শুক্রবার , ১৯শে এপ্রিল, ২০২৪ , ৬ই বৈশাখ, ১৪৩১ , ৯ই শাওয়াল, ১৪৪৫

হোম > Uncategorized > মর্ত্যরে নিসর্গ কক্সবাজার

মর্ত্যরে নিসর্গ কক্সবাজার

শেয়ার করুন

জেলা প্রতিনিধি, কক্সবাজার ॥ কেউ প্রেমে পড়লে নাকি তার কাছে ঝড়-ঝাপ্টা-বৃষ্টি-বাদল নস্যি হয়ে যায়। প্রাকৃত্রিক-কৃত্রিম যত বাধাই আসুক প্রিয়জনের সান্নিধ্য মেলা তার চাই-ই। প্রেয়সীর মতোই আমাদের টেনেছে বিশ্বের সর্ববৃহৎ সমুদ্র সৈকত কক্সবাজার। সেজন্যই বোধ হয় বৈরী আবহাওয়ার কারণেও বেশ ক’বার অভিসারের সময় পরিবর্তন করলেও আর সইলো না, ২৮ আগস্ট ছুটে গেলাম জলদেবী বঙ্গোপসাগরের কাছে প্রেমপিপাসার তৃষ্ণা মেটাতে।

ঢাকা থেকে ছেড়ে আসা আমাদের বহনকারী রিজেন্টের ফ্লাইটটি কক্সবাজার বিমানবন্দরে অবতরণ করতেই নির্মল বাতাস জুড়িয়ে দিল শরীর। যেন নিসর্গের উঠোনে এসে গেছি। আনুষ্ঠানিকতা সেরে রওনা দিলাম হোটেলের উদ্দেশে। কলাতলী ঝাউবন সড়ক দিয়ে যখন যাচ্ছিলাম সমুদ্রবালিকার গর্জনি আহ্বান খুব করে টানছিল।

কিন্তু ব্যাগপত্র সঙ্গে থাকায় উঠতে হলো হোটেলেই। ফ্রেশ হয়ে কোনোমতে দুপুরের খাবার পেটে দিয়ে সৈকতে ছুট। কলাতলী ঝাউবন সড়ক দিয়ে বালির বিছানায় পা দেওয়ার আগে দু’পাশের শঙ্খ বাজার দোটানায় ফেলে দিল-আগে সমুদ্রকন্যার আবেদনে ভিজবো, নাকি শঙ্খগানের সুর তুলবো! শেষ পর্যযন্ত ফেরার পথেই শঙ্খপ্রেমের সিদ্ধান্ত হলো।

ঢেউয়ে ঢেউয়ে ডাকে কি কেউ
তখন শেষ বিকেল, বালির বিছানা মাড়িয়ে সৈকতে পা রাখতেই ছোট ছোট ঢেউ পা ভিজিয়ে দিল। সাগরকন্যার লোনাজলে শীতলতায় শিরশিরিয়ে উঠলো শরীর।

ডানে-বায়ে তাকিয়ে বোঝা গেল কেন এটি পৃথিবীর সবচেয়ে বৃহৎ সমুদ্র সৈকত। একূল-ওকূলের শেষ নেই, কক্সবাজার শহর থেকে বদরমোকাম পর্যন্ত দীর্ঘ ১২০ কিলোমিটার! পর্যটকদের ঘোরাঘুরির জন্য বেশ কয়েকটি পয়েন্ট ভাগ করা আছে- এর মধ্যে লাবনী পয়েন্ট, সুগন্ধা পয়েন্ট, কলাতলী পয়েন্ট, ইনানী পয়েন্ট ইত্যাদি। বিশেষত এসব পয়েন্ট দিয়েই জলকন্যার প্রেমীরা অভিসারে নামে।

আর সম্মুখে? সহস্র কালের সাক্ষী গভীর সমুদ্রের অথৈ জলরাশি। এগোতেই সাগরের ঢেউগুলোও যেন এগিয়ে আসছিল চিরচেনা আহ্বানের সুরে। একা কাউকে নয়, যেন সবাইকে ঢেউয়ে ঢেউয়ে ডেকে যাচ্ছিল কেউ, সেই ডাকে সাড়া দিতে লাফিয়ে-ঝাঁপিয়ে জলদেবীর কোলে পড়ছিল সবাই। কয়েকফুট উঁচু ঢেউয়ের সঙ্গে ভেসে ভেসে যাচ্ছিল সমুদ্রকন্যার পাগলপ্রেমীরা। সদা তৎপরত লাইফগার্ডদের বাঁশির ফুৎকারও যেন কাউকে থামাতে পারছিল না, কে কার চেয়ে সমুদ্রবালিকার অনেক বেশি ঘনিষ্ঠ হতে পারে যেন সেই প্রতিযোগিতা চলছিল।

ঘণ্টাখানেক, দুয়েক, তিনেক, চারেক কিংবা পাঁচেক সমুদ্রবালিকার সঙ্গে খেলাচ্ছলে প্রেম শেষে কেউ ক্লান্ত হয়ে ঘরে ফিরে, আবার ফেরার আশ্বাস দিয়ে। কিন্তু সমুদ্রবালিকা ক্লান্ত হয় না, সকাল-দুপুর-বিকেল-সন্ধ্যা গড়িয়ে রাত অবদি জেগে থাকে-তার প্রেমীদের প্রেমের তৃষ্ণা মেটাতে। প্রতি মুহূর্তেই সাজে নতুন সাজে। ঊষার আলো সাগরের জলতরঙ্গকে রাঙানোর পর দুপুরের সৈকতে বালির চিকচিক খেলার সঙ্গে জলপরীর উদ্দাম নৃত্য সবাইকে মোহেই ফেলে দেয়। আর রাতটায়? আকাশনীল আর সমুদ্রনীল যেন এক হয়ে যায়। দুই নীলের মিলে মিটমিটিয়ে হাসে চাঁদ-তারকা। সেই মোহে বাহ্বার গর্জন তোলে একেকটি ঢেউ। আর প্রকৃতির নির্মোহপ্রেমী কেউ বালির বিছানায় শুয়ে জলপরীর নৃত্যে মগ্ন হয়ে মুহূর্তের জন্য উড়ে বেড়ায় নিজের নিসর্গের রাজ্যে।

সৈকতে অশ্বারোহী
কখনো অশ্বারোহীর প্রত্যক্ষ দেখা না মিললেও সৈকতে নিজেই অশ্বারোহী বনে যাওয়া যাবে। ফুট দেড়েক-দুয়েক উঁচু ঢেউয়ের সঙ্গে উচ্ছ্বাসের খেলার পর দেখা গেল আমাদেরই কেউ মোক্ষম অশ্বারোহী বনে গেছেন। এদিক-ওদিক চোখ ফিরিয়ে আরও বেশ কিছু অশ্বারোহী দেখা গেল। সৈকতপ্রেমী কেউ নিজেকে অশ্বারোহী নায়করূপে কল্পনা করে ভাড়ায় চড়তে পারেন ঘোড়ার মালিকদের সঙ্গে বনিবনার মাধ্যমে। বর্ষা মৌসুমে অশ্বারোহী সাজতে খানিক বেশি অর্থ গচ্ছা দেওয়া লাগলেও সৈকতের ভরা মৌসুমে এক্ষেত্রে খানিক স্বস্তি পাওয়া যাবে।

ক্যামেরায় অভিসার
‘ভাই, ছবি তুলবেন, আপনার পছন্দ মতো ছবি তুলবো, কম খরচে, সুন্দর হবে ছবি’! সমুদ্রকন্যার সঙ্গে অভিসারের ছবি ক্যামেরাবন্দি করতে এই চিত্রগ্রাহকদের আবদার মেটানোর প্রস্তাব আসবে বারবার। সঙ্গে নিজেরা ক্যামেরা নিয়ে গেলেও সমদ্রস্নানের এসময় এই পেশাদার চিত্রগ্রাহকদেরই শরনাপন্ন হতে হয়। কেউ ছবি একেবারে প্রিন্ট করে নেয়, কেউবা আমাদের মতো নিয়ে নেয় পেনড্রাইভ-মেমোরি কার্ডে।

সৈকতে শঙ্খধ্বনি
সমুদ্রস্নান শেষে ফেরার পথে সেই শঙ্খধ্বনি। এ ধ্বনি দু’পাশ থেকেই বাজবে। বেড়াতে আসা পর্যটকদের আকর্ষণের জন্য ঝিনুক মালা, ব্রেসলেট, চুড়ি, আচারসহ হরেক রকম প্রসাধনী সাজিয়ে বসা দোকানীরা এই শঙ্খধ্বনি বাজিয়ে থাকে।

কেউ সৈকতে ঢোকার আগেই এই শঙ্খধ্বনিতে প্রলুব্ধ হয়ে এসব দোকানে ঢুকে পড়ে, কেউবা আমাদের মতোই জলদেবীর আরাধনা শেষে প্রিয়জনদের জন্য সৈকতপ্রেমের স্মৃতি নিয়ে যাওয়ার জন্য ঢোকেন। হাতের চুড়ি, চুলের ফিতা থেকে শুরু করে শোকেসে রাখার কারুকার্যময় শঙ্খের সাজানো পসরা যে কাউকেই পকেট খালি করতে তাড়িত করবে এই শঙ্খের বাজারে।

ভাজা কাকড়া-চিংড়ি আর শুটকির বাজার
সাগরের মাছ! আহা! সেটা যদি ভাজা হয়? কলাতলী ঝাউবন পয়েন্ট দিয়ে ফেরার পথেই জিহ্বায় জল এনে দেওয়া কাকড়া, চিংড়ি, স্যালমন, রুপচাঁদা একবার খেতে হলোই! আর সমুদ্রের খাবার বাড়ি নিয়ে যাওয়ার জন্য শুকিয়ে রাখা মাছ অর্থাৎ শুটকিতো ব্যাগে ঢুকলোই।

মন চায় উড়তে উড়তে
টানা তিনদিন সকাল-দুপুর-রাত সময়-অসময়ে জলবালিকার প্রেমে মজে থাকলেও উড়ুউড়ু মন কেবলই উড়তে চাইছিল। তাই ফাঁকে ফাঁকে সমুদ্রকন্যা কক্সবাজারের আঁচলজুড়ে নকশা হয়ে থাকা সাগরবুকের সম্ভাবনাময় সোনার দ্বীপ সোনাদিয়া, মিষ্টি পানের সবুজ দ্বীপ মহেশখালী আর সাগর-পাহাড়-আকাশের ত্রিমোহনা হিমছড়ির চূড়াও জয় করে এলাম। কিন্তু কক্সবালিকার যে অঙ্গই ছুঁই, গভীর মোহে পড়ে যাই সে অঙ্গেরই। যেদিন ভোরে চট্টগ্রামের উদ্দেশে রওয়ানা হবো তার আগেরদিন কক্সবালিকাকে বিচ্ছেদের ‘বিদায়’ বললেও আবার ফের ফেরার কথা দিয়ে রাতে নিমগ্ন হই।