শুক্রবার , ১৯শে এপ্রিল, ২০২৪ , ৬ই বৈশাখ, ১৪৩১ , ৯ই শাওয়াল, ১৪৪৫

হোম > গ্যালারীর খবর > বাংলাদেশের প্রতিটি রাস্তা অবরোধ করা হবে: হেফাজত

বাংলাদেশের প্রতিটি রাস্তা অবরোধ করা হবে: হেফাজত

শেয়ার করুন

বাংলাভূমি ডেস্ক ॥
‘দেরিতে হলেও সরকার তাদের কাছে পরাজিত হয়েছে। তাই সরকারের কাছ থেকে দাবি আদায়ের এটি উপযুক্ত সময়। যে সরকার তাদের চরম নির্যাতনের মুখে শাপলা চত্বর থেকে তুলে দিয়েছিল, সেই সরকারের কাছ থেকেই ফের শাপলা চত্বরে সমাবেশের অনুমতি আদায় করতে হবে।’
হেফাজতে ইসলাম নিয়ন্ত্রিত হাটহাজারী মাদ্রাসায় সম্প্রতি অনুষ্ঠিত একটি ঘরোয়া বৈঠকে উপস্থিত হেফাজত নেতারা এসব কথা বলেন। এ ছাড়া হেফাজত নেতাদের সঙ্গে অপর এক ঘনিষ্ঠ আলোচনায় ইসলামী আন্দোলনের নেতা মুফতি ফয়জুল করীম বলেন, ‘আপনারা অপেক্ষায় থাকেন। ডাক দেয়া হবে। প্রস্তুত থাকিয়েন। চোখ কান খোলা রাখবেন। কর্মসূচি আসবে।’ তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশের প্রতিটি রাস্তা অবরোধ করা হবে। বাধা দিতে আসুক কে বাধা দেবে।’

ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও হেফাজতে ইসলামের সঙ্গে সাম্প্রতিক সমঝোতা উদ্যোগের দৃশ্যপটের সঙ্গে এ ধরনের বক্তব্য একেবারে অবিশ্বাস্য। কিন্তু এটিই বাস্তব। অনুসন্ধানে এমন চাঞ্চল্যকর তথ্য বেরিয়ে এসেছে। আর হেফাজত নেতাদের এমন সব মন্তব্য আরও একবার প্রমাণ করল তারা বর্তমানে প্রকাশ্যে সরকারের সঙ্গে এক ধরনের আপস করলেও পর্দার আড়ালে আগের অবস্থানে অনড়।

সূত্র জানায়, ২০১৩ সালের ৫ মে মতিঝিলের শাপলা চত্বরে ব্যাপক পুলিশি অ্যাকশনের মুখে হেফাজতের কয়েক লাখ নেতাকর্মী পিছু হটলেও ভেতরকার অবস্থান পাল্টায়নি। নানা প্রেক্ষাপট ও স্বার্থ বিবেচনায় নিয়ে গত চার বছরে সরকার ও হেফাজতের মধ্যে এক ধরনের ছাড় দেয়ার গোপন রাজনীতি চলে। এরই ধারাবাহিকতায় সম্প্রতি প্রকাশ্য দেখা সাক্ষাতের মধ্য দিয়ে বিষয়টি দেশজুড়ে আলোচনায় আসে। আর দেশবাসী স্পষ্টত জানতে পারে, পরিবর্তিত পরিস্থিতি হেফাজতে ইসলামকে সুবিধাজনক অবস্থান এনে দিয়েছে। আর এ সুযোগ কাজে লাগিয়ে সংগঠনটি তাদের হারানো মর্যাদা পুনরুদ্ধারের পথে হাঁটছে।

বিশ্বস্ত সূত্রে জানা গেছে, হেফাজত এখন শাপলা চত্ব¡রেই আরেকটি বড় সমাবেশের ছক আঁকছে। সরকারের সমঝোতা উদ্যোগকে কাজে লাগিয়ে তারা সমাবেশ করার অনুমতি আদায় করতে ইতিমধ্যে দেনদরবারও শুরু করেছে। এ লক্ষ্যে সংগঠনের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের নেতারা বেশ কয়েক দফা নিজেদের মধ্যে গোপন বৈঠক করেন। কিš‘ এসব বৈঠকেই তাদের আসল চেহারা বেরিয়ে আসে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বৈঠকে উপস্থিত সূত্র তথ্য-উপাত্ত দিয়ে জানায়, সরকারের নমনীয় মনোভাবকে হেফাজত নেতারা তাদের দীর্ঘ আন্দোলনের বিজয় হিসেবে দেখছেন। শুধু তাই নয়, একাধিক হেফাজত নেতা সম্প্রতি কয়েকটি ঘরোয়া আলোচনায় বলেন, ‘যে সরকার তাদের চরম নির্যাতনের মুখে শাপলা চত্ব¡র থেকে তুলে দিয়েছিল সেই সরকারের কাছ থেকেই ফের শাপলা চত্বরে সমাবেশের অনুমতি আদায় করতে হবে। সরকার অনুমতি দিলে ভালো। না দিলে এখনই রাজপথে না নেমে ‘আদালত মূর্তি’ ইস্যু কাজে লাগাতে চান তারা।’

এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে হেফাজতে ইসলামের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক মাওলানা আজিজুল হক ইসলামাবাদী সোমবার বলেন, ‘শাপলা চত্বরে তারা যে আন্দোলন করেছিলেন সেটা ছিল ইসলামবিদ্বেষী নাস্তিক-ব্লগারদের বিরুদ্ধে। কারণ শাহবাগে নাস্তিক-ব্লগাররা রাস্তায় বসে আন্দোলনের নামে ‘বিকল্প সরকার’ ব্যবস্থা চালু করেছিল। অথচ সরকার সেখানে নির্দয় হামলা চালিয়ে সমাবেশ প- করে। তাই হেফাজতে ইসলাম সরকারের সেই হামলার ইতিহাস কখনও ভুলবে না। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, বর্তমান সরকারের ওপর তাদের আস্থা ফিরেছে কিংবা সরকার হেফাজতের প্রতি নমনীয় হয়েছে- এটা এখনই বলা যাচ্ছে না। অতীত কর্মকা-ের কারণে বর্তমান সরকারের ওপর হেফাজত আস্থাহীন। বর্তমানে সরকার তাদের সঙ্গে যে আচরণ করছে তা ভবিষ্যতে কতটুকু অব্যাহত থাকবে সেটার ওপর নির্ভর করবে এই সরকারকে তারা কতটুকু আস্থায় রাখবেন বা আদৌ রাখবে কিনা। হেফাজতের এক জ্যেষ্ঠ নেতা অনুসন্ধানী টিমকে বলেন, ‘সরকারের সঙ্গে হাত মিলিয়ে বসে থাকার মতো অবস্থায় হেফাজত নেই। বরং তারা অনুকূল পটভূমি তৈরিতে কাজ করছেন।’

সংগঠনের একাধিক গোপনীয় বৈঠকে অংশ নেয়া এক নেতা বলেন, ‘তাদের বেশিরভাগ নেতা বর্তমান সরকারের প্রতি আস্থাহীন।’ অপর এক ঘরোয়া বৈঠকে হেফাজতের মহাসচিব আল্লামা জুনায়েদ বাবুনগরী মর্মস্পর্শী ভাষায় গ্রেফতারের পর তার ওপর চালানো পুলিশি নির্যাতনের বর্ণনা দেন। তার বক্তব্যের সময় অন্য হেফাজত নেতারা কান্নায় ভেঙে পড়েন। বৈঠক শেষে তারা বিশেষ মোনাজাত করেন।’

এক বৈঠকে মাওলানা আবদুল বারী রশীদি নামের এক নেতা সরকারের প্রতি চরম ক্ষুব্ধ মনোভাব প্রকাশ করে বলেন, ‘হুজুররা সব পারে। সময় হলে বাংলাদেশের সংসদ হুজুররা দখল করবে।’ আরেক নেতা বলেন, ‘এই বাংলার মাটিতে আলেমের রক্ত যতদিন পড়েনি ততদিন জালেমরা ক্ষমতায় ছিল। এখন আলেমের রক্ত পড়া শুরু হয়েছে। তাই বাংলাদেশের মাটিতে ইসলামের পতাকা পত পত করে উড়বে। কারও বাপের ক্ষমতা নেই তা ঠেকাতে পারে।’

হেফাজতের কয়েক নেতা বিচ্ছিন্নভাবে ভিন্নমতাদর্শী কয়েকটি বড় ইসলামী সংগঠনের শীর্ষ নেতার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ রাখছেন। এদের অন্যতম হলেন মুফতি ফয়জুল করীমের ইসলামী আন্দোলন। এছাড়া ইসলামী শাসনতন্ত্র আন্দোলনের যুগ্ম মহাসচিব মাওলানা এটিএম হেমায়েত উদ্দিন এক ঘরোয়া আলোচনায় বলেন, ‘দেশের সর্বোচ্চ আদালত প্রাঙ্গণে মূর্তি স্থাপন মুসলিম চেতনার পরিপন্থী। অবিলম্বে মূর্তি অপসারণ করতে হবে।’

এদিকে সূত্র জানায়, হেফাজতের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা ও বিশেষ যোগাযোগ রক্ষা করে চলছে এমন ২০ ব্যক্তি ও সংগঠনকে চিহ্নিত করেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। এ সংক্রান্ত একটি তালিকা আসে। তালিকার প্রথম সারিতে আছেন এমন ব্যক্তি আহমাদ আবদুল্লাহ আবদুল্লাহ, এমএম নূর হোসাইন, শেখ মাহবুব নাহিয়ান, আবু নুসাইবা, এম ওয়ালিউল্লাহ তালুকদার, মাহমুদুল হাসান হাফিজ, মাওলানা শহীদুল ইসলাম কাসেমী, জিসান চিস্তি, এমএইচএম আবদুল মুকিত ও শাহ জাহান আলী। এদের সবাই বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সক্রিয় থেকে সরকারবিরোধী প্রচারণা চালাচ্ছেন। তারা শুধু সরকার নয়, অন্য ইসলামী দলগুলোর ভূমিকার তীব্র সমালোচনা করেন। এক নেতার বক্তব্য হচ্ছে- ‘ড্রাইভারের বিরুদ্ধে রায় হওয়ার কারণে পুরো বাংলাদেশ অচল হয়। একজন আলেম জেলে গেলে চার লাখ মসজিদের ইমাম যদি বলতেন আমরা নামাজ পড়াব না। মোয়াজ্জিন যদি বলতেন আমরা আজান দেব না। মাদ্রাসায় পড়াব না। তাহলে একজন আলেমকেও কেউ জেলখানায় বন্দি রাখতে পারত না।’

অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে, হেফাজত নিয়ন্ত্রিত কওমি মাদ্রাসাগুলোর শিক্ষার্থীরা তাদের সনদের সরকারি স্বীকৃতিতে তেমন উদ্বেলিত নন। সনদের মাস্টার্সের স্বীকৃতিকে তারা কোনো প্রাপ্তি হিসেবেও দেখেন না। হাটহাজারী মাদ্রাসার একাধিক শিক্ষার্থীর সঙ্গে  অনুসন্ধানী টিমের কথা হয়। তাদের বক্তব্য হচ্ছে, ‘এভাবে সমমর্যাদার মাধ্যমে তারা তাগুদি (মূল ধারার আধুনিক শিক্ষা) শিক্ষার সঙ্গে নিজেদের শিক্ষাকে মেলাতে চান না। আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য তারা কোরআন হাদিসের শিক্ষা নেন। তাদের শিক্ষা মূলত যিনি দুনিয়ার মালিক তাকে খুশি রাখার জন্য।’

এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে হেফাজতের শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ বিষয়ক সম্পাদক মুফতি হারুন ইজহার সোমবার  বলেন, ‘বর্তমান সরকার কওমি সনদের স্বীকৃতি দিয়েছে, তাই বলে যে এ সরকারকে হেফাজত সবকিছু উজাড় করে দেবে তা কখনই হবে না। তা ছাড়া কওমি সনদের সরকারি স্বীকৃতির জন্য বিগত বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার গেজেট প্রকাশ করেও তা বাস্তবায়ন করেনি। কিন্তু এতে তাদের তেমন কোনো ক্ষতি হয়নি।’ এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘তবে বর্তমান সরকার সনদের স্বীকৃতি দেয়ায় সরকারের প্রতি কিছুটা হলেও তাদের সহমর্মিতা সৃষ্টি হয়েছে।’

যুগান্তর থেকে নেয়া