শুক্রবার , ১৯শে এপ্রিল, ২০২৪ , ৬ই বৈশাখ, ১৪৩১ , ৯ই শাওয়াল, ১৪৪৫

হোম > গ্যালারীর খবর > শামুক কুড়িয়ে সংসার চলে ৪০০ পরিবারের

শামুক কুড়িয়ে সংসার চলে ৪০০ পরিবারের

শেয়ার করুন

বাংলাভূমি২৪ ডেস্ক ॥
রাজবাড়ী: নিজস্ব জমি-জমা নেই এদের প্রায় কারোরই। কারো কারো আছে ভিটেমাটি টুকু। বছরের ধান ও পাট মৌসুমে পরের জমিতে কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করেন তারা।

তবে বর্ষা আর শীতের শুরু পর্যন্ত এদের হাতে থাকেনা তেমন কোনো কাজ। বেঁচে থাকার মতো বিকল্প কোনো উপায় না থাকায় এসব লোকজন বিভিন্ন বিল-ঝিল আর খাল থেকে শামুক কুড়িয়ে জীবিকা নির্বাহ করেন।

এসব শামুক প্রকৃতি ও কৃষির জন্য উপকারী হলেও সে সম্পর্কে জানেন না তারা। বেঁচে থাকার জন্যই শামুক কুড়িয়ে সংসার চলে এসব পরিবারের।

শামুক কুড়ানি এসব মানুষের বাস রাজবাড়ী সদর ও বালিয়াকান্দি উপজেলার কয়েকটি গ্রামে। রাজবাড়ী সদর উপজেলার খানখানাপুর ও বসন্তপুরের কিছু এলাকায় শামুক কুড়ানি মানুষের দেখা মিললেও এদের অধিকাংশেরই বসবাস বালিয়াকান্দি উপজেলার পাতুরিয়া, বারগ্রাম, নতুনচর, গুচ্ছগ্রাম, বাঘুটিয়া, বারেক গ্রাম, তুলসী বরাট, কোমড়দিয়া, গোবিন্দপুর, নটাপাড়া, মাশালিয়া, লক্ষ্মণদিয়া, সাঙ্গুরা, সন্ধ্যা, বাগচীডাঙ্গী, বেচকোলা, মঙ্গলবাড়ী, রতনদিয়া, মুচিদাহ ও বেলেশ্বর গ্রামে।

এসব গ্রামের বিল ও বিল সংলগ্ন নিচু জমিতে বর্ষাকালে বিল বিশাল আকার ধারণ করে। তখন পানিতে সয়লাব হয়ে যায় বিস্তীর্ণ এলাকা। ফলে এসব এলাকার মানুষরাই শামুক কুড়িয়ে বছরের নির্দিষ্ট একটা সময় সংসারের খরচা চালায়।

এসব বিল- ঝিল ও খালে বর্ষার পানি নামতে শুরু করলেই দেখা মেলে প্রচুর শামুকের। শীতের শুরু পর্যন্ত শামুকের পাচুর্য্য থাকে।

শামুক কুড়ানিদের সঙ্গে আলাপ করে জানা যায়, নিজেদের জমি-জমা না থাকায় প্রায় সারা বছরই তারা পরের জমিতে কাজ করে সংসার চালান। কিন্তু বর্ষাকাল থেকে শীতের শুরু পর্যন্ত তেমন কৃষিকাজ না থাকায় সংসার চালাতে হিমশিম খান তারা। তাই বর্ষার শেষ থেকে শীতের শুরু পর্যন্ত আশপাশের খাল-বিল থেকে শামুক সংগ্রহ করেন তারা। এ কাজে তাদের পরিবারের নারী ও শিশুরাও অংশ নেয়।

তারা জানান, বাজারে শামুকের বেশ চাহিদা। বিল থেকে শামুক সংগ্রহ করা হলে এসব শামুক বস্তাবন্দী হয়ে ট্রাকে করে চলে যায় খুলনা-বাগেরহাটে অঞ্চলের চিংড়ির ঘেরগুলোতে।

তবে এজন্য তাদের তেমন কষ্ট করতে হয়না। শামুক কুড়িয়ে বস্তাভর্তি করা পর্যন্ত তাদের কাজ। এরপর রাস্তা থেকেই তা কিনে নেয় নির্দিষ্ট ক্রেতারা।

জানা যায়, বাজারে শামুকের বেশ চাহিদা থাকায় হতদরিদ্র এসব মানুষেরে মিছিলে যোগ দিয়েছে অনেক বেকার যুবক, দরিদ্র পরিবারের নারী ও শিশুরা। এ সময়টায় বিলে গিয়ে দেখা মেলে দলে দেলে শামুক আহরণে ব্যস্ত বিভিন্ন বয়সী নারী-পুরুষ।

বিভিন্ন বিল থেকে শামুক সংগ্রহের পর সদর উপজেলার জামালপুর-কোলারহাট সড়কের মাশালিয়া সেতুর পাশে বস্তাভর্তি শামুক জড়ো করা হয়। সেখান থেকে গভীর রাতে ট্রাকে করে পাঠানো হয় খুলনার বিভিন্ন চিংড়ি ঘেরে।

প্রতিদিন ৭/৮ আট ঘণ্টা কাজ করে একজন কৃষক এক বস্তার মতো শামুক কুড়াতে পারেন। নারী ও শিশুদের ক্ষেত্রে তা কম হয়। তবে আবহাওয়া ভালো ও পাচুর্য্য থাকলে দুই বস্তা পর্যন্ত শামুক পাওয়া যায়। বস্তাপ্রতি শামুক ২০০ থেকে ২৫০ টাকায় বিক্রি হয় ব্যাপারীদের কাছে।

এদিকে, স্থানীয় এসব এলাকার অনেকে আবার শামুক না কুড়িয়ে এটা বেচাকেনার সঙ্গে জড়িত। এদের কেউ কেউ বিল থেকে সংগ্রহকারীদের কাছ থেকে শামুক কিনে নেন। পরে তা বাজারে নিয়ে একটু বেশি দামে বিক্রি করেন। পরে তাদের কাছ থেকে কিনে নেন বেপারীরা। শেষ পর্যন্ত রাতে একইভাবে তা চলে যায় খুলনার বিভিন্ন চিংড়ি ঘেড়ে।

শামুক সংগ্রহকারী দীনেশ দাস বাংলানিউজকে জানান, রাজবাড়ীর মাসালিয়া বিল থেকে তারা শামুক সংগ্রহ করেন। এ বিলে শামুক বেশি পাওয়া যায়। আষাঢ় মাস শেষে পাট কাটার পড়ে তাদের হাতে কাজ থাকে না। এ সময়টাতে তাদের শামুক কুড়িয়ে চলতে হয়। এক বস্তা শামুক প্রায় এক হাজার সংখ্যক হয়। এ শামুক বিল থেকে তুলতে তাদের অনেক পরিশ্রম করতে হয়।

তিনি জানান, সারাদিন শেষে বস্তাভর্তি শামুক বিক্রি করে ২০০-২৫০ টাকা পেলেও তা দিয়ে তাদের সংসার চলেনা। বাধ্য হয়েই তাই তারা পরিবারের নারী ও ছেলে-মেয়েকেও এ কাজে নামান।

তিনি জানান, তাদের এ কাজ ভাল লাগেনা। বিকল্প কোনো কাজ থাকলে এতো পরিশ্রম ও অনিশ্চয়তার কাজ তারা করতেন না। তবে প্রকৃতিতে শামুকের গুরুত্ব সম্পর্কে কোনো ধারণা নেই তাদের।

এদিকে, এসব এলাকায় মাত্রাতিরিক্ত আহরণ এবং ফসল চাষাবাদে কীটনাশক ব্যবহারের কারণে শামুক-ঝিনুক এখন প্রায় বিলুপ্তির পথে। প্রকৃতিবান্ধব হিসেবে পরিচিত শামুক এভাবে সংগ্রহ করা হলে তা প্রাকৃতিক ভারসাম্য বিনষ্ট করতে পারে বলে আশঙ্কা প্রাণীবিদদের ।

এ বিষয়ে রাজবাড়ী সরকারি কলেজের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের বিভাগীয় প্রধান প্রফেসর মো. নূরুজ্জামান বাংলানিউজকে বলেন, শামুক একটি নিরীহ জলজ প্রাণী। শামুক পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা ও পানি পরিষ্কার করে। প্রকৃতির বন্ধু এবং মানুষেরও বন্ধু হিসেবে প্রকৃতিতে তার অবস্থান।

তিনি বলেন, এভাবে শামুক সংগ্রহ করা হলে একসময় শামুক প্রকৃতি থেকে বিলীন হয়ে যাবে। এতে করে পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট হবে। ফলে বিভিন্ন প্রকার মাছ ও জলজ প্রাণী স্বাভাবিক জীবনচক্রে সমস্যা দেখা দেবে। তাই প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষায় এভাবে শামুক নিধন করা উচিত নয় বলে তিনি জানান। বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম