শুক্রবার , ১৯শে এপ্রিল, ২০২৪ , ৬ই বৈশাখ, ১৪৩১ , ৯ই শাওয়াল, ১৪৪৫

হোম > Uncategorized > বিএনপির সঙ্গে থাকছে না জামায়াত?

বিএনপির সঙ্গে থাকছে না জামায়াত?

শেয়ার করুন

কাজী সিরাজ
ঢাকা : বিএনপি-জামায়াত সম্পর্কের টানাপড়েন নিয়ে বেশ কথা হচ্ছে রাজনৈতিক মহলে। পত্র-পত্রিকা এবং টিভি চ্যানেলের টকশোতেও বিষয়টি বেশ গুরুত্বসহকারে উঠে আসছে। বেশ ক’মাস ধরেই গুঞ্জন চলছিল, সরকারের সঙ্গে জামায়াতের অথবা জামায়াতের সঙ্গে সরকারের তলে তলে একটা সমঝোতা বা আঁতাত হয়েছে। প্রায় মাস পাঁচ-ছয়েক আগে পিরোজপুরের এক জনসভায় বিএনপি চেয়ারপারসন স্বয়ং প্রসঙ্গটি পাবলিক করেছিলেন। দুই মাস আগে জোটের এক সভায় জামায়াতে ইসলামীর প্রতিনিধিত্বকারী নেতার কাছে বেগম খালেদা জিয়া সরকারের সঙ্গে জামায়াতের কোনো প্রকার আঁতাত হয়েছে কিনা জানতে চেয়েছিলেন। জামায়াত নেতা বিষয়টি অস্বীকার করলেও সন্দেহের বৃক্ষটি দিন দিন আকারে-আয়তনে বৃদ্ধিই পাচ্ছে। উপজেলা নির্বাচনকালে আঁতাতের কিছু প্রমাণ পাওয়া গেছে। বগুড়ায় বিএনপিকে সরাসরি চ্যালেঞ্জ করেছে জামায়াত। আওয়ামী লীগের সমর্থন-সহযোগিতায় দুর্গেই বিএনপির ওপর ‘কামান দাগিয়ে’ কুপোকাত করেছে জামায়াত। শহীদ জিয়ার জন্মস্থানে বিএনপির দুই চেয়ারম্যান প্রার্থীকে ধারাশায়ী করেছেন জামায়াত প্রার্থীরা। প্রায় অর্ধশত উপজেলায় জামায়াত ভাইস চেয়ারম্যান পদ নিয়ে চেয়ারম্যান পদ ছেড়ে দিয়েছে আওয়ামী লীগকে এবং সমঝোতার ভিত্তিতে জিতেছেও। এই সমঝোতার ভিত্তিতেই শ’খানেক ভাইস চেয়ারম্যান পদে জামায়াত প্রার্থীরা জয় পেয়েছে বলে ধারণা করা হয়। জামায়াতে ইসলামীর এই ‘চুলুবুলু’ বিএনপির জামায়াতপ্রিয় কেন্দ্রীয় নেতারা হজম করে নিলেও তৃণমূল সংগঠনের নেতা-কর্মীরা মেনে নিতে পারছে না। বিএনপির মধ্যে মুক্তিযোদ্ধা এবং মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের দেশপ্রেমিক গণতন্ত্রীরা জামায়াতে ইসলামীর এই আচরণকে সন্দেহের চোখেই দেখে আসছেন। দিন দিন এটা স্পষ্ট হচ্ছে যে, এই সন্দেহ অমূলক নয়।

জামায়াতে ইসলামীর সাবেক আমির অধ্যাপক গোলাম আযম একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল কর্তৃক দণ্ডিত হয়ে ৯০ বছরের কারাভোগ করছিলেন। ২৩ অক্টোবর দণ্ডিত অপরাধী হিসেবে বন্দীদশায় তার মৃত্যু হয়। এর পর কিছু তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা থেকে সরকার-জামায়াত আঁতাতের বিষয়টি জনগণের কাছে অনেকটাই স্পষ্ট হয়ে গেছে বলে মনে হয়। ঘটনাগুলো পর পর সাজালে দাঁড়ায় : এক. সরকারি আনুকূল্যে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সতর্ক প্রহরায় বায়তুল মোকাররমে মরহুম গোলাম আযমের বিশাল জানাজা। দুই দিন প্রস্তুতি নিয়ে সারা দেশ থেকে লোক জড়ো করে সাংগঠনিক শক্তিমত্তা ও জনসমর্থন প্রমাণে তাদের শোডাউন করার সুযোগ দিয়েছে লীগ সরকার। কোথাও কোনো প্রকার প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করা হয়নি; দুই. জানাজা শেষে গোলাম আযমের পুত্র আমান আযমীর প্রধানমন্ত্রীকে ধন্যবাদ জ্ঞাপন। এটা কাউকে বুঝিয়ে বলার প্রয়োজন নেই যে, জানাজা আয়োজনে প্রয়োজনীয় সর্বতো সহযোগিতার জন্যই এই ধন্যবাদ জ্ঞাপন। সভা-সমাবেশে, জমায়েতে-জানাজায় যারা উপস্থিত হন, উদ্যোক্তা-সংগঠক বা পরিবারের পক্ষ থেকে তাদের ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানানোর রেওয়াজটাই প্রচলিত। যিনি জানাজায় উপস্থিতই ছিলেন না তাকে ধন্যবাদ জানানোর কেন তাগিদ অনুভব করলেন গোলাম আযমপুত্র আমান আযমী? সহজভাবে বিষয়টি বোঝার জন্য একটা উদাহরণ বোধহয় উল্লেখ করা যায়। কোনো সামাজিক বা অন্য যে কোনো অনুষ্ঠানে প্রকাশ্যে জড়িত নন এবং অনুষ্ঠানে অনুপস্থিত ব্যক্তির বন্দনা করা হয় এই কথাটি বোঝানোর জন্য যে, এই ব্যক্তি বা ব্যক্তিদের যথাযথ আনুকূল্য ছাড়া সফলভাবে অনুষ্ঠানটি করা যেত না। ধন্যবাদপ্রাপ্ত ব্যক্তি কেন সাহায্য করলেন বা আনুকূল্য দিলেন এবং ধন্যবাদ জ্ঞাপনকারী সাহায্য বা আনুকূল্য কেন নিলেন দুই পক্ষের বোঝাপড়াটা সাধারণরা না জানলেও কারণ যে একটা কিছু থাকে তা কিন্তু না বোঝার বিষয় নয়। আর তা যদি রাজনৈতিক ক্ষেত্র হয় তো কথাই নেই। কাজেই গোলাম আযমের জানাজা সফলভাবে সম্পন্নের জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে আমান আযমীর অভিনন্দনের মূল্য মিলিয়ন-বিলিয়ন ডলারে পরিমাপ করা যাবে না। তিন. গোলাম আযমকে বলা হয় জামায়াতে ইসলামীর আধ্যাত্মিক গুরু। তার মৃত্যুতে বিএনপি কোনো প্রকার শোক-সমবেদনা প্রকাশ করেনি, জানাজায়ও শরিক হয়নি। অথচ বিশাল আয়োজন সফল করার ব্যাপারে সরকারের সর্বতো সহায়তা জনগণ স্বচক্ষেই দেখেছে। একমাত্র সরকারি কোনো অনুষ্ঠানেই আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে এমন তৎপর দেখা যায়। চার. বিএনপির বিরুদ্ধে গোলাম আযমের পুত্র আমান আযমীর বিষোদগারও এক্ষেত্রে উল্লেখ করার বিষয়। আমান আযমী দস্তুরমতো বিএনপির প্রতি চ্যালেঞ্জই ছুড়ে দিয়েছেন। তিনি তার ফেসবুক স্ট্যাটাসে লিখেছেন, জামায়াতের সহযোগিতা ছাড়া বিএনপি কখনো সরকার গঠন করতে পারত না, ভবিষ্যতেও পারবে না। অধ্যাপক গোলাম আযমের মৃত্যুতে গোটা বিশ্ব শোকাভিভূত হলেও বিএনপির নীরবতায় সমগ্র জাতি হতাশ হয়েছে। ‘তারেকের নির্দেশে আযমের জানাজা বর্জন করল বিএনপি’ শিরোনামে একটি অনলাইন পত্রিকায় প্রকাশিত খবরের ওপর ভিত্তি করে ২৯ অক্টোবর বুধবার তিনি ফেসবুকে এই স্ট্যাটাস দেন। স্ট্যাটাসটি হুবহু এমন “ঞযব যড়ষব হধঃরড়হ রং ফরংধঢ়ঢ়ড়রহঃবফ ধঃ ইঘচ’ং ংরষবহপব ধভঃবৎ ঢ়ৎড়ভ. এযড়ষধস অুধস বীঢ়রৎবফ ধষঃযড়ঁময ঃযব বহঃরৎব ড়িৎষফ রং সড়ঁৎরহম. ষস হড়ঃ ংঁৎব যিু? ও যধাব হড় যবংরঃধঃরড়হ রহ ংধুরহম ঃযধঃ ইঘচ পড়ঁষফ হবাবৎ ভড়ৎস মড়াঃ. রিঃযড়ঁঃ ঔধসধধঃ’ং ংঁঢ়ঢ়ড়ৎঃ. ংধফষু বহড়ঁময, ঃযবরৎ ংরষবহপব ড়হ ঃযব ফবধঃয ড়ভ ভড়ঁহফবৎ অসরৎ ড়ভ ঃযব ঢ়ধৎঃু ধহফ ংঢ়রৎরঃঁধষ এঁৎঁ ঃরষষ যরং ফবধঃয রং ঁঃঃধৎষু ঁহবীঢ়বপঃবফ ধহফ ঁহধপপবঢ়ঃধনষব. ইঘচ রিষষ ফড় নবঃঃবৎ রভ ঃযবু ৎবসবসনবৎ ঃযধঃ ঃযবু পধহ হবাবৎ মড় ঃড় ঢ়ড়বিৎ ধমধরহ রিঃযড়ঁঃ ঔধসধধঃ’ং ংঁঢ়ঢ়ড়ৎঃ. ঞযরং রং সু ড়ঢ়বহ ঈযধষষবহমব.”
পাঁচ. ২৫ অক্টোবর সংবাদপত্রে প্রকাশিত ইসলামী ছাত্রশিবিরের একটি বিবৃতি- যাতে বলা হয়, মানবতাবিরোধী অপরাধে সাজাপ্রাপ্ত জামায়াতে ইসলামীর সাবেক আমির মরহুম গোলাম আযমের বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরোধিতা করার সিদ্ধান্ত ভুল ছিল। বিবৃতিতে বলা হয়, ‘গোলাম আযমের আলোচিত রাজনৈতিক জীবনকে বিতর্কিত করেছে ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধকালে পাকিস্তানের অখণ্ডতার পক্ষে তার দৃঢ় অবস্থান। তিনি বিশ্বাস করতেন একটি ইসলামিক রাষ্ট্র ভেঙে বাংলাদেশের স্বাধীন হওয়া ঠিক সিদ্ধান্ত নয়।’ ছাত্রশিবিরের সহকারী প্রচার সম্পাদক মো. জামাল উদ্দিন স্বাক্ষরিত সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে আরও বলা হয়, ‘ভারতের শাসকগোষ্ঠীর ভূমিকার কারণে বীতশ্রদ্ধ হয়ে গোলাম আযম স্বাধীনতার বিরোধিতা করার ভুল সিদ্ধান্ত নিয়েছেন মনে করার যথেষ্ট কারণ থাকলেও এ সিদ্ধান্ত তাকে রাজনৈতিকভাবেই ক্ষতিগ্রস্ত করেনি, ব্যক্তিগতভাবেও তাকে এর জন্য দায় মোচন করতে হয়েছে। ঢাকার আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত (আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল) মুক্তিযুদ্ধকালীন কোনো অপরাধে গোলাম আযম সরাসরি জড়িত নন বলে স্বীকার করলেও সুপ্রিম কমান্ড রেসপনসিবিলিটির দায়ে তাকে ৯০ বছরের কারাদণ্ড দিয়েছিলেন। আদালত মনে করেছিলেন, স্বাধীনতার বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়ার কারণে তিনি ও তার দল জামায়াতে ইসলামী মুক্তিযুদ্ধকালীন আন্তর্জাতিক অপরাধের জন্য দায় মোচনে বাধ্য। জীবনের প্রথমদিকে বাংলাদেশের ভাষা আন্দোলনের অন্যতম পথিকৃৎ হিসেবে স্মরণীয় হলেও শেষ পর্যন্ত আদালতের রায়ে একজন যুদ্ধাপরাধী হিসেবে কারাদণ্ড ভোগ করেছেন তিনি’ (বাংলাদেশ প্রতিদিন, ২৫.১০.২০১৪)। ছয়. গালফ নিউজকে দেওয়া প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাম্প্রতিক একটি সাক্ষাৎকার। তাতে তিনি বলেন, ‘দেশের নিরাপত্তার জন্য বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী কোনো হুমকি নয়।’ জামায়াত প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘গত ৬০ বছরে বা তারও বেশি সময়ে ভারতীয় উপমহাদেশে উল্লেখ করার মতো রাজনৈতিক জায়গা করে নিতে পারেনি জামায়াত। আমি মনে করি না যে, এখানে তারা কোনো দিন শক্ত অবস্থান করে নিতে পারবে।’
ঘটনাগুলো বিশ্লেষণ করলে কী দাঁড়ায়? আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের রায়ে এবং পরবর্তীকালে আপিল বিভাগের রায়েও জামায়াত নেতা কাদের মোল্লার ফাঁসির দণ্ড হয় এবং তা কার্যকরও হয়ে যায় যথানিয়মে। কিন্তু কড়া নিরাপত্তাব্যবস্থায় পারিবারিকভাবে স্বল্পসময়ে সীমিত ব্যবস্থাপনায় তার দাফন সম্পন্ন করতে হয়। দলীয়ভাবে জামায়াতকে কোনো রাজনৈতিক সুবিধা নিতে দেওয়া হয়নি। বিএনপির আবদুল আলীম দণ্ডিত অবস্থায় স্বাভাবিক মৃত্যুবরণ করেন। তার লাশ নিয়েও কোনো প্রকার বাড়াবাড়ি বা রাজনীতি করতে দেওয়া হয়নি- এমন কী তার জন্মস্থানেও। কিন্তু গোলাম আযমের ক্ষেত্রে আমরা এ ব্যাপারে ব্যতিক্রম দেখলাম। ঘটা করে দুই দিনের প্রস্তুতি নিয়ে, ব্যাপক প্রচার চালিয়ে সারা দেশ থেকে লোক এনে বিশাল জানাজার আয়োজন করে জামায়াত। দেখে মনে হয়েছে, আয়োজনটা ছিল সরকার-জামায়াত যৌথ আয়োজন। এটা পরিষ্কার যে, গোলাম আযমের লাশ নিয়ে জামায়াতে ইসলামী রাজনীতি করতে চেয়েছে, সরকার তাদের তা করতে দিয়েছে। এ সুযোগে জামায়াত সারা দেশে তাদের ভীতসন্ত্রস্ত তৃণমূল নেতা-কর্মীদের মনোবল চাঙ্গা করতে পেরেছে এবং বিশাল শোডাউনের মাধ্যমে তাদের সাংগঠনিক শক্তিমত্তার পরিচয় তুলে ধরেছে দেশ-দুনিয়ার সামনে। সরকারের অভ্যন্তরে কট্টর জামায়াত-বিরোধীদের এটা বোঝানোর একটা সুযোগও এর মাধ্যমে দেওয়া গেছে যে, এই বিশাল রাজনৈতিক শক্তিকে ‘গুডহিউমারে’ রেখে ক্ষমতায় থাকা নিশ্চিত করা যায়। সরকারি সম্মতি শুধু নয়, সহযোগিতা ছাড়া ঘরছাড়া, পরিবার ছাড়া পালিয়ে বেড়ানো নেতা-কর্মী ও লণ্ডভণ্ড জামায়াতের পক্ষে দুই দিনে এমন সমাবেশের আয়োজন করা সম্ভব হয় কী করে? আত্মগোপনে থাকা জামায়াত নেতারা হঠাৎ প্রকাশ্যে চলে এলেন, মরহুম গোলাম আযমের বাসায় বারবার আসা-যাওয়া করলেন, খোলামাঠে জানাজায় অংশ নিলেন- সবই আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার অসংখ্য সদস্যের চোখের সামনেই। গ্রেফতার করা হবে না, সরকারের তরফ থেকে এমন আশ্বাস না পেলে তা কী করে সম্ভব হলো? গোলাম আযমের ছেলে আমান আযমী যথার্থভাবেই প্রধানমন্ত্রীকে কৃতজ্ঞতা জানিয়েছেন এবং এই ধন্যবাদ জ্ঞাপন ও কৃতজ্ঞতা প্রকাশ লীগ-জামায়াতের মধ্যে গড়ে ওঠা নতুন তাৎপর্যপূর্ণ সম্পর্কের স্মারকবার্তা বলে মনে করার সুযোগ আছে। সম্পর্কের প্রয়োজনীয়তা, গভীরতা বিবেচনা করেই সরকার গোলাম আযমের জানাজায় প্রয়োজনীয় সহযোগিতা দিয়েছে। গোলাম আযমের ছেলে আমান আযমী বিএনপির প্রতি যে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছেন তাও রাজনৈতিকভাবে মূল্যহীন নয়। এর ব্যাখ্যা এভাবেও করা যায়, এবার তাদের সমর্থন নিয়ে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকবে এবং আবারও ক্ষমতায় যাবে। বিএনপির নানা দুর্বলতা এবং জামায়াতের ওপর অতিনির্ভরতার সুযোগ নিয়েই আযমী বিএনপিকে এমন ধমক দিতে পেরেছেন। আযমীর ধমকের পর বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের বক্তব্য অনেকটা কান্নাকাটির মতোই মনে হয়েছে।
এর মধ্যে ইসলামী ছাত্রশিবিরের বিবৃতিটি রাজনৈতিক দিক থেকে অতীব গুরুত্বপূর্ণ। এই বিবৃতিকে শুধু ছাত্রশিবিরের বিবৃতি মনে করে তাদেরই বক্তব্য ভাবার কোনো কারণ নেই। জামায়াত একটি সুশৃঙ্খল সংগঠন- একেবারে মনোলিথিক একটি কমিউনিস্ট পার্টির মতো। শিবিরের ওপর তাদের নিয়ন্ত্রণ দিগন্তপ্লাবিত। জামায়াতের ভাবনার বাইরে শিবির কিছু ভাবে বা ভাববে তা কল্পনাও করা যায় না। সর্বদাই দেখা যায়, শিবিরের মাধ্যমেই জামায়াতের চিন্তা-চেতনা ও লাইন অব অ্যাকশনের প্রকাশ্য প্রতিফলন ঘটে। বিবৃতিটি শিবির অস্বীকার করেনি; জামায়াতও তা ডিজওউন করেনি। তা হলে এর অন্তর্নিহিত রাজনীতিটি বুঝতে কী খুব অসুবিধা হওয়ার কথা? এই বিবৃতির মাধ্যমে এটাই বোধহয় স্পষ্ট করা হলো যে, একাত্তরের স্বাধীনতা যুদ্ধ প্রশ্নে জামায়াত তার অবস্থান পাল্টাচ্ছে। বর্তমান জামায়াতকে অন্যভাবে ঢেলে সাজানো হবে, যে জামায়াত তাদের প্রবীণ নেতাদের একাত্তরের দায় আর বহন করবে না। এই উদ্দেশ্যে জামায়াতে ইসলামীর নেতৃত্বেও পরিবর্তন আসতে পারে। শোনা যায়, নতুন নেতৃত্বে প্রবীণদের বিশেষ করে মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে ভূমিকা পালনকারী কাউকেই রাখা হবে না। এমন কী বিস্মিত হওয়ার কিছু থাকবে না, পুনর্বিন্যস্ত জামায়াত যদি একাত্তরের চেতনা ধারণ করার কথাও বলে। একটি সূত্রে জানা গেছে, জামায়াতের পুরনো শুরা কমিটির স্থলে নতুন শুরা কমিটি গঠন করা হয়ে গেছে ইতিমধ্যে। সেখানে আছেন সব অপেক্ষাকৃত তরুণরা- যাদের পেছনে আছেন দলটির ব্যবসায়ী নেতা-পৃষ্ঠপোষক, বিভিন্ন ব্যাংক, বীমা, হাসপাতাল, ক্লিনিক, পরিবহনসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত ও সফল দলীয় উদ্যোক্তারা। এদের সামনে এখন দলের মানবতাবিরোধী অপরাধে দণ্ডিত প্রবীণ নেতাদের প্রাণ রক্ষার চেয়েও বেশি প্রয়োজন সারা দেশে জামায়াত-শিবিরের যে সাংগঠনিক শক্তি গড়ে উঠেছে সেই শক্তি এবং তাদের শক্তিশালী আর্থিক নেটওয়ার্ক রক্ষা করা। এ জন্য সরকারের সঙ্গে তাদের একটা সমঝোতা হওয়া বিচিত্র কিছু নয়। জামায়াতকে এ মুহূর্তে কাজে লাগানো সরকারের জন্য দরকারি বলেও মনে করছেন অনেক রাজনৈতিক বিশ্লেষক। আর জামায়াতের পরিবর্তিত রূপ যদি এমন হয় যে, তারা অতীতের ভুল স্বীকার করে (শিবিরের বিবৃতির মাধ্যমে তারা তা স্পস্ট করেছে বলে মনে হয়) নিজেদের মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী শক্তি নয় বলে ঘোষণা করে, তাহলে তাদের সঙ্গে একটি কৌশলগত রাজনৈতিক সমঝোতায় লীগ সরকারেরও কোনো অসুবিধা থাকে না। তবে যুদ্ধাপরাধীদের ব্যাপারে কোনো ছাড় না দেওয়ার এবং না চাওয়ার একটা সূক্ষ্ম সমঝোতাও হয়ে থাকতে পারে সরকার-জামায়াতের মধ্যে। এটা সত্য যে, শাসক লীগ জামায়াতকে নিয়ে কোনো জোট করবে না বিএনপির মতো। তাদের লক্ষ্য হবে জামায়াতকে ২০ দলীয় জোট থেকে বের করে আনা। এই ক্ষেত্রে জামায়াতে ছোটখাটো একটা ভাঙনও হতে পারে এবং মূল জামায়াত স্বনামে বা নতুন নামে ৩০০ আসনে নির্বাচনের ঘোষণা দিয়ে জোট ছাড়তে পারে এবং ক্ষুদ্র একটি ভগ্নাংশ ২০ দলীয় জোটে থেকে যেতে পারে সনাতন রাজনৈতিক লাইন আঁকড়ে থেকে। গালফ নিউজকে দেওয়া প্রধানমন্ত্রীর সাক্ষাৎকারটিও এ প্রসঙ্গে খুব তাৎপর্যপূর্ণ। তিনি জামায়াতে ইসলামীকে এখন আর বাংলাদেশের নিরাপত্তার জন্য হুমকি মনে করছেন না। অথচ জেএমবি, হুজিসহ বিভিন্ন জঙ্গি সংগঠন জামায়াতের ‘ঔরসজাত সন্তান’- প্রধানমন্ত্রীর সাম্প্রতিক বিভিন্ন বক্তৃতা বিশ্লেষণ করলে তার অর্থ এমনই দাঁড়ায়। কাজেই এটা ধারণা করা যেতে পারে, জামায়াতের মানবতাবিরোধী অপরাধে দণ্ডিত নেতাদের বিচার, শাস্তি এমন কী ফাঁসির রায় কার্যকরেও জামায়াত-শিবিরের প্রতিক্রিয়া হবে শীতল। হয়তো হরতাল ডাকবে, কিন্তু মাঠে নামবে না, মাঠে নামলেও আগের সহিংস মূর্তিতে অবতীর্ণ হবে না। প্রবীণ নেতাদের একাত্তরের ভূমিকা এবং সেই ভূমিকা যথার্থ ছিল বলে ঔদ্ধত্ব্যপূর্ণ ঘোষণা তাদের অনেক ভুগিয়েছে বলে দলের নতুন প্রজন্মের ধারণা ও বিশ্বাসেরই প্রতিফলন ঘটানোর আয়োজন সম্পন্নপ্রায় বলে শোনা যাচ্ছে। এ মুহূর্তে যেহেতু ক্ষমতায় যাওয়া তাদের লক্ষ্য নয়, তাই যে শক্তি আছে তা অটুট রাখা এবং মূল ধারার রাজনীতির সঙ্গে থেকে আরও শক্তি আহরণের রণকৌশল তারা নিতেই পারে। যার সঙ্গে মৈত্রীতে তাদের লাভ বেশি তারা সেদিকেই যাবে। বলাইবাহুল্য, আত্মরক্ষা, শক্তি সংহতকরণ ও আরও শক্তি আহরণের সুযোগ গ্রহণের জন্য তারা সরকারের সন্তুষ্টি ও সুবিধার পক্ষে অবস্থান নেবে- এটা এখন সময়ের ব্যাপার বলেই মনে হচ্ছে। ৫ জানুয়ারির নজিরবিহীন অস্বাভাবিক নির্বাচনের পর লীগ সরকার জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে খুবই নাজুক একটা অবস্থানের ওপর দাঁড়িয়ে আছে। প্রতিপক্ষকে, বিশেষ করে বিএনপিকে দুর্বল করার কৌশল সরকার নেবেই। সরকার এটা ভাবতেই পারে যে, ২০ দলীয় জোট থেকে জামায়াতকে বের করে আনা গেলে বিএনপির আন্দোলনের অস্ত্র ভোঁতা হয়ে যাবে। বিএনপির বর্তমান পরিত্যক্ত আমলা ও অসাধু ব্যবসায়ী-নির্ভর দুর্বল ও আন্দোলনবিমুখ নেতৃত্ব যে শেখ হাসিনার সরকারকে হটাতে অক্ষম তা ইতিমধ্যেই প্রমাণিত। নিজেদের অবস্থান দৃঢ় করার জন্য লীগ সরকার জামায়াত-বিযুক্ত বিএনপিকে একটা চ্যালেঞ্জের মুখেও ফেলে দিতে পারে। জাতীয় রাজনীতিতে অপ্রত্যাশিত কিছু না ঘটলে জামায়াত আর বিএনপির সঙ্গে থাকছে না এটা বোধহয় বলাই যায়।
লেখক : সাংবাদিক, কলামিস্ট।
-বিডি-প্রতিদিন