বাংলাভুমি২৪ ডেস্ক ॥ চাকরিতে যোগ দিতে এসে রীতিমতো ধাক্কা খেলেন বাংলা সিনেমার নায়ক। বসের আসনে বসে আছেন সুন্দরী আধুনিক এক তরুণী। এই ধাক্কা খাওয়াটা যেমন আমাদের সংস্কৃতির অংশ, তেমনি শেষাবধি সলজ্জ বধূ সেজে নায়কের বাহুলগ্নায় পরিণত হওয়ার মাধ্যমে সেই সংস্কৃতিরই জয়জয়কার হবে সিনেমার শেষে। নারী শেষমেশ তাঁর তথাকথিত চিরায়ত চেহারায় ফিরে না আসা পর্যন্ত জনতার চোখ স্বস্তি পাবে না।
নারীকে নিজের চেয়ে ওপরে বা উচ্চাসনে দেখতে এখনো চোখ দুটো যে অতটা অভ্যস্ত হয়ে ওঠেনি। তাই অফিসে উঁচু পদটিতে একজন নারী বসে থাকলে আড়ালে-আবডালে নিচের মন্তব্যগুলো শোনা হয়তো খুব একটা অস্বাভাবিক ব্যাপার নয়।
এক. মেয়ে বলেই না বসদের পটিয়ে প্রমোশন জোগাড় করে আজ ওইখানে উঠেছেন। মেয়ে হয়ে জন্ম নিলে যে কত লাভ!
দুই. ভাবসাব দেখে মনে হয় যেন মার্গারেট থেচার! কই, পুরুষ বসদের তো এত ভাব থাকে না।
তিন. আরে অফিসের কী অবস্থা হয়েছে, দেখছি তো। কোনো শৃঙ্খলা নেই। থাকবে কী করে, বস মেয়ে হলে এমনই হয়।
চার. ঝাড়ি খেয়ে মন খারাপ করলেও নিজেকে ভাগ্যবানই মনে হচ্ছে ভাই। ওনার বেচারা স্বামীর কথাটা ভাবুন! না জানি তাঁর কী অবস্থা!
ঠিক এভাবে উচ্চপদে আসীন নারীর যোগ্যতা, মর্যাদা ও অর্জন-সবকিছু পরিমাপ করার জন্য আমাদের সমাজে একটা পুরুষের চোখ আছে। সেই চোখ দিয়ে আমরা নারী-পুরুষ সবাই একইভাবে দেখি। তাই তাঁর অর্জনের মধ্যেও দোষ খুঁজে পাই। তাঁর অফিসিয়াল আচরণের সঙ্গে ব্যক্তিগত ও পারিবারিক বিষয়গুলোকে গুলিয়ে ফেলি। শেষ পর্যন্ত তিনি একজন নারী-এই পরিচয়টাই সর্বস্ব হয়ে ওঠে। একটা ঈর্ষণীয় অবস্থানে থেকেও তিনি তাঁর নারীত্বের ওই গণ্ডি থেকে কিছুতেই বেরিয়ে আসতে পারেন না। কিন্তু আজকের এই সময়ে বস হিসেবে একজন নারীকে সহকর্মী বা অধস্তনরা কীভাবে দেখেন?
এ প্রসঙ্গে কিউবির গ্রাহকসেবা বিভাগের জ্যেষ্ঠ নির্বাহী জাকিয়া আহমেদ বলেন, ‘আসলে ঊর্ধ্বতন মানুষ একজন ”মানুষ” হিসেবে কেমন, তার ওপর অনেক কিছুই নির্ভর করে। কয়েক বছরে নারী বস ও পুরুষ বস-দুই রকমই পেয়েছি। পুরুষ বস খারাপ লাগেনি, তবে অনেক বেশি স্বচ্ছন্দ্য বোধ করেছি নারী বসের সান্নিধ্যে এসে। অনেক কিছুই বন্ধুর মতো ভাগ করে নিতে পেরেছি, আন্তরিক হতে পেরেছি। আবার এটা ঠিক যে দেখেছি, ছেলেরা হয়তো অতটা সৌহার্দ্যপূর্ণ হতে পারছে না নারী বসের সঙ্গে। হয়তো পুরুষ বসের সঙ্গে তারা নিজেদের ভাষায় কৌতুক করছে, হাসাহাসি করছে; কিন্তু নারী বসের সামনে একটু সংকুচিত হয়ে থাকছে।’
অন্যদিকে, একটি বেসরকারি ব্যাংকে চাকরি করা জুবায়ের রহমানের কাছে মনে হয় যে নারীরা বস হলে একটা আলাদা গাম্ভীর্য ও দূরত্বের খোলস তৈরি করে নেন, হয়তো তা সামাজিক কারণেই। তার ভয় থাকে পুরুষ বসকে অধস্তনরা যেভাবে মেনে চলবেন, তাঁকে হয়তো সেভাবে মানবেন না। তারই পুরোনো সহকর্মী বান্ধবীটি যখন পদোন্নাত পেয়ে ওপরের পদে আসীন হয়েছিলেন, তখন একধরনের দুর্ভেদ্য দেয়াল তৈরি হয়েছিল, জানান জুবায়ের। ‘আগের সেই বন্ধুত্ব বা সৌহার্দ্য আর ছিল না। হয়তো সে ভেবেছে আমি ঈর্ষান্বিত আবার আমি ভেবেছি সে অহংকারী হয়ে উঠছে।’
নিজ নিজ েেত্র উজ্জ্বল, এমন নারীরা অবশ্য তা মনে করেন না। যেমন ডেল বাংলাদেশের কান্ট্রি ম্যানেজার ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা সোনিয়া বশির কবীরের মতে, ‘বাংলাদেশের ছেলেরা বরং বাইরের অনেক ছেলের চেয়ে মেয়েদের বেশি সম্মান করতে জানে। তারা বন্ধুবৎসল এবং বর্তমানকালের পরিপ্রেেিত বলব, অবশ্য অনেকটা উদার।’ নিজের কাজের জায়গায় কাস্টমার, পার্টনার বা অধস্তন-কোনো প থেকেই অসহযোগিতা অনুভব করেননি তিনি। তাঁর মতে, বস পুরুষই হোন বা নারী, সত্যিকারের নেতৃত্ব দেওয়ার মতা থাকতে হবে। একই সঙ্গে তিনি বন্ধুর মতো হবেন, আবার প্রয়োজনে কঠোরও হতে পারবেন। যোগ্যতা না থাকলে তিনি পুরুষ বা নারী-যে-ই হোন না কেন, আস্থার জায়গাটা হারাবেন।
প্রায় একই মত বিসিআইসির মানবসম্পদ বিভাগের প্রধান পিয়াল চৌধুরীর। তাঁর মতে, কর্মেেত্র আস্থা ও শ্রদ্ধার জায়গাটা অর্জন করতে একজন পুরুষের তুলনায় একজন নারীকে অনেক বেশি সংগ্রাম করতে হয়। ঘরে-বাইরে সর্বত্র তাঁকে শুধু যোগ্যতাটা প্রমাণ করলেই চলে না, বরং একই সঙ্গে লড়াই করতে হয় প্রচলিত সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গির বিরুদ্ধেও। তবেই তিনি ওই জায়গায় যেতে পারেন।