বৃহস্পতিবার , ২৮শে মার্চ, ২০২৪ , ১৪ই চৈত্র, ১৪৩০ , ১৭ই রমজান, ১৪৪৫

হোম > শীর্ষ খবর > রোহিঙ্গাদের কষ্টের শেষ নেই

রোহিঙ্গাদের কষ্টের শেষ নেই

শেয়ার করুন

বাংলাভূমি ডেস্ক ॥
দুর্বল হয়ে আসছে রোহিঙ্গা নারী-শিশুরা। শূন্য থেকে ১০ বছর বয়সী শিশুদের মধ্যে এ প্রবণতা বেশি। এমনিতেই শরণার্থীদের মধ্যে পুষ্টিহীন শিশুর সংখ্যা অনেক। নবজাতকদের মধ্যে বেশিরভাগই মায়ের দুধ পাচ্ছে না। আবার অপুষ্টির শিকার হয়ে অনেক ‘মা’ এখন কাহিল প্রায়। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে সময় মতো খেতে না পারা। ত্রাণের অপ্রতুলতা। স্বাস্থ্যকর ও পুষ্টি গুণসমৃদ্ধ খাদ্যের অভাব। পরিবেশগত বিষয় তো আছেই। আছে সব হারানোর কষ্ট। স্বজন হারানোর যন্ত্রণা, নির্যাতন আর বীভৎসতা রাতদিন কুরে কুরে খাচ্ছে অনেক নারীকে। সব মিলিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গা নারী-শিশুদের বেশিরভাগই কেউ ভাল নেই। দুঃখ, কষ্ট আর যন্ত্রণায় তাদের প্রতিদিনের সূর্যাস্ত হয়। বেশিরভাগ মানুষ নিজ দেশে ফিরে স্বাভাবিক জীবনযাপনে ফেরার অপেক্ষায় দিন গুনছেন।

জাতিসংঘ শিশুবিষয়ক সংস্থা ইউনিসেফ বলছে, আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গাদের মধ্যে শূন্য থেকে ১৮ বছর পর্যন্ত শিশুর সংখ্যা দুই লাখ ৪০ হাজারের বেশি। মোট রোহিঙ্গাদের ৬০ ভাগই শিশু। এদের মধ্যে এখন এক লাখ শিশু স্কুলে যাওয়ার উপযোগী। জাতিসংঘের জনসংখ্যা তহবিলের ধারণা, রোহিঙ্গাদের মধ্যে দুই-তৃতীয়াংশ নারী ও মেয়ে। এর মধ্যে ১৩ ভাগ অন্তঃসত্ত্বা ও সন্তানকে দুধ খাওয়াচ্ছেন।

সেভ দ্য চিলড্রেন বাংলাদেশ প্রধান মার্ক পিয়ার্স গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন, বছরের শেষদিকে বাংলাদেশে আসা রোহিঙ্গা শিশুর সংখ্যা দাঁড়াবে ৬ লাখে। তখন মোট রোহিঙ্গা হবে ১০ লাখ। উখিয়া-টেকনাফের বিভিন্ন রোহিঙ্গা ক্যাম্পে শিশুদের শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও মানসিক বিকাশে কাজ করছে দেশী-বিদেশী বেশ কয়েকটি সংস্থা। এগুলোর মধ্যে রয়েছেÑ ইউনিসেফ, আইএসসিজি, সেভ দ্য চিলড্রেন, ব্র্যাক, কোডেকসহ আরও কিছু প্রতিষ্ঠান।

সরেজমিনে বিভিন্ন রোহিঙ্গা ক্যাম্পসহ আশ্রয় নেয়া অঞ্চল ঘুরে দেখা গেছে, পুষ্টিহীন শিশুর সংখ্যা বেশি। যাদের বেশিরভাগের সামাজিক অবস্থান দারিদ্র্যসীমার নিচে। মিয়ানমারের রাখাইনের বাসিন্দা আলিফা খাতুন। বাংলাদেশে আসার পর কন্যা সন্তানের মা হয়েছেন তিনি। এই নিয়ে সপ্তমবারের মতো মা হলেন। তার সব সন্তানই পুষ্টিহীনতায় ভুগছে। হাড্ডিসার দেহ। সংসারে একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি ছিলেন স্বামী আলাল। তার খোঁজ নেই। বেঁচে আছেন কি নেই কেউ জানে না। গত ২০ দিন আগে তিনি কাজের সন্ধানে বাড়ি থেকে বেরিয়েছিলেন। তারপর আর ফেরেননি। পরিচিতজনদের কাছে খবর নেয়ার চেষ্টা করেছেন। কেউ খোঁজ দিতে পারেননি। গ্রাম জ্বলছে। সেনা আর মগদের অত্যাচারে অতিষ্ঠ সবাই। যে যার মতো করে পালাচ্ছেন।

আলিফা জানালেন, স্বামীর জন্য বাড়ির পাশে জঙ্গলে অন্তত এক সপ্তাহ অপেক্ষা করেছি। নিরুপায় হয়ে পালিয়ে আসা ছাড়া আমার বিকল্প কিছু ছিল না। তিনি জানান, বাংলাদেশে এসে মেয়ে হওয়ার পর থেকে কষ্ট আরও বেড়েছে। নিজেই তো সাধ্যমতো খাবার সংগ্রহ করতে পারি না। বুকেও দুধ আসে না। তোলা দুধের ব্যবস্থা নেই। খাদ্যাভাবে আমি নিজেও দুর্বল। দীর্ঘ সময় লাইনে দাঁড়িয়ে ত্রাণ সংগ্রহ করার শক্তি নেই। রাস্তার পাশে বসে ভিক্ষা করি। যাকেই পাই হাত বাড়িয়ে দেই। বড় শিশুগুলোও ভিক্ষা করছে। এভাবে কোন রকম চলছি আমি। তার প্রশ্ন আমি কিভাবে বাঁচাব। সন্তানকেই বা কিভাবে বাঁচাব। যদিও তার এই কঠিন প্রশ্নের কোন জবাব নেই।

স্বামীহারা নাদিরার পরিস্থিতি আরও কঠিন। কোলে তিন মাসের শিশু। সঙ্গে আরও ছয়জন। মোট আটজনের সংসার। কিন্তু আট আনাও তার কাছে নেই। ঠিকানা খোলা আকাশ। রাস্তা। কাহিল শরীর। বললেন, দিনভর ‘খাবার দাও’ শব্দ শুনে আমাকে কাটাতে হচ্ছে। কিন্তু কিভাবে খাবার আসবে। যা ত্রাণ আসে তা দিয়ে তো চলছে না। মাইলের পর মাইল হেঁটে পাড়ি দিয়ে বাংলাদেশে এসেছি। টানা তিন দিন কিছুই খেতে পারিনি। মিলিটারিদের ভয়ে জঙ্গলে ছিলাম। গ্রামের এক গোলা ঘরেও একদিন কাটিয়েছি। বাংলাদেশে এসেও খাদ্য সঙ্কট। বাচ্চাগুলো খালি কাঁদে। আমি কি করি বলুন। ওদের রক্ষা করাই এখন আমার কাছে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। কিন্তু এভাবে চললে তো বাচ্চাগুলো চোখের সামনে মরতে থাকবে। হয়তো আমাকে একের পর এক সন্তানের মৃত লাশ দেখতে হবে। কিন্তু আমি তা চাই না। এই পরিস্থিতি দেখার আগে আল্লাহ যেন আমাকে তুলে নেন। আমিও আর চলতে পারছি না। জীবনের চলমান বাস্তবতার কথা তুলে ধরে কান্না চেপে রাখতে পারছিলেন না। হাউমাউ করে কাঁদতে লাগলেন তিনি। প্রতিবেশী কয়েকজন রোহিঙ্গা নারী সান্ত¦না দেয়ার চেষ্টা করেন। কিন্তু হৃদয়ে যে কষ্ট ধারণ করে আছেন কোন সান্ত¦নাতেই হয়তো লাঘব হওযার নয়।

গায়ের রং একেবারেই কালো। পরনে কাপড় নেই। শরীরের থেকে পেটের আকৃতি লিকলিকে। দেহ হাড্ডিসার। দূর থেকে দেখলেই বোঝা যায় রহিম যে একেবারেই অপুষ্টিতে ভুগছে। অপুষ্টি তো ক্ষুধা মানে না। তাই রাস্তায় রাস্তায় যে কাউকে দেখলেই হাত পাতে ছয় বছরের এই শিশুটি। মা কোথায় জিজ্ঞেস করতেই হাত ধরল। একটু দূরেই মা শুয়ে আছেন রাস্তার পাশে। ক্লান্ত। দুর্বল শরীর। তিনিও মগ আর সেনাদের নির্যাতনের শিকার। হাতে, মুখে, পায়ে ক্ষতের চিহ্ন। জানালেন, চলতি মাসের শুরুর দিকে হঠাৎ করেই বাড়িতে হামলে পড়ে দুর্বৃৃত্তের দল। আমাদের ঘরে রেখে আগুন দেয়। ঘরের বেড়া কেটে আমরা বের হই। তারপর ওরা আমাদের ধরে ফেলে। চোখের সামনে স্বামীকে কুপিয়ে জখম করে। তার অবস্থা খুবই খারাপ। আমিও নির্যাতনের শিকার হই। জ্ঞান ফেরার পর দেখি আমার চার ছেলেমেয়ে কাঁদছে। বাড়িঘর সবই ধ্বংস্তূপ। চেনার উপায় নেই। আমাদের নির্যাতনে করে সেনারা চলে যায়। প্রতিবেশী কয়েকজনের সহায়তায় স্বামীকে হাসপাতালে নিয়ে যাই। দুই দিন পর তিনি আমাদের ছেড়ে চলে গেলেন। আমি একেবারেই অসহায়। উপায়হীন হয়ে লাশ হাসপাতালে রেখে পালানোর চেষ্টা করি। আবারও ধরা খাই মিলিটারিদের হাতে। ফের নির্যাতন। ওরা যখন আমাকে নির্যাতন করছিল তখন ছেলেমেয়েরা বারবার ওদের পায়ে ধরছিল। কিন্তু পাষ-দের মন গলেনি। তাদের কাজ ঠিকই করেছে। ভয়ে পাহাড়ে গিয়ে আশ্রয় নেই। সেখানে বহু মানুষ। তাদের সহযোগিতায় এখানে এসেছি। এখন নিজের খাবারের অনিশ্চয়তা যেমন নেই, তেমনি সন্তানদের তিন বেলা মুখে খাবার তুলে দেয়ার উপায় দেখছি না। ওরা আস্তে আস্তে দুর্বল হতে চলেছে। আমি কি করব বুঝে উঠতে পারছি না।

এক কাপড়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে এসেছেন সুলতানা। স্বামীও আছেন। কিন্তু রোগে আক্রান্ত। কাজ করতে পারেন না। লাইনে দাঁড়িয়ে ত্রাণ সংগ্রহ করার সামর্থ্যও তার নেই। তাই রাস্তার পাশে বসে থাকেন। কেউ যদি দয়া করে কিছু দেয় তাহলে খাবার জোটে। কিন্তু চার সন্তান আর স্ত্রীর খাবারের কি হবে। ২০ দিনের বেশি হলো এক কাপড়ে লজ্জা নিবারণের চেষ্টা সুলতানার। ছেলেমেয়েদের কারও গায়ে কাপড় নেই। একেবারে ছোট দুই শিশুকে নিয়ে তিনি ত্রাণের খোঁজে সকাল থেকে বের হন। বড় দুটি শিশু থাকে বাবার কাছে। বিকেলে ফেরেন। এরপর যা জোটে তা দিয়ে নিজে ও সন্তানদের মুখে কিছু তুলে দেন। তিনি জানান, বাচ্চাগুলো দুধ দেখলেই খেতে চায়। কিন্তু আমার তো কিনে দেয়ার সাধ্য নেই। বুকের দুধও তেমন একটা পাচ্ছে না। জানি না এই দুর্দশা থেকে আমাদের কবে মুক্তি হবে।

মায়ের দুধের অভাবে যে কোন সময় ১৫ দিনের শিশুটির মৃত্যু হতে পারে। এমন ভাবনায় এখন রীতিমতো পাগল প্রায় লাইলী। কুতুপালংয়ের রাস্তায় নবজাতককে নিয়ে রোদে দাঁড়িয়ে থাকেন তিনি। যাকেই পাচ্ছেন সন্তানের দুধ কেনার জন্য টাকা চাচ্ছেন। বলছেন, আমার সন্তানকে বাঁচাতে সাহায্য কর। ভিক্ষে দাও। ওকে দুধ কিনে খাওয়াতে চাই। লাইলী জানালেন, শত চেষ্টাতেও শিশুটি বুকের দুধ পাচ্ছে না। বুধবার তাকে স্থানীয় শিশু মেডিক্যাল ক্যাম্পে ডাক্তারের কাছে নিয়ে গিয়েছিলাম। ডাক্তারা বলেছেন, মায়ের দুধ ছাড়া ওকে বাঁচানো কঠিন হবে। কিন্তু আমি নিজেই তো খাবার পাই না। দুধ কোথা থেকে আসবে। দুপুরের পর সন্তানের জন্য লাইলী দুধ কেনার টাকা সংগ্রহ করেন। বাজারে যান। দুধ কেনেন। কিন্তু কিভাবে খাওয়াবেন। নিজের কাছে সহায়-সম্বল বলতে তো কিছু নেই। দুধ খাওয়ানোর বাটিও আনতে পারেননি। তাই হৃদয়বান দোকানদার তাকে একটি পুরনো ফিডার দিয়েছেন। চা স্টল থেকে গরম পানি সংগ্রহ করে শিশুটিকে বাঁচানোর চেষ্টা শুরু হয় তার। তবুও যেন নবজাকটি না বাঁচানোর আশঙ্কা তার কোনভাবেই কাটছে না।

এদিকে স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পুষ্টিহীন মা ও শিশুদের ভবিষ্যত উজ্জ্বল নয়। পুষ্টিহীন শিশুদের শারীরিক ও মানসিক বিকাশ বাধাগ্রস্ত হবে। এ বিষয়ে জানতে চাইলে হেলথ এ্যান্ড হোপ লিমিটেডের চেয়ারম্যান ও শিশু গবেষক ডাঃ লেলিন চৌধুরী বলেন, পুষ্টিহীন শিশুরা সহজেই বিভিন্ন সংক্রামক রোগের শিকার হবে। সুস্থ শিশুদের মতো তাদের মানসিক বিকাশ হবে না। অর্থাৎ একটি অপরিপক্ব প্রজন্ম বেড়ে উঠবে। যারা নানা সমস্যায় জর্জরিত থাকবে আমৃত্যু। জনকণ্ঠ