বৃহস্পতিবার , ২৫শে এপ্রিল, ২০২৪ , ১২ই বৈশাখ, ১৪৩১ , ১৫ই শাওয়াল, ১৪৪৫

হোম > গ্যালারীর খবর > লক্ষ্মীপুর অশান্ত কেন

লক্ষ্মীপুর অশান্ত কেন

শেয়ার করুন

জেলা প্রতিনিধি, লক্ষ্মীপুর ॥ র‌্যাবের অভিযানের পরই অশান্ত হয়ে উঠেছে লক্ষ্মীপুর। অভিযানের দিন (১২ ডিসেম্বর) পরিস্থিতি সামাল দিতে র‌্যাবকে হেলিকপ্টার পাঠাতে হয়েছিল।

লক্ষ্মীপুর কেন অশান্ত হলো? এর কারণ খুঁজতে গেলে একেকজন একেক কথা বলেছেন। তবে বেশির ভাগ মানুষই বলেছেন, ১২ ডিসেম্বরের অভিযান লক্ষ্মীপুরকে অশান্ত করেছে।

অভিযোগ রয়েছে, স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতাদের ইচ্ছায় এই অভিযান চালানো হয়। স্থানীয় লোকজন জানান, অভিযান পরিচালনাকারী র্যাব-১১-এর একজন পদস্থ কর্মকর্তা আওয়ামী লীগের এক কেন্দ্রীয় নেতার জামাতা। এই অভিযানে র্যাবের সঙ্গে চাদর পরা, স্যান্ডেল পায়ে ও মুখোশধারী লোককেও দেখেছেন প্রত্যক্ষদর্শীরা। এঁরা কারা, তা কেউ নিশ্চিত করে বলতে পারেননি। তবে র্যাব এসব অভিযোগ অস্বীকার করেছে।

লক্ষ্মীপুর বরাবরই বিএনপির শক্ত ঘাঁটি। সর্বশেষ জাতীয় নির্বাচনে এই জেলার চারটি আসনেই বিএনপির প্রার্থীরা জয়লাভ করেন। এখানে জামায়াতের উল্লেখযোগ্যসংখ্যক কর্মী-সমর্থকও রয়েছেন। তাই হরতাল-অবরোধের মতো কর্মসূচি এখানে কঠোরভাবে পালিত হয়।

গত ২৮ ফেব্রুয়ারি দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর ফাঁসির রায় ঘোষণার পর জেলাটিকে একরকম বিচ্ছিন্ন করে দেয় জামায়াত-শিবির। জ্বালিয়ে দেওয়া হয় একটি সরকারি কার্যালয়। এরপর ট্রাইব্যুনালের যত রায় হয়েছে, তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে তারা। কিন্তু বড় ধরনের সহিংসতা ঘটেনি।

স্থানীয় লোকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ১২ ডিসেম্বরের অভিযানে পাল্টে যায় পরিস্থিতি। বিএনপি ও জামায়াতের প্রায় সব নেতা-কর্মীই এখন আত্মগোপনে। শহরে আওয়ামী লীগের নেতারা নিরাপদে থাকলেও শহরের বাইরের নেতারা ঘরছাড়া।

স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, ১২ ডিসেম্বর ভোরে র্যাব-১১-এর দুটি গাড়ি আর দুটি মাইক্রোবাস জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক সাহাবুদ্দীনের শহরের উত্তর তেমুহনীর বাসায় ঢোকে। সাহাবুদ্দীনের পায়ে গুলি করে তাঁকে, তাঁর ছোট ভাই ও বাড়ির দুই কর্মীকে ধরে নিয়ে যায় র্যাব। এ সময়র‌্যাবের সঙ্গে চাদর গায়ে স্যান্ডেল পরা মুখোশধারী কিছু লোক ছিল। তারা সাহাবুদ্দীনের বাসায় ঢুকে দুটি মাইক্রোবাস ও একটি গাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেয়, আসবাব ভাঙচুর করে।

এ খবর ছড়িয়ে পড়লে সকাল সাতটার দিকে ১৮ দলের ১৫-২০ জন নেতা-কর্মী হাসপাতাল রোড থেকে মিছিল নিয়ে সাহাবুদ্দীনের বাসার দিকে যেতে শুরু করেন। আধা কিলোমিটার হেঁটে মিছিলটি চকবাজারে পৌঁছালে র্যাবের দুটি গাড়িও সেখানে পৌঁছায়। এরপর দুই পক্ষের গোলাগুলি শুরু হয়। ১৮ দলের মিছিলের সামনে থাকা ইকবাল এ সময় গুলিবিদ্ধ হন। তখন নেছার ও জুয়েল নামে আরও দুজন গুলিবিদ্ধ হন।

প্রত্যক্ষদর্শী এক নারী ভিক্ষুক বলেন, গোলাগুলির পর একটি সাদা মাইক্রোবাসে ইকবালের লাশ তুলে নেওয়া হয়। পরে ওই ঘটনাস্থলে ইকবালের স্যান্ডেল ও রক্ত দেখা গেলেও লাশ মেলেনি।

গোলাগুলি ও ইকবালের লাশ মাইক্রোবাসে তুলে নেওয়ার খবরে বের ওপর হামলা চালান ১৮ দলের কর্মীরা। তাঁরা র‌্যাব সদস্যদের পুলিশ লাইনের ভেতরে দীর্ঘ সময় অবরুদ্ধ করে রাখেন। ওই দিনের ঘটনায় র্যাবের গুলিতে তিনজন নিহত হন। এ সময় র্যাবের সহযোগী এক তরুণকে পিটিয়ে মেরে ফেলেন ১৮ দলের নেতা-কর্মীরা। তাঁর নাম হরিপদ দেবনাথ, বাড়ি সদরের উপকণ্ঠের ভবানীগঞ্জে।

সাহাবুদ্দীনের বাড়িতে হামলার পর তাঁকেই একটি মামলার আসামি করা হয়। ওই মামলায় আরও ১১ জনের নাম উল্লেখ করে অজ্ঞাতনামা তিন হাজার জনকে আসামি করা হয়। সাহাবুদ্দীন আহত হয়ে কোথাও চিকিৎসাধীন আছেন বলে দলের নেতা-কর্মীরা জানান।

ইকবালের গুম হওয়ার ঘটনায় লক্ষ্মীপুর থানায় কোনো মামলা হয়নি। ইকবালের বাবা নুরুল ইসলাম জানিয়েছেন, তাঁর ছোট ছেলে লক্ষ্মীপুর সদর থানায় গিয়েছিলেন। থানা কোনো মামলা বা জিডি নেয়নি। তাঁর আকুতি, ‘আমাদের যদি কেউ শুধু লাশের খোঁজ দেয়, তাহলেই আমাদের আর কোনো দাবি থাকবে না।’

ইকবালের গুম হওয়া সম্পর্কে জানতে চাইলে লক্ষ্মীপুর সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) ইকবাল হোসেন বলেন, এ ব্যাপারে তাঁর কাছে কোনো তথ্য নেই।

জামায়াত নেতা ফয়েজ হত্যা: লক্ষ্মীপুর জেলা জামায়াতের নায়েবে আমির ফয়েজ আহম্মদ হত্যার ঘটনায়ও মামলা হয়নি। পরিবারের পক্ষ থেকে তাঁকে হত্যার জন্য র্যাবকে দায়ী করা হয়েছে।

৬৫ বছরের এই চিকিৎসক লক্ষ্মীপুর সদরের একটি হাসপাতাল ও স্কুলসহ বিভিন্ন ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান চালাতেন। তাঁর স্ত্রী মার্জিয়া বেগম অভিযোগ করেন, ১৩ ডিসেম্বর রাত ১২টার দিকে দু-তিনটি গাড়ি নিয়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য পরিচয়ে র‌্যাবও কিছু মুখোশধারী লোক জেলার উত্তর তেমুহনীতে তাঁদের বাসার ফটকের তালা ভেঙে ঢুকে পড়েন। তাঁরা ফয়েজকে জোর করে ছাদে নিয়ে মাথায় গুলি করে ছাদ থেকে ফেলে দিয়ে হত্যা করে লাশ গাড়িতে তুলে নিয়ে যান। তবে এই অভিযোগ অস্বীকার করেছে র্যাব।

হাসপাতাল সূত্র জানিয়েছে, এ ঘটনায় পুলিশ শুধু একটি জিডি করেছে। জিডি মূলে ময়নাতদন্ত সম্পন্ন হয়েছে। এ ঘটনার পরদিন থেকে ফয়েজের পরিবার এলাকায় নেই।

র‌্যাবের আইন ও জনসংযোগ শাখার প্রধান উইং কমান্ডার এ টি এম হাবিবুর রহমান এসব অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। তিনি বলেন, ১২ ডিসেম্বর সকালে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর একটি দল লক্ষ্মীপুর শহরের উত্তর তেমুহনী এলাকায় টহল দিচ্ছিল। এ সময় সেখানে একদল লোক র্যাবের ওপর ইটপাটকেল ও ককটেল নিক্ষেপ করে হামলা শুরু করে। টহল দলটি পাল্টা গুলি ছুড়লে তিনজন গুলিবিদ্ধ হন। এঁদের একজন বিএনপির নেতা সাহাবুদ্দীন। আর মিছিলে যুবদলের নেতা ইকবাল নিহত হওয়ার বিষয়ে র্যাব কিছুই জানে না। চিকিৎসক ফয়েজ আহম্মদের বাসায় র‌্যাবের কোনো অভিযানই হয়নি।