শনিবার , ২০শে এপ্রিল, ২০২৪ , ৭ই বৈশাখ, ১৪৩১ , ১০ই শাওয়াল, ১৪৪৫

হোম > গ্যালারীর খবর > মমতার প্রস্তাবে দুই দেশেই অস্বস্তি

মমতার প্রস্তাবে দুই দেশেই অস্বস্তি

শেয়ার করুন

বাংলাভূমি ডেস্ক ॥
তিস্তার বিকল্প হিসেবে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রস্তাবে উভয় দেশের শীর্ষ পর্যায়ে অস্বস্তি সৃষ্টি হয়েছে। সরকারিভাবে কোনো দেশের কর্মকর্তারাই এ বিষয়ে মন্তব্য করতে চাননি। যদিও মমতা প্রস্তাবটি দিয়েছেনও বেসরকারীভাবে। সাংবাদিকদের মাধ্যমে। তবে ভারতের বিশেষজ্ঞরাই তিস্তা নিয়ে মমতার প্রস্তাবকে গুরুত্ব দিতে নারাজ, তারা বলছেন, এটা কালক্ষেপণের কৌশল

তবে অনানুষ্ঠানিক আলোচনায় মমতা রাজনৈতিক কারণে তিস্তা ইস্যু থেকে দৃষ্টি সরানোর চেষ্টা করছেন বলে মত দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। ওই প্রস্তাবকে তাঁদের অনেকে গুরুত্ব দিতে নারাজ।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সফর শেষ হয়নি বলে বাংলাদেশের কর্মকর্তাদের কেউই তাঁকে দেওয়া মমতার প্রস্তাব নিয়ে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি। একইভাবে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ও এ বিষয়ে কিছু বলতে চায়নি। দুই পক্ষই মনে করছে, দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের শীর্ষ নেতাদের বক্তব্যই নীতিগত অবস্থানের প্রতিফলন।

মমতার প্রস্তাবকে বাংলাদেশ গুরুত্ব দিতে নারাজ তিনটি কারণে। প্রথমত, এই প্রস্তাব ভারতের দিক থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে দেওয়া হয়নি বলে তা ব্যক্তিগত প্রস্তাব। দ্বিতীয়ত, বাংলাদেশ ও ভারতের দুই প্রধানমন্ত্রীর বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি যে আশ্বাস দিয়েছেন, তাতে তিস্তা চুক্তির আশু সমাধানের কথা বলা হয়েছে। তৃতীয়ত, দুই প্রধানমন্ত্রীর যৌথ বিবৃতিতে তিস্তা ছাড়া আরও সাতটি অভিন্ন নদীর পানি বণ্টন নিয়ে দুই দেশের সরকারি কর্মকর্তাদের আলোচনা দ্রুত শেষ করার কথা বলা হয়েছে।

তবে বিশ্লেষকেরা মনে করেন, বাস্তবতা হলো তিস্তা নিয়ে বাংলাদেশের চাওয়াটা আবারও ঝুলে গেল। গত শনিবার দুপুরে নরেন্দ্র মোদি জোর দিয়ে শেখ হাসিনাকে নিয়েই চুক্তিটি সই করার আশ্বাস দেন। তবে রাতে তিস্তার বদলে তোর্সা থেকে পানি নিতে শেখ হাসিনাকে বিকল্প প্রস্তাব দেন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। এর মাধ্যমে মমতা বুঝিয়ে দিলেন, তিস্তা নিয়ে আগের অবস্থান থেকে তিনি একচুলও সরেননি। ২০১১ সালের সেপ্টেম্বরে একেবারে শেষ মুহূর্তে তাঁর বিরোধিতায় চুক্তিটি সই করতে পারেনি কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন মনমোহন সিংয়ের ইউপিএ সরকার।

এবার চুক্তি সই না হলেও শেষ পর্যন্ত কবে তা হবে, এ নিয়ে সুনির্দিষ্ট সময় চেয়েছিল বাংলাদেশ। মোদির আশ্বাসে আভাস আছে, সীমান্তের দুই পারে দুই সরকারের মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেই তা হবে। এটা মেনে নিলে ২০১৮ সালে চুক্তিটি সই হওয়ার কথা। কিন্তু ২০১১ এবং এবারের পরিস্থিতির পর অভিন্ন নদীটির পানি পাওয়াটা শেষ পর্যন্ত অনিশ্চিতই থেকে গেল।

বাংলাদেশের কূটনীতিকদের সঙ্গে শনি ও রোববার কথা বলে বোঝা গেছে, শুধু তিস্তা কেন, গঙ্গা ব্যারাজ ও অববাহিকা ব্যবস্থাপনায় সহযোগিতা নিয়েও হতাশা আছে। প্রায় ছয় বছর আগে তিস্তা নিয়ে দুই দেশ যেখানটায় রাজি ছিল, সেই অবস্থায় থেকে চুক্তিটি সইয়ের জন্য ভারতের কাছে একটি সুনির্দিষ্ট সময়সীমা চেয়েছিল বাংলাদেশ। প্রধানমন্ত্রীর এই সফরে শীর্ষ বৈঠক এবং এর আগের অনানুষ্ঠানিক কয়েকটি বৈঠকেও সেই প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল। সর্বশেষ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দিল্লিতে পৌঁছানোর কয়েক ঘণ্টা আগেও পররাষ্ট্রসচিব মো. শহীদুল হক ভারতের পররাষ্ট্রসচিব জয়শঙ্করের সঙ্গে এ নিয়ে কথা বলেন।

জানা গেছে, তিস্তার মতো গঙ্গা ব্যারাজের ব্যাপারেও সময়সীমা ধরে কাজ করতে চেয়েছিল বাংলাদেশ। যেহেতু ভারত যৌথ সমীক্ষায় রাজি হয়েছে, তাই ডিসেম্বরে গঠিত কারিগরি কমিটির বৈঠকটি মে মাসের মধ্যে করতে চেয়েছিল বাংলাদেশ। যৌথ ঘোষণায় এ নিয়ে বাংলাদেশের প্রস্তাবটি অবশ্য টেকেনি।

সংশ্লিষ্ট একজন কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, শনিবার দুপুরে তিস্তা নিয়ে মোদি যেভাবে দুই সরকার চুক্তি সই করবে বলে আশ্বাস দিয়েছেন, সেভাবেই বক্তব্যটা যৌথ ঘোষণায় রাখার প্রস্তাব দিয়েছিল বাংলাদেশ। ভারত প্রস্তাবটি রাখতে রাজি হয়নি।

শনিবার সন্ধ্যায় দুই প্রধানমন্ত্রীর শীর্ষ বৈঠকের যৌথ ঘোষণা প্রচারের আগে পররাষ্ট্রসচিব মো. শহীদুল হকের কাছে জানতে চাওয়া হয়েছিল, ভারতের প্রধানমন্ত্রীর তিস্তা নিয়ে রাখা বক্তব্যের মূল কথাটা যৌথ ঘোষণায় থাকছে কি না। শহীদুল হক বলেন, কোনো প্রধানমন্ত্রী যখন কোনো অঙ্গীকার করেন, সেটিকে নীতিগত বিবৃতি হিসেবেই ধরে নেওয়া হয়। কাজেই এটা কোনো দলিলে যুক্ত করা প্রয়োজন হয় না।

দীর্ঘসূত্রতার আভাস

এদিকে বিবিসি বাংলাকে গতকাল দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, ‘আমরা নিশ্চয়ই চাই বাংলাদেশ জল পাক। জল দিতে চাই। জল নিয়ে উৎসাহীও আমরা। আমি একটা বিকল্প প্রস্তাব ভেবে দেখতে বলছি সবাইকে। দুই সরকারকেই। আমাদের কিছু ছোট নদী আছে, যেগুলো কখনো জীবনে নারচার হয় নাই এবং যেগুলো দিয়ে বাংলাদেশের সঙ্গে কানেকশনও আছে। এখানে যদি দুটো দেশ স্টাডি করে কোনো ভায়াবেলিটি দেখতে পায়, তাহলে কিছুটা আমরা শেয়ার করতে পারি।’

তাঁর এই সমীক্ষার প্রস্তাবকে বিশেষজ্ঞরা সময়ক্ষেপণ হিসেবেই দেখছেন।

ভারতের উত্তরবঙ্গের নদীপ্রেমিক অভিজিৎ মজুমদার প্রথম আলোকে বলেন, তোর্সা চীন থেকে ভুটান হয়ে আলিপুরদুয়ারে এসে কালচিনি নদীর সঙ্গে মিশে ব্রহ্মপুত্রে প্রবাহিত। তিস্তা থেকে এর দূরত্ব অন্তত ১০০ কিলোমিটার। অভিজিৎ মনে করেন, এটা একটা চমক। সময় নেওয়ার বাহানা।

সম্পর্কটা কৌশলগতর চেয়েও বেশি

যৌথ ঘোষণায় দুই দেশের সম্পর্ককে কৌশলগত সম্পর্কের চেয়েও বেশি বলা হচ্ছে। কিন্তু দুই দেশ প্রতিরক্ষা সহযোগিতার রূপরেখা, সমরাস্ত্র কেনাসহ চারটি সমঝোতা স্মারক সই করে এবার প্রতিরক্ষা সহযোগিতার একটি কাঠামো তৈরি হয়েছে। ফলে এই সহযোগিতা যে এখন কৌশলগত, তাতে কোনো সংশয় নেই। এমনকি গত বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় বাংলাদেশের গণমাধ্যমের সঙ্গে আলাপচারিতায় ভারতের পররাষ্ট্রসচিব জয়শঙ্কর বলেন, দুই দেশের সম্পর্ককে শক্তিশালী করার ব্যাপারে মনোযোগ আছে। সম্পর্কটাকে কৌশলগত সহযোগিতার নিরিখে বিবেচনা করা হচ্ছে। তবে এই সম্পর্কটা এখন শুধু একটা ইস্যুতে সীমাবদ্ধ নয়।

তবে স্পর্শকাতরতা বিবেচনায় মোদি তাঁর ভাষণ এবং দুই দেশের পক্ষ থেকে প্রচারিত যৌথ বিবৃতিতে তিস্তা চুক্তি দ্রুত রূপায়ণের কথা বলেছেন। তিস্তা প্রসঙ্গে বিবৃতিতে বলা হয়েছে, ২০১১ সালের জানুয়ারি মাসে তিস্তার পানি বণ্টনের জন্য যে অন্তর্র্বতী চুক্তি হয়েছিল, তা চূড়ান্ত করার জন্য প্রধানমন্ত্রী মোদিকে প্রধানমন্ত্রী হাসিনা অনুরোধ জানান। প্রধানমন্ত্রী মোদি পুনরায় জানান, চুক্তির আশু রূপায়ণে তাঁর সরকার সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলোর সঙ্গে আলোচনা করছে। দুই প্রধানমন্ত্রীই কর্মকর্তাদের নির্দেশ দেন ফেনী, মনু, মুহুরী, খোয়াই, গুমটি, ধরলা ও দুধকুমারের পানি ভাগাভাগি নিয়ে আলোচনা শেষ করে ফেলতে। ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা এই বিষয়টির উল্লেখ করে বোঝাতে চাইলেন, এখানে অন্য কোনো প্রস্তাবের প্রসঙ্গ নেই। অর্থাৎ মমতার প্রস্তাবটি অপাক্সক্তেয়।

তিস্তা চুক্তি সই না করার সিদ্ধান্ত গ্রহণের পর ২০১১ সালে নদী বিশেষজ্ঞ কল্যাণ রুদ্রকে মমতা এক প্রতিবেদন তৈরির নির্দেশ দেন। কল্যাণ রুদ্রকে গতকাল সকালে মমতার প্রস্তাব নিয়ে প্রশ্ন করা হলে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘মুখ্যমন্ত্রী ঠিক কী বলতে চেয়েছেন, তা আগে স্পষ্ট হওয়া দরকার। আমার কাছে এই বিষয়ে কোনো তথ্য নেই। কাজেই আমার পক্ষে মত দেওয়া সাজে না।’ পরিবেশের কারণে কল্যাণ রুদ্র নদী সংযুক্তকরণের বিরুদ্ধে।

নদী নিয়ে কাজ করে যাওয়া লেখিকা জয়া মিত্রের কাছে মমতার প্রস্তাব ‘নিছকই অর্থহীন’। তিনি বলেন, ‘এত বছর ধরে তিস্তা নিয়ে এত জল ঘোলার পর এখন তোর্সা, ধানসিঁড়ির কথা কেন উঠছে, তা বুঝি না। এটা কি বাড়ির চৌবা”চার জল যে কয়েক কলসি দিয়ে দিলাম?’

বাংলাদেশে নিযুক্ত ভারতের দুই সাবেক হাইকমিশনার দেব মুখোপাধ্যায় ও পিনাক রঞ্জন চক্রবর্তী মমতার প্রস্তাবকে আদৌ গুরুত্ব দিতে নারাজ। পিনাক বলেন, বাংলাদেশের চাই তিস্তার জল। এত বছর ধরে এই নিয়ে আলোচনা হচ্ছে। এখন তিস্তা ছেড়ে তোর্সা ধরার কোনো মানেই হয় না। দেব মুখোপাধ্যায় বলেন, ‘আমি এটা সম্পূর্ণভাবে উপেক্ষা করতে চাই। অর্থহীন এই প্রস্তাব নিয়ে কিছু বলারই প্রয়োজন নেই।’

বিডি নিউজ