিছুণ পরে তিনি বললেন:
-একটা না একটা দোষ কি খুঁজে বের করতেই হবে? নাম লেখা নাই তো কি হয়েছে? মাইকে বলেছে না?

আর কী কী মনে হয়েছে? এখনই বল, কবিতা বিকেল’র জননী মাহমুদা রুনু’কে জানিয়ে দিব।
-মাহমুদা রুনু কোন জন?
-লাল পাড়ের অফ হোয়াইট শাড়ি পরা মেয়েদের মধ্যে যার শাড়ির কুচি ঠিকমত মেলেনি, তিনিই রুনু আপা।
-মানে?
-মানে, টেনশনে শাড়ির কুচি মিলাতে ভুল হয়ে গেছে, আরকি। তোর কি আরো কিছু বলার আছে?
-হু, আছে।
-কী?
-অনুষ্ঠান শেষে পারফর্মারদের পরিচয় করিয়ে দিলে ভালো হতো।
-কেন? কোনো মেয়েকে কি তোর পছন্দ হয়েছে? তার নাম জানা খুব দরকার?
-এভাবে বলছিস কেন? ঐ যে একটা ছেলে ‘মকবুল সমুদ্রে যাবে’ কবিতাটি পাঠ করলো, তার নাম জানতে চাওয়াটা কি অপরাধ? অনেকেরই এটা মনে হতে পারে।
-হু। তা হতে পারে। আর…?
-এখন আর কিছু মনে আসছে না। মনে পড়লে বলবো।
-আচ্ছা বলিস। হায় রে ছিদ্রান্বেষী!