শুক্রবার , ২৯শে মার্চ, ২০২৪ , ১৫ই চৈত্র, ১৪৩০ , ১৮ই রমজান, ১৪৪৫

হোম > জাতীয় > মাতৃগর্ভেই দেশহীন ঠিকানাবিহীন

মাতৃগর্ভেই দেশহীন ঠিকানাবিহীন

শেয়ার করুন

বাংলাভূমি ডেস্ক ॥

‘জন্মের অভ্যর্থনা এখানে গম্ভীর, নিরুৎসব, বিষণ্ন’- মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘পদ্মা নদীর মাঝি’ উপন্যাসের এ লাইনটির যথার্থতা খুঁজে পাওয়া যাবে উখিয়া-টেকনাফের পথে পথে। এখানে পথের ধারে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের ঝুপড়িঘরগুলো থেকে নবজাতকের কাম্না ভেসে আসে; কিন্তু তাতে আনন্দ নেই, উচ্ছ্বাস নেই। আছে ঠিকানাবিহীন হওয়ার বেদনা, দেশহীন হওয়ার কষ্ট।

পৃথিবীর সবচেয়ে নিরাপদ স্থান মাতৃগর্ভেই দেশহীন, ঠিকানাবিহীন হয়েছে এ নবজাতকরা। কারও কারও জন্ম হয়েছে পিতৃপুরুষের ভূমি রাখাইন রাজ্য থেকে বর্বর গণহত্যা থেকে বাঁচতে তাদের মায়েদের পালিয়ে আসার পথে। এ শিশুরা মংডু, উত্তর আরাকানের অরণ্যে জন্মেই দেখেছে ‘মগের মল্লুক’। যেখানে দুর্বলের ওপর সবলের অত্যাচারই নিয়তি; শুধু জাতিগত পরিচয়ের কারণে যেখানে জীবনের মূল্য নেই রোহিঙ্গাদের। শরণার্থী সংস্থাগুলোর হিসাবে অন্তত ৪০০ রোহিঙ্গা শিশুর জন্ম হয়েছে বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্তের ‘নো-ম্যান্সল্যান্ডে’। এ সদ্যোজাতরা দেশ, সীমান্ত, ভৌগোলিক সীমারেখা কী তা বোঝার আগেই দেশহীন হয়েছে। বাংলাদেশ তাদের উদারচিত্তে আশ্রয় দিয়েছে। আশ্রয় মিললেও খাদ্য ও চিকিৎসার অভাবে ভুগছে নবজাতকরা। মায়েরা নিয়মিত খাবার পাচ্ছেন না। তাই তাদের বুকে দুধ নেই। দুগ্ধপোষ্যরাও দুধ পাচ্ছে না। মায়েরা ছুটছেন এদিক-সেদিক, যদি কিছু খাবার জোটে। নিজের জন্য নয়, বুকে দুধ আসার জন্য হলেও একমুঠো খাবার চাই।

প্রথম সন্তানের জন্ম দিয়েছেন হাসিনা বেগম। তার দিনগুলো কাটার কথা মাতৃত্বকে উপভোগ করার গর্বে, জীবনের পূর্ণতার আনন্দে। কিন্তু গণহত্যা তার সব কেড়ে নিয়েছে। তাকে এখন প্রতি মুহূর্তে ভাবতে হচ্ছে, কীভাবে এক ফোঁটা দুধ দেবেন সন্তানের মুখে। মিয়ানমারের মংডুর মিজ্জাইলিপাড়া থেকে হাসিনার স্বামী নুর হাকিমকে ধরে নিয়ে যায় মিয়ানমারের সেনারা। তার প্রসবের সময় ঘনিয়ে এসেছে। এ সময় চলাফেরাও মুশকিল। কিন্তু মিয়ানমারে থাকলে তো গর্ভের সন্তানকেও বাঁচানো যাবে না। সন্তানের প্রাণ বাঁচাতে সাড়ে ৯ মাসের অন্তঃসত্ত্বা হাসিনা বাংলাদেশের দিকে রওনা হন প্রতিবেশীদের সঙ্গে। পথেই পুত্রসন্তানের জন্ম দেন। প্রসব বেদনা আর সীমান্ত পার হওয়ার গল্প বলার সময় কান্নায় ভেঙে পড়েন হাসিনা। জানালেন, এখনও সন্তানের নাম রাখতে পারেননি। গত তিন দিনে এক বেলা করে ভাত পেয়েছেন তিনি। সন্তান বুকের দুধ পাচ্ছে না। স্বামী কোথায় আছেন জানেন না। সন্তানকে দুধই দিতে পারছেন না, ছেলের নাম কী রাখবেন? কিন্তু যেখানে হাসিনাদের বাস, সেই মিয়ানমার তাদের নাগরিক হিসেবে স্বীকার করে না। তার প্রশ্ন- ‘আর পোয়ার এহন হন ঠিকানা, সে তো বাংলাদেশত অইয়ে। এহন সে হন দেশতত্যা?’ হাসিনা জানতে চান, তার ছেলেকে নাগরিকত্ব দেবে বাংলাদেশ? আইনে সেই সুযোগ নেই, তা বলা হয় না তাকে। আইনানুযায়ী, শুধু বাংলাদেশের নাগরিকদের সন্তানরা জন্মসূত্রে বাংলাদেশের নাগরিকত্ব পাওয়ার অধিকারী। নতুন যে নাগরিকত্ব আইনের খসড়া মন্ত্রিসভায় অনুমোদন হয়েছে, সেখানেও বাংলাদেশে জন্ম নিলেই নাগরিকত্ব পাওয়ার সুযোগ নেই। সন্তানের মা অথবা বাবা বাংলাদেশের নাগরিক হলে তবেই মিলবে নাগরিকত্ব।

শুধু এক হাসিনা বেগমই নন, আরও শত শত রোহিঙ্গা নারী মা হয়েছেন বাংলাদেশে আসার পথে কিংবা উখিয়া-টেকনাফের আশ্রয়কেন্দ্রগুলোতে। স্বাস্থ্য নিয়ে কাজ করে এমন দেশি-বিদেশি বেশ কয়েকটি সংস্থার জরিপের বরাত দিয়ে বান্দরবানের ভারপ্রাপ্ত সিভিল সার্জন ডা. অংসুই জানান, প্রায় ৭০ হাজার অন্তঃসত্ত্বা রোহিঙ্গা নারী বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছেন। তাদের প্রত্যেকের রয়েছে আরও তিন থেকে চারটি করে শিশু। শিশুদের বয়স ২ থেকে ৬ বছরের মধ্যে। ফলে প্রায় ৭০ হাজার নারীর গর্ভে রয়েছে আরও ৭০ হাজার অনাগত রোহিঙ্গা শিশু। মাস ছয়েকের মধ্যে এদের অনেকেই পৃথিবীর আলোর মুখ দেখবে। যারা রোহিঙ্গা শরণার্থীর বিপুলায়তন সংখ্যাকে আরও বড় করবে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হিসাবে, ১৭৮ নারী গর্ভকালীন জটিলতায় আক্রান্ত। গত ১৭ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত কুতুপালং কমিউনিটি ক্লিনিকে ১১ নারী সন্তান জন্ম দিয়েছেন। রোহিঙ্গা নারী মাহমুদা খাতুনের গল্পও অভিন্ন। তার কোলে দু’দিনের নবজাতক। টেকনাফের শাহপরীর দ্বীপে জন্ম নিয়েছে তার সন্তান। এখনও নাম রাখা হয়নি। এ শিশুও মাতৃগর্ভেই দেশহীন হয়েছে। দ্য ইন্ডিপেন্ডেন্টের হিসাবে গত ২৫ আগস্ট রাখাইন রাজ্যে হত্যা-নির্যাতন শুরুর পর প্রায় সাড়ে চার লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছেন। তাদের ৮০ শতাংশই নারী ও শিশু। একটি বড় অংশ সদ্যজাত শিশু।

গত ক’দিনের বৈরী আবহাওয়া রোহিঙ্গাদের শিশুদের দুর্ভোগ আরও বাড়িয়ে তুলেছে। ক্ষুধার যন্ত্রণায় কাতর নবজাতকরা বৃষ্টিতে ভিজে জ্বর, কাশি, নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হচ্ছে। তাদের সরকারের পক্ষ থেকে টিকা দেওয়ার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। কিছু শিশু এতই দুর্বল হয়ে পড়েছে যে, কাঁদতেও পারছে না।

কক্সবাজারের গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের পরিচালক নাসিমা ইয়াসমিন জানান, নবজাতকরা সবচেয়ে সংকটকাল পার করছে। খাদ্য আর পানির অভাবে মায়েরা সন্তানকে বুকের দুধ খাওয়াতে পারছেন না। দুগ্ধবতী মায়েদের জন্য দ্রুত খাবার, বিশুদ্ধ পানি এবং ওষুধ প্রয়োজন। তা না হলে পরিস্থিতি আরও খারাপের দিকে যেতে পারে।

উখিয়া রাবার বাগানের রোহিঙ্গা শরণার্থী চিকিৎসা ক্যাম্পের চিকিৎসক ডা. খাস্তগীর বলেন, নতুন এ ক্যাম্পে বেশ কয়েকজন প্রসূতি মা রয়েছেন। কেউ তিনদিন, কেউ সাতদিন আবার কেউ ৯ দিন আগে সন্তান জন্ম দিয়েছেন। ক্যাম্পে চিকিৎসক সংকট রয়েছে। ওষুধ সংকটের কারণে প্রসূতি মা ও নবজাতকরা রোগে আক্রান্ত হতে পারেন।

উখিয়ার পালংখালী ইউনিয়ন পরিষদের (ভারপ্রাপ্ত) চেয়ারম্যান আবছার কামাল বলেন, মিয়ানমার থেকে আসা নারীদের একটি বিশাল অংশ অন্তঃসত্ত্বা। ৯ শিশু রয়েছে, এমন রোহিঙ্গা নারীও বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছেন।
সমকাল