স্টাফ রিপোর্টার ॥ প্রাথমিক পর্যায় থেকেই ঝরে পড়ছে প্রায় ৩০ ভাগ শিক্ষার্থী। তবে গত ৭ বছরের গড় হিসাবে এ সংখ্যা অনেক বেশি। গত ৭ শিক্ষাবর্ষের গড় হিসাব অনুযায়ী প্রাথমিক পর্যায় থেকে ৪৪.৫৯ ভাগ শিক্ষার্থী ঝরে পড়ছে। প্রাথমিক পর্যায় থেকে শিক্ষার্থী ঝরে পড়া রোধে সরকার নানা পদক্ষেপ নিয়েছে। ইতিমধ্যে বেশ সাফল্যও এসেছে। প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, ২০০৫-০৬ শিক্ষাবর্ষে ৪৭.২ ভাগ, ২০০৬-০৭ শিক্ষাবর্ষে ৫০.৫ ভাগ, ২০০৭-০৮ শিক্ষাবর্ষে ৫০.৫ ভাগ, ২০০৮-০৯ শিক্ষাবর্ষে ৪৯.৩ ভাগ, ২০০৯-১০ শিক্ষাবর্ষে ৪৫.১ ভাগ, ২০১০-১১ শিক্ষাবর্ষে ৩৯.৮ ভাগ ও ২০১১-১২ শিক্ষাবর্ষে ২৯.৭ ভাগ শিক্ষার্থী ঝরে পড়ে। বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষা কার্যক্রম বাস্তবায়ন সরকারের অন্যতম লক্ষ্য। এ লক্ষ্যে কাজ করছে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়। এর অংশ হিসেবে কন্যা শিশুদের বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষা কার্যক্রমের আওতায় আনার জন্য উপবৃত্তি কার্যক্রম সমপ্রসারণ করেছে সরকার। প্রাথমিক স্তরে মোট শিক্ষার্থীর ৫০.৪ ভাগ কন্যা শিশু। দরিদ্র পরিবারের মেয়েদের স্কুলে ভর্তি না হওয়ায় এবং ঝরে পড়া হার অনেক বেশি। এ কারণে সুবিধাবঞ্চিত পরিবারের ৭৮.১৭ লাখ শিক্ষার্থীকে মাসে ১০০ টাকা এবং একই পিতা-মাতার সন্তান একাধিক শিক্ষার্থীর জন্য ১২৫ টাকা হারে উপবৃত্তি প্রদান করা হচ্ছে। ট্যালেন্টপুলে বৃত্তির সংখ্যা ২০ হাজার থেকে ২২ হাজার এবং সাধারণ বৃত্তির সংখ্যা ৩০ থেকে ৩৩ হাজার উন্নীত করা হয়েছে। এ কার্যক্রমের অংশ হিসেবে প্রাথমিক পর্যায়ে ছাত্রী ভর্তির হার বাড়ছে। ২০০১ সালে প্রাথমিক পর্যায়ে ছাত্র-ছাত্রী ভর্তির অনুপাত ছিল ৫১.১:৪৯.৯। ২০১১ সালে এ অনুপাত দাঁড়ায় ৪৯.৬ : ৫০.৪। ঝরে পড়া শিক্ষার্থীর হার সবচেয়ে বেশি মাধ্যমিক স্তরে। সরকারের শিক্ষা তথ্য পরিসংখ্যান ব্যুরোর এক জরিপ অনুযায়ী প্রায় ৫৫ ভাগ শিক্ষার্থী ঝরে পড়ছে। শিক্ষাকার্যক্রম থেকে শিক্ষার্থীদের ঝরে পড়া বন্ধে উপবৃত্তিসহ নানা কর্মসূচি সরকার হাতে নিলেও সুফল মিলছে না এ ক্ষেত্রে। সাবেক শিক্ষা উপদেষ্টা, শিক্ষাবিদ ও সরকারের পদস্থ ব্যক্তিদের মতে শিক্ষাব্যবস্থা থেকে ঝরে পড়ার প্রধান কারণ দারিদ্র্য। সরকার বিনামূল্যে বই ও উপবৃত্তিসহ নানা প্রণোদনা দিলেও নগদ উপার্জনের লোভই মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষা থেকে অধিকাংশ শিক্ষার্থী কর্মক্ষেত্রে চলে যাচ্ছে। একটি অংশ অবশ্য বিবাহের কারণেও শিক্ষাজীবন থেকে ঝরে পড়ছে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। গত বছরে বাংলাদেশে মাধ্যমিক স্তরে শিক্ষার্থীদের ঝরে পড়ার হার ছিল ৫৪ দশমিক ১৫ শতাংশ। ঝরে পড়া শিক্ষার্থীদের মধ্যে মেয়েদের সংখ্যা আরও বেশি। মাধ্যমিক স্তরে মেয়েদের ঝরে পড়ার হার ৬২ দশমিক ৯২ শতাংশ। আর ছেলেদের ঝরে পড়ার হার ৪২ দশমিক ৮১ শতাংশ। অথচ মাধ্যমিক স্তরে ছেলেদের তুলনায় মেয়েদের এনরোলমেন্ট বেশি ১৬ শতাংশ। বাংলাদেশ শিক্ষা তথ্য পরিসংখ্যান ব্যুরোর (ব্যানবেইস) সমপ্রতি প্রকাশিত ‘পঞ্চমবার্ষিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান শুমারি-২০১২’ এ তথ্য উঠে এসেছে। ব্যানবেইসের প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, দাখিল, ভোকেশনাল ও মাধ্যমিক স্কুল সার্টিফিকেট পরীক্ষায় (এসএসসি) অংশগ্রহণ করতে হলে নবম শ্রেণীতে অবশ্যই শিক্ষার্থীদের নিবন্ধন করতে হয়। কিন্তু নবম শ্রেণীতে নিবন্ধনকৃত শিক্ষার্থীদের সবাই এসএসসি বা দাখিল পরীক্ষায় অংশ নিচ্ছে না। নবম শ্রেণীতে নিবন্ধনকৃত শিক্ষার্থীদের মধ্যে থেকে ২০১২ সালের এসএসসি ও দাখিল পরীক্ষায় অংশগ্রহণের হার ছিল ৭৩ দশমিক ৪১ শতাংশ। অর্থাৎ এখানেই পরীক্ষার্থীদের ঝরে পড়ার হার ২৬ দশমিক ৫৯ শতাংশ। এদিকে ২০১২ সালের এসএসসি পরীক্ষায় অংশ নেয়া শিক্ষার্থীদের পাসের হার ৮৩ দশমিক ৯১ শতাংশ হলেও প্রকৃত অর্থে মাধ্যমিক স্তর সম্পন্ন করা শিক্ষার্থীর হার দাঁডায় ৫০ দশমিক ২০ শতাংশে। মাদরাসার শিক্ষার্থীদের ক্ষেত্রে এর হার ৫০ দশমিক ৫৮ শতাংশ বলে ব্যানবেইসের প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। মাধ্যমিক স্তরের অষ্টম শ্রেণী থেকেই মূলত বড় ধরনের ঝরে পড়া শুরু হয়। ২০১২ সালে অষ্টম শ্রেণীতে ঝরে পড়ার হার ছিল ২০ দশমিক ৪১ শতাংশ। ২০১১ সালে তা ছিল ১৮ দশমিক ৯৮ শতাংশ। একইভাবে ২০১২ সালে নবম শ্রেণীতে ঝরে পড়ার হার ছিল ১২ দশমিক ৩৬ ও ১০ম শ্রেণীতে ঝরে পড়ার হার ছিল ২২ দশমিক ৭০ শতাংশ। ২০১১ সালে ১০ম শ্রেণীতে ঝরে পড়ার হার ছিল ৩৫ দশমিক শূন্য ৬ শতাংশ। তবে ২০১২ সালে ৬ষ্ঠ শ্রেণীতে ঝরে পড়ার হার ছিল ৬ দশমিক শূন্য ৪ শতাংশ ও সপ্তম শ্রেণীতে ৬ দশমিক ৯৭ শতাংশ। মাধ্যমিক স্তরের প্রায় সব শ্রেণীতে মেয়েদের ঝরে পড়ার হার ছেলেদের তুলনায় বেশি হলেও অষ্টম শ্রেণী থেকেই তাদের ঝরে পড়ার হার অধিক মাত্রায় বৃদ্ধি পায়। ২০১২ সালে অষ্টম শ্রেণীতে মেয়েদের ঝরে পড়ার হার ছিল ২৫ দশমিক ৩৪ শতাংশ। অথচ ওই বছরে ছেলেদের ঝরে পড়ার হার ছিল ১৪ দশমিক ৪২ শতাংশ। একই বছরের নবম শ্রেণীতে ছিল ১৪ দশমিক ৪৬ শতাংশ এবং দশম শ্রেণীতে ২৯ দশমিক ৬৭ শতাংশ। ব্যানবেইসের প্রতিবেদন অনুযায়ী ২০১১ সালে ১০ম শ্রেণীতে মেয়েদের ঝরে পড়ার হার ছিল ৪০ দশমিক ৯০ শতাংশ।
২০১১ সালে দশম শ্রেণীতে ছেলেদের ঝরে পড়ার হার ছিল ২৮ দশমিক ৪৫ শতাংশ। তত্ত্বাধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা রাশেদা কে চৌধুরী বলেন, শিক্ষার্থী ঝরে পড়ার পেছনে অন্যতম কারণ হলো দরিদ্রতা। এছাড়া রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাব রয়েছে। তিনি বলেন, অনেক ক্ষেত্রে বিশেষ জনগোষ্ঠীর শিক্ষার্থীরা সুযোগ-সুবিধা পায় না। তাদের নিয়ে বরং টানাটানি হয়। তিনি বলেন, প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের বিষয়টি নিয়ন্ত্রণ করে সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়। এটি নিয়ন্ত্রণ করার কথা ছিল শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের। এছাড়া শিক্ষকের অভাবে অনেক ক্ষেত্রে শিক্ষার্থী ঝরে পড়া। পাহাড়ি ও উপজাতি এলাকায় এ ধরনের ঘটনা ঘটে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক মাসুদা এম. রশিদ চৌধুরী বলেন, শিক্ষার ক্ষেত্রে বর্তমানে খরচ অনেক বেড়ে গেছে। সরকার বিনামূল্যে বই দিলেও অন্যান্য প্রাসঙ্গিক জিনিসপত্রের দাম বহুগুণ বেড়ে গেছে। ফলে গরিব মানুষ শিক্ষার পরবর্তে কাজকেই প্রাধান্য দিচ্ছে। এছাড়া চাকরির অনিশ্চয়তাও ঝরে পড়ার অন্যতম কারণ হিসেবে কাজ করছে।