শুক্রবার , ২৯শে মার্চ, ২০২৪ , ১৫ই চৈত্র, ১৪৩০ , ১৮ই রমজান, ১৪৪৫

হোম > রাজনীতি > মামলা নিষ্পত্তি’ হলে-ই নির্বাচনে যাবে বিএনপি

মামলা নিষ্পত্তি’ হলে-ই নির্বাচনে যাবে বিএনপি

শেয়ার করুন

বাংলাভূমি ডেস্ক ॥
চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলেন গুলশান কার্যালয়ে। বেরিয়ে আসার সময় চেয়ারপারসন তাঁর কাছে জানতে চান, ‘তোমার মামলাগুলোর খবর কী। ’ ওই নেতা জানান, ১০০টিরও বেশি মামলা আছে তাঁর বিরুদ্ধে, প্রায় সব কটিতেই জামিনে আছেন। বিএনপিপ্রধান তাঁকে সব সময় জামিনে থাকতে বলেছেন। আরো কয়েকজন নেতাকেও তিনি একই পরামর্শ দিয়েছেন।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সহায়ক সরকারের প্রস্তাবনা দেওয়ার পর বিএনপি নানা ইস্যু তুলবে। সরকার সেসব দাবি না মানলে আন্দোলনে যাওয়ার পরিকল্পনা করছে দলটি। সে সময় যাতে নেতারা মাঠে থাকেন সে জন্যই তিনি তাঁদের জামিনে থাকতে বলেছেন। আবার এসব নেতার অনেককেই একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে মনোনয়ন দেবে দল। তখন যাতে ফেরারি আসামি হওয়ার কারণে তাঁরা মনোনয়নবঞ্চিত না হন সে জন্য সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের প্রস্তুত থাকতে বলেছেন তিনি। খালেদা জিয়ার এমন বার্তা পাওয়া একাধিক নেতার সঙ্গে কথা বলে এ তথ্য জানা গেছে।

একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে যাওয়ার ক্ষেত্রে বিএনপির দর-কষাকষির অন্যতম ইস্যু হবে মামলা। দলীয় প্রধান খালেদা জিয়া, সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমান, মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলামসহ বিএনপির বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে এখন প্রায় ২৫ হাজার মামলা ঝুলছে। এতে আসামির সংখ্যা প্রায় পাঁচ লাখ।

জানতে চাইলে মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, ‘আমার নামেই ৮৬টি মামলা আছে। ৩৬টির চার্জশিট হয়ে গেছে। খালেদা জিয়াকে প্রতি সপ্তাহে কোর্টে যেতে হয়। কী অপরাধ আমাদের? কার কাছে বলব, কোথায় যাব?’

দলটির ভাইস চেয়ারম্যান মোহাম্মাদ শাহজাহান বলেন, ‘নির্বাচনে যাওয়ার ক্ষেত্রে আমাদের কিছু দাবি-দাওয়া তো থাকবেই। সেখানে অবশ্যই মামলার বিষয়টিও থাকবে। তারা ঘুরে বেড়াবে, ভোট চাইবে আর আমরা মামলা নিয়ে আদালতের বারান্দায় ঘুরব, তা তো হয় না। অবশ্যই নির্বাচনের আগে মামলাগুলোর নিষ্পত্তি খুব গুরুত্বপূর্ণ। ’

বিএনপির গণশিক্ষা বিষয়ক সম্পাদক এবং খালেদা জিয়া, তারেক রহমান, ফখরুলসহ শীর্ষস্থানীয় নেতাদের আইনজীবী সানা উল্লাহ মিয়া বলেন, ‘২৫ হাজার মামলা ঝুলছে দলীয় প্রধানসহ নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে। এর সুরাহা না হলে অনেকেই নির্বাচনে অংশ নিতে পারবেন না। আর দলের শীর্ষস্থানীয় নেতারা অংশ নিতে না পারলে বিএনপির জন্য কিভাবে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড হলো। ’

দলটির এক নেতা জানান, চেয়ারপারসনের নির্দেশনা পেয়ে শীর্ষ থেকে জেলা পর্যায়ের নেতারা আত্মসমর্পণ করছেন। তাঁদের মধ্যে হাতে গোনা কয়েকজন জামিন পেলেও বেশির ভাগকেই কারাগারে যেতে হচ্ছে। সম্প্রতি যুগ্ম মহাসচিব হাবিব-উন-নবী খান সোহেল ও খায়রুল কবির খোকন জেল খেটে জামিনে বেরিয়েছেন। জামিন চাইতে গিয়ে ভাইস চেয়ারম্যান বরকতউল্লা বুলু ও চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা জয়নুল আবদিন ফারুককে কারাগারে যেতে হয়েছে।

বিএনপির দপ্তর ও আইনজীবীদের দেওয়া তথ্য মতে, খালেদা জিয়াসহ ১৫৮ জন কেন্দ্রীয় নেতার বিরুদ্ধে প্রায় সাড়ে চার হাজার মামলা রয়েছে। এরই মধ্যে অনেক মামলার অভিযোগপত্র দেওয়া হয়েছে। অনেক মামলার গতি বেড়ে গেছে। খালেদার বিরুদ্ধে জিয়া ট্রাস্ট এবং তারেক রহমানের বিরুদ্ধে ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলার বিচারকাজ প্রায় শেষ পর্যায়ে পৌঁছে গেছে।

নেতাদের বিরুদ্ধে যত মামলা : বিএনপি সূত্রে জানা গেছে, ওয়ান-ইলেভেনের সময় জিয়া অরফানেজ ও জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট, গ্যাটকো দুর্নীতি, বড়পুকুরিয়া কয়লাখনি দুর্নীতি, নাইকো দুর্নীতিসহ সাতটি মামলা করা হয় খালেদা জিয়ার নামে। বিগত সরকারবিরোধী আন্দোলনের সময় নাশকতার নির্দেশদাতা হিসেবেও তাঁর নামে মামলা হয়েছে। সব মিলিয়ে ৩৫টি মামলার আসামি খালেদা। এর মধ্যে ২০টির কার্যক্রম চলছে বিভিন্ন আদালতে। জিয়া চ্যারিটেবল ও জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলার কার্যক্রম শেষ পর্যায়ে। বাদীপক্ষের সাক্ষ্যগ্রহণ শেষ হয়েছে। চলছে খালেদা জিয়ার আত্মপক্ষ সমর্থনের শুনানি। দলের সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানের বিরুদ্ধে ১০০টির ওপরে মামলা রয়েছে। একটিতে তাঁর সাত বছরের সাজাও হয়েছে। মির্জা ফখরুল ইসলামের ৮৬ মামলার ২৪টিতে অভিযোগপত্র দেওয়া হয়েছে।

স্থায়ী কমিটির সদস্যদের মধ্যে ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেনের বিরুদ্ধে ১১টি মামলা আছে। মানি লন্ডারিংয়ের দায়ে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) করা মামলায় তিনি গ্রেপ্তার হয়ে জেলও খেটেছেন। এ ছাড়া তরিকুল ইসলাম ২২, মওদুদ আহমদ ৯, এম কে আনোয়ার ৪০, ব্যারিস্টার জমির উদ্দিন সরকার পাঁচ, মির্জা আব্বাস ৯৬, গয়েশ্বর চন্দ্র রায় ৪০, ব্যারিস্টার রফিকুল ইসলাম মিয়া ১৯, আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী তিন ও সালাহউদ্দিন আহমেদ ৪৭ মামলার আসামি। মামলামুক্ত স্থায়ী কমিটির সদস্য হলেন ড. আবদুল মঈন খান ও লে. জে. (অব.) মাহবুবুর রহমান। নজরুল ইসলাম খানের বিরুদ্ধে দুটি মানহানির মামলা আছে।

সিনিয়র নেতাদের মধ্যে সাদেক হোসেন খোকার বিরুদ্ধে ৪২, আবদুল্লাহ আল নোমানের ১৩, সেলিমা রহমানের ১১, আলতাফ হোসেন চৌধুরীর সাত, শাহ মোয়াজ্জেম হোসেনের ১৮, মেজর (অব.) হাফিজ উদ্দিন আহম্মদের ছয়, সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি খন্দকার মাহবুব হোসেনের ১৩, সাবেক সভাপতি জয়নাল আবেদীনের পাঁচ, সাবেক অ্যাটর্নি জেনারেল এ জে মোহাম্মদ আলীর তিন, মোহাম্মাদ শাহজাহানের সাত, ইকবাল হাসান মাহমুদের ৩৭, এ জেড এ জাহিদ হোসেনের ১৫, আবদুল আউয়াল মিন্টুর ১২, শামসুজ্জামান দুদুর ২২, শওকত মাহমুদের ৪৫, শাহজাহান ওমরের আট, এম আকবর আলীর সাত, জহুরুল ইসলামের দুই, আমানউল্লাহ আমানের ১২৬, বরকতউল্লা বুলুর ৮৮, রুহুল কবীর রিজভীর ৪৭, মোয়াজ্জেম হোসেন আলালের ১৩০, হাবিব-উন-নবী খান সোহেলের ১০, মিজানুর রহমান মিনুর ১৩, মাহবুব উদ্দিন খোকনের পাঁচ, শামসুর রহমান শিমুল বিশ্বাসের ৫২, মারুফ কামাল খানের ৪৩, শামসুদ্দিন দিদারের ১০, রাজশাহীর মেয়র মোসাদ্দেক হোসেনের ১৩, গাজীপুরের মেয়র আবদুল মান্নানের ১১, সিলেটের মেয়র আরিফুল হক চৌধুরীর ৯, বরিশালের মেয়র আহসান হাবিব কামালের পাঁচ, জয়নুল আবদিন ফারুকের ৩১, সাইফুল ইসলাম নীরবের ২১৫, সুলতান সালাউদ্দিন টুকুর ২১২, নাজিম উদ্দিন আলমের ১৭, খায়রুল কবির খোকনের ১০, ফজলুল হক মিলনের ১২, রুহুল কুদ্দুছ তালুকদার দুলুর ৪৫, মীর শরাফত আলী সফুর ৮৭, নাদিম মোস্তফার ২৭, শহীদ উদ্দীন চৌধুরী এ্যানির ৮৭, আজিজুল বারীর ৩৭, সৈয়দ মেহেদী আহমেদের আট, সানাউল্লাহ মিয়ার আট, শিরিন সুলতানার ১৭, শফিউল বারী বাবুর ৩১, আশিফা আশরাফী পাপিয়ার ১১, তৈমুর আলম খন্দকারের চার, নজরুল ইসলাম মঞ্জুর ছয়, বেলাল আহমেদের ছয়, আবদুল কাদের ভূঁইয়া জুয়েলের ২৭, হাবিবুর রশীদ হাবিবের ৪৩, আকরামুল হাসানের ১০ ও নবী উল্লাহ নবীর বিরুদ্ধে ৮৩টি মামলা রয়েছে।

নয়াপল্টনের কেন্দ্রীয় দপ্তর জানায়, এসব মামলার বিষয়ে একটি সেল খোলা হয়েছে। সেখানে প্রতিদিনই আপডেট নেওয়া হচ্ছে। সেল থেকে তথ্য নিয়ে প্রয়োজনমাফিক দলের পক্ষ থেকে আইনজীবী সহায়তা দেওয়া হচ্ছে।

বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল বলেন, ‘প্রতি সরকারি কর্মদিবসে আমাকে গড়ে তিন দিন কোর্টে যেতে হয়। অবস্থা এতটাই বেগতিক যে আইনজীবীরা আমাকে কোর্ট-কাছারি এলাকায় বাসা নেওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন। ’ তিনি বলেন, ‘আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল আমাদের দলের চেয়ারপারসন। তাঁর পরামর্শেই আমরা মামলাগুলোতে জামিনে রয়েছি। সরকার যদি মনে করে, মামলায় আটকে নির্বাচনে যাওয়ার ক্ষেত্রে দর-কষাকষিতে তারা সুবিধা নেবে, তাহলে তারা ভুল করবে। নির্বাচনের আগে অবশ্যই মামলার বিষয়ে ফয়সালা হতে হবে। ’

উৎসঃ   কালের কণ্ঠ