শুক্রবার , ২৯শে মার্চ, ২০২৪ , ১৫ই চৈত্র, ১৪৩০ , ১৮ই রমজান, ১৪৪৫

হোম > Uncategorized > মন্ত্রি-এমপি’র ফোন নেই বিমানবন্দরে সোনা ধরা পড়ছে ১৭ গুণ বেশি

মন্ত্রি-এমপি’র ফোন নেই বিমানবন্দরে সোনা ধরা পড়ছে ১৭ গুণ বেশি

শেয়ার করুন

বাংলাভূমি২৪ ডেস্ক ॥ মাত্র দুই বছরের ব্যবধানে শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে চোরাই স্বর্ণ ধরা পড়ার হার ১৭ গুণ বেড়েছে। কাস্টমস বিভাগের তৎপরতা, সংবাদ মাধ্যমের সজাগ দৃষ্টি আর সর্বোপরি সরকারের কঠোর নির্দেশনার কারণেই ধরা পড়ছে স্বর্ণ চোরাচালান।

একটি হিসাবে দেখানো হয়েছে, ২০০৯ থেকে ২০১২ সাল পর্যন্ত শাহ্জালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে অবৈধভাবে বহন করা ৪৯ কেজি স্বর্ণ আটক করে শুল্ক গোয়েন্দাসহ বিমানবন্দরে কর্তব্যরত বিভিন্ন সংস্থা। আর ২০১৩ থেকে ২০১৪ এর মে মাস পর্যন্ত এর পরিমাণ দাঁড়ায় প্রায় সাড়ে ৮শ কেজি স্বর্ণালংকার ও বার উদ্ধার করা হয়।

“আগেও বাংলাদেশে একই পরিমাণ স্বর্ণ আসতো কিন্তু আইনের শিথীল প্রয়োগের কারণেই তা কম ধরা পড়তো। কাস্টমসরা সদস্যরা নিজেদের পকেট ভারী করে সেগুলোর পাড় করিয়ে দিতো। বাংলানিউজকে একথা বলেছে একটি দায়িত্বশীল সূত্র।

তবে বর্তমানেও যে পরিমান স্বর্ণ চোরাচালান হচ্ছে তার পুরোপুরি ধরা পড়ছে না। কিংবা ধরা পড়লেও তা পুরোপুরি মিডিয়ার সামনে উপস্থাপিত হচ্ছে না।

“প্রতিদিন বিপুল পরিমাণে স্বর্ণ আটক হচ্ছে, তবে কাস্টমস কর্মকর্তারা অর্ধেক নিজের পকেটে ভরে আর বাকি অর্ধেক সাংবাদিকদের দেখায়,” মন্তব্য দায়িত্বশীল সূত্রটির।

তবে বিষয়টি অস্বীকার করেছেন বিমানবন্দরের আর্মড পুলিশ ব্যাটেলিয়নের (এপিবিএন) সিনিয়র একজন এএসপি। তিনি বললেন, “এটা সাধারণ মানুষের মধ্যে চলমান একটি গসিপ। গতানুগতিক কথা। এসব কথার ভিত্তি নেই।”

বর্তমান সময়ে কাস্টমসের চোখ ফাঁকি দেওয়া অপেক্ষাকৃত দুষ্কর আর সে কারণেই সোনা চোরাচালানিরা ধরা পড়ছে, বলেন এই এপিবিএন কর্মকর্তা।

গত দেড় থেকে দুই বছরে স্বর্ণের চালান আটক প্রায় ১৭গুন বেড়ে যাওয়ার পেছনের কারনগুলো উঠে এসেছে বাংলানিউজের অনুসন্ধানে।

এয়ারপোর্ট কাস্টমস, গোয়েন্দা ও নিরাপত্তায় নিয়োজিত কর্মকর্তারা জানান, ৩-৪ বছর আগেও শাহ্জালালে ছিল সরকারিদলের মন্ত্রী-এমপিদের ফোনের ওপর। স্বর্ণের কোন বড় চালান ধরলেই ফোন পেতো শুল্ক, গোয়েন্দাসহ বিমানবন্দরে কর্মরত অন্যান্য সংস্থাসমূহ।

একাধিক দায়িত্বশীল কর্মকর্তা বলেছেন, সে সময় মন্ত্রী-এমপিদের ফোনে অনেক বড় বড় চালান ছেড়ে দিতে হতো।

বিমানবন্দরের কর্মরত এপিবিএনের এক কর্মকর্তা বললেন, “আগে স্বর্ণের কোন চালান আসার আগেই মন্ত্রী, এমপি, সচিবসহ বিভিন্ন মহল থেকে উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা ফোন দিয়ে সতর্ক করে রাখতেন। ছেড়ে দেওয়ার সুপারিশ করতেন। বর্তমানে এমনটা হয় না বললেই চলে।

এছাড়াও স্বর্ণের সন্ধান পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মিডিয়াকে (গণমাধ্যম) খবর দেওয়া হয়। মিডিয়ায় ‘ধরা’ খাওয়ার ভয়ে এখন স্বর্ণ ছেড়ে দিতে কেউ সুপারিশ করে না, বলেন নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ওই কর্মকর্তা।

তিনি আরও বলেন, “মিডিয়ার ভয়ে স্বনামধন্য ব্যক্তি কিংবা সরকারী কর্মচারী, অনেকে স্বর্ণের মালিকানাও স্বীকার করে না। শাহ্জালালে আটককৃত ১২৫ ও ১০৫ কেজির স্বর্ণের দুটি বড় চালানের কোন দাবিদারই পাওয়া যায়নি।”

মিডিয়ার সতর্ক দৃষ্টির কারণেই আজ এতো পরিমাণে স্বর্ণ আটক করা সম্ভব হচ্ছে বলে মত এই কর্মকর্তার।

বিশ্বের কয়েকটি দেশে বাংলাদেশের চেয়ে কম দামে স্বর্ণ বিকানোর কারণেই ওইসব দেশ থেকে স্বর্ণ আনা হচ্ছে।

এশিয়া ও মধ্যপ্রাচ্যের এসব দেশে স্বর্ণের দাম ভরি প্রতি ১৪ হাজার টাকা কম বলে জানিয়েছে স্বর্ণ ব্যবসায়ী সূত্র।

বাংলাদেশে ২২ ক্যারেটের ১ ভরি (১১.৬৬৪ গ্রাম) স্বর্ণের চলতি বাজার দর ৪৮ হাজার টাকা। সিঙ্গাপুরে সমপরিমাণ স্বর্ণের দাম ৩৪, ৫০০ টাকা।

বিদেশ থেকে কম দামে স্বর্ণ আনার সুযোগ আইনগতভাবেও দেওয়া হয়েছে। তবে তার একটি নির্দিষ্ট পরিমান রয়েছে।

অসাধু ব্যবসায়ীরা সেই বৈধ পরিমানের তোয়াক্কা না করে কেজি-কেজি কখনো মনকে-মন স্বর্ণ নিয়ে আসেন। আর কাস্টমসকে ম্যানেজ করে কিংবা চোখ ফাঁকি দিয়ে এই স্বর্ণ নিয়ে আসেন।

দেশের কাস্টমসের নিয়ম অনুযায়ী একজন ব্যক্তি ব্যবহারের জন্য সর্বোচ্চ ১৭.১৪ ভরি (২০০ গ্রাম) পর্যন্ত স্বর্ণালংকার বাংলাদেশে আনতে পারেন। অর্থাৎ যে কেউ সিঙ্গাপুর থেকে ভরি প্রতি সর্বনিম্ন ১০ হাজার করে ১৭ ভরিতে প্রায় দেড় লাখের বেশি টাকা লাভ করতে পারবেন।

বাংলাদেশ জুয়েলার্স সমিতির সভাপতি দিলীপ রায় বাংলানিউজকে জানান, মধ্যপ্রাচ্যে বাংলাদেশের অনেক শ্রমিক কর্মরত রয়েছেন। দেশগুলো থেকে বাংলাদেশ থেকে ৬-৭ হাজার টাকা কমে স্বরণ পাওয়া যায়। তাই নিজেদের প্লেনভাড়া তুলতেই তারা বিক্রির উদ্দেশ্যে বাংলাদেশে স্বর্ণ নিয়ে আসেন।

তবে বৈধ পথে অল্প স্বর্ণ আনা হলে তারা বাজারে নানাভাবে প্রতারিত হন। অসাধু স্বর্ণব্যবসায়ীরা তাদের কাছ বাজারমূল্য চেয়ে কমে স্বর্ণ কেনেন।

বাংলানিউজের অনুসন্ধানে জানা যায়, বিমানবন্দর কাস্টমসের পরিসংখ্যান অনুযায়ী বাংলাদেশে গত পাঁচ বছরে কোন স্বর্ণ আমদানি হয়নি। এতেই প্রমাণিত হয় স্বর্ণ ব্যবসায়ীদের অসাধুতা।

একথার সত্যতা স্বীকার করলেন খোদ বাজুস সভাপতি দিলীপ রায়। তিনি বলেন, রিসাইকেলিং করে পাওয়া সোনা আর বিদেশে থেকে যাত্রীদের অবৈধভাবে আনা সোনাই দেশে জুয়েলারি ব্যবসার মূল উৎস।

শুধু সিঙ্গাপুর নয়, এশিয়া ও মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে স্বর্ণের দাম বাংলাদেশ থেকে কম। মালয়শিয়ায় স্বর্ণের ভরি ৩৪,৮০০ টাকা, সৌদিআরবে ৩৪,৭১০ টাকা, কাতারে ৩৫,১৬৯টাকা, কুয়েতে ৩৫,৪০০ টাকা, দুবাইয়ে ৩৮,৬৪০ টাকা, থাইল্যান্ডে ৩৮,০০০ টাকা এবং ভারতে ৪২,০৮৭ টাকা।

ভারত বাদে অন্য সব দেশগুলো থেকে অবৈধভাবে স্বর্ণ আমদানির প্রমাণ পাওয়া গেছে বাংলানিউজের অনুসন্ধানে।

আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে দামের এই তারতম্যের কারণেই অতিরিক্ত লাভের জন্য মানুষ স্বর্ণ বহন করে বলে জানায় বাজুস।

বাংলাদেশে অবৈধপথে স্বর্ণ আসার আরেকটি কারন হচ্ছে কম শুল্ক। বৈধ উপায়ে বাংলাদেশে ২০০ গ্রাম পর্যন্ত স্বর্ণালংকার আনতে কোন শুল্ক দিতে হয় না। তবে সমপরিমাণ বার আনতে প্রতি ১০ গ্রামে ১৫০ টাকা দিতে হয়। শুল্ক দিতেও গায়ে লাগে না।

বাংলাদেশে স্বর্ণ নীতি নেই, তাছাড়া স্বর্ণের নামমাত্র শুল্কর সুবিধাকে কাজে লাগিয়ে অনেকেই বিদেশে ঘুরতে গিয়ে ফেরার সময় ব্যাগভর্তি অলংকার নিয়ে দেশে বিক্রি করেন অনেকেই।

শাহ্জালালে স্বর্ণ উদ্ধারের আরেকটি কারণ উঠে এসেছে অনুসন্ধানে। তা হচ্ছে এপিবিএনের সদস্যদের কার্যক্রম। আগে এয়ারপোর্টে কোন ব্যাটেলিয়ন কাজ করতো না। ফলে কোন প্রশিক্ষণ ছাড়াও বড় অভিযানে গোয়েন্দা কিংবা কাস্টমসের সদস্যরা যেত। তবে গত ২০১১ সাল থেকে বিমানবন্দরে প্রায় ১১শ এপিবিএন সদস্য কাজ করছে।

বড় অপারেশনে তারা কাস্টমসের সঙ্গে সমন্বয় করে কাজ করছেন।

বিমানবন্দরে দৃশ্যমান ২৯ টির বেশি সংস্থা কাজ করলেও আগে তাদের মধ্যে কোন সমন্বয় ছিল না। কয়েকটি তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে সংস্থাগুলো আলাদাভাবে কাজ করতো। তবে ধাপে ধাপে নতুন অফিসার যোগদান করায় সেই রীতি বদলে গেছে। এবং সব সংস্থা এখন একযোগে কাজ করে বলেই স্বর্ণ উদ্ধারের পরিমাণ বেড়েছে, বলেন একজন কর্মকর্তা। বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম