শুক্রবার , ২৯শে মার্চ, ২০২৪ , ১৫ই চৈত্র, ১৪৩০ , ১৮ই রমজান, ১৪৪৫

হোম > গ্যালারীর খবর > রোববার অগ্নিপুরুষ কর্নেল তাহেরের মৃত্যুবার্ষিকী

রোববার অগ্নিপুরুষ কর্নেল তাহেরের মৃত্যুবার্ষিকী

শেয়ার করুন

স্টাফ রিপোর্টার ॥ বাংলাদেশে জন্ম নেয়া ইতিহাসের অগ্নিপুরুষ কর্নেল তাহের এর ৩৭ তম মৃত্যুবাষিকী আজ (রোববার)। ১৯৭৬ সালের ২১ জুলাই সামরিক আদালত রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগে কর্নেল তাহেরকে ফাঁসি দেয়। তিনি মুক্তিযুদ্ধের ১১ নং সেক্টর কমান্ডার, ঐতিহাসিক সিপাহী-জনতার অভ্যুত্থানের অন্যতম নায়ক ও বামপন্থী নেতা ছিলেন। কর্নেল আবু তাহের ১৯৩৮ সালের ১৪ নভেম্বর ভারতের আসামের বদরপুরে জন্মগ্রহণ করেন।

নেত্রকোণার পূবধলা উপজেলার কাজলা গ্রামে তার পৈত্রিক নিবাস। বাবা মহিউদ্দিন আহমেদ ও মাতা আশরাফুন্নেছা। আট ভাই ও তিন বোনের মধ্যে তৃতীয়। ভাই আবু ইউসুফ বীর বিক্রম, ওয়ারেসাত হোসেন বেলাল ও বাহার বীর প্রতীকসহ সবাই মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। ১৯৬৯ সালের ৭ আগস্ট ইডেন কলেজ ছাত্রী লুৎফা বেগমকে বিয়ে করেন।

কর্নেল তাহেরের শিা জীবন চট্টগ্রাম ফতেহাবাদ স্কুলে শুরু হয়। সিলেট এমসি কলেজ থেকে স্নাতক পাস করেন তিনি। ১৯৫৯ সালে চট্টগ্রাম মিরসরাই দুর্গাপুর হাইস্কুলে শিকতা করার সময় বামপন্থী আন্দোলনে জড়িয়ে পড়েন। ১৯৬০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউট থেকে স্নাতকোত্তর প্রথম পর্ব শেষ করে সেনাবাহিনীতে যোগ দেন।

১৯৬৫ সালে স্পেশাল সার্ভিস গ্রুপের সদস্য ও পাক-ভারত যুদ্ধে কাশ্মীর এবং শিয়ালকোট রণাঙ্গনে লড়াই করে আহত হন। ১৯৬৭ থেকে ১৯৬৯ সাল পর্যন্ত চট্টগ্রাম সেনানিবাসে থাকাকালীন স্বাধীনতাকামী একদল বাঙালি যুবককে সামরিক প্রশিণ দেন। ১৯৬৯ সালে ফোর্ট ব্রাগ ও ফোর্ট বেনিং-এ গেরিলা যুদ্ধের প্রশিণ এবং সমর বিদ্যায় গ্রাজুয়েশন ডিগ্রি লাভ করেন।

১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ পযন্ত পাকিস্তানের স্কুল অব ইনফেন্ট্রি এন্ড টেকটিক্স প্রশিণে ছিলেন। ২৬ মার্চ তাকে বন্দী করা হয়। ২৫ জুলাই পাকিস্তান থেকে পালিয়ে ভারতের দেবীগড়ে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেন। দায়িত্ব নেন ১১ নং সেক্টর কমান্ডারের। জামালপুরে পাকিস্তানি সেনাঘাঁটিতে আক্রমণের সময় মটারসেলের আঘাতে বাম পা হারান। স্বাধীনতার পর তাকে ‘বীর উত্তম’ খেতাবে ভূষিত করা হয়।

স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালের এপ্রিলে প্রথম অ্যাডজুটেন্ট জেনারেল নিযুক্ত হন। পরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সাথে ‘উৎপাদনমুখী সেনাবাহিনী প্রবর্তন’ বিষয়ে মতানৈক্য দেখা দেয়। একই বছর ২২ সেপ্টেম্বর বিগ্রেডিয়ার অধিনায়ক হিসেবে পদত্যাগ করেন।

৩১ অক্টোবর সক্রিয়ভাবে জাসদ রাজনীতির সাথে যুক্ত হন। ৭৫ সালের ৭ নভেম্বর সিপাহি জনতার গণ-অভ্যূত্থানে নেতৃত্ব দিয়ে সেনাপ্রধান জিয়াউর রহমানকে মুক্ত করেন।

সেনা অভ্যূত্থানের দায়ে ২৪ নভেম্বর তাকে গ্রেফতার করা হয়। ১৭ জুন সামরিক আদালতে নজিরবিহীন প্রহসনের বিচার শুরু হয়। ১৭ জুলাই তথাকথিত সামরিক ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান পাকিস্তান প্রত্যাগত কর্নেল ইউসুফ হায়দার তাকে মুত্যুদণ্ড দেন। ২১ জুলাই ভোর ৪টায় ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে তার ফাঁসি কার্যকর করা হয়।

বিতর্কিত এ রায়ে কর্নেল তাহেরসহ ১৭জনকে মুত্যদণ্ডসহ বিভিন্ন মেয়াদে সাজা দেয়া হয়। ৩৪ বছর পর ২০১০ সালের ২৩ আগস্ট কর্নেল তাহেরের স্ত্রী লুৎফা তাহের, ভাই ফাইট সার্জেন্ট আবু ইউসুফ খানের (বীর বিক্রম) স্ত্রী ফাতেমা ইউসুফ ও অপর ভাই ড. আনোয়ার হোসেন ওই বিচার চ্যালেঞ্জ করে প্রথম রিটটি করলে ২০১১ সালের ২২ মার্চ হাইকোট গোপন বিচার, সাজা কার্যকর ও সামরিক আদালতকে অবৈধ ঘোষণা করে রায় দেন।

২৩ আগস্ট আদালত তাহেরের বিচারের জন্য সামরিক আইনের মাধ্যমে জারি করা আদেশ এবং এর আওতায় গোপন বিচার ও ফাঁসি কার্যকর করাকে কেন অসাংবিধানিক ঘোষণা করা হবে না, তা জানতে চেয়ে রুল জারি করেন। একই বছর গোপন বিচারের মুখোমুখি অন্য ছয় ব্যক্তি হাইকোর্টে পৃথক তিনটি রিট করেন। এর পরিপ্রেেিত আদালত রুল জারি করেন। রায়ে বলা হয়, যেহেতু জেনারেল জিয়া জীবিত নেই, আইন অনুযায়ী তার বিচার করা সম্ভব নয়। সরকারের উচিত হবে এ হত্যার সাথে জড়িত কেউ জীবিত থাকলে, তাকে খুঁজে বের করে হত্যার দায়ে অভিযুক্ত করা।

আদালত কর্নেল তাহেরের হত্যাকাণ্ডকে দেশের ইতিহাসের একটি কলঙ্কময় অধ্যায় উল্লেখ করেন। কর্নেল তাহেরের ফাঁসিকে ‘নিরঙ্কুশ খুন’ বলে অভিহিত করেন আদালত।

১৯৮ পৃষ্ঠার রায়ে আদালত কর্নেল তাহেরের মৃত্যুদণ্ড হত্যাকাণ্ড, অবৈধ ও বেআইনী ঘোষণা করেন। আদালত তাহেরের মৃত্যুদণ্ডকে ‘ঠান্ডা মাথার খুন’ বলে অভিহিত করতে সরকারের প্রতি নির্দেশ দেন।

কর্নেল তাহেরকে আইনজীবীর সঙ্গে দেখা করতে দেয়া হয়নি। এমনকি আত্মীয়-স্বজনের সঙ্গেও দেখা করতে দেয়া হয়নি তাকে। ১৯৭৬ সালের ১৪ নভেম্বর ট্রাইব্যুনাল গঠন করা হয়। ১৭ জুলাই ফাঁসি রায় ও ২১ জুলাই কার্যকর করা হয়। কিন্তু যে অপরাধ এনে আদালত তাকে সাজা দেয় তার বিধান ছিল মাত্র ১০ বছর। মৃত্যুদণ্ড কাযকর করার পর ৩১ জুলাই মুত্যদণ্ডের বিধান করা হয়।

পরবর্তীতে আদালত তাহেরকে দেশদ্রোহীর পরিবর্তে মহান দেশপ্রেমিক হিসেবে মর্যাদা দিতে এবং সামরিক আদালতের বিচারকের বিরুদ্ধে খুনের মামলা করতেও নির্দেশ দেন।

কর্নেল তাহের জেলে বসে পরিবারের প্রতি চিঠি লিখতেন। ৯, ১৫ ও ১৮ জুলাই তিনি তার স্ত্রী লুৎফা তাহেরকে চিঠি লিখেন। তাতে জিয়াউর রহমানের বিশ্বাসঘাতকতা ও দেশের প্রতি, দেশের মানুষ, মুক্তিযুদ্ধ, দেশের প্রতি জিয়াউর রহমানের ষড়যন্ত্র তুলে ধরেন।

ঘটনাবহুল জীবনের অধিকারী বীর মুক্তিযোদ্ধা কর্নেল আবু তাহের বীরউত্তম। শৈশব-কৈশর থেকেই সাহসিকতার নানা দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন তিনি। সমাজের অসঙ্গতি আর অনিয়মের প্রতিবাদকারী তাহের বড় হয়েও টলেননি নিজের অবস্থান থেকে। অন্যায়ের কাছে কোনোদিন মাথা নত করেননি। তাইতো এ বীর বাঙালীর হৃদয়ে বেঁচে আছে, বেঁচে থাকবে চিরদিন।

মহান এ দেশপ্রেমিকের মৃত্যুবার্ষিকীতে বিভিন্ন সাংস্কৃতিক ও সামাজিক সংগঠন নানা কর্মসূচি পালন করবে।