শুক্রবার , ২৯শে মার্চ, ২০২৪ , ১৫ই চৈত্র, ১৪৩০ , ১৮ই রমজান, ১৪৪৫

হোম > Uncategorized > “সমকামিতার অন্তরালে কেবলই যৌনতা?”

“সমকামিতার অন্তরালে কেবলই যৌনতা?”

শেয়ার করুন

বাংলাভূমি২৪ ডেস্ক ॥ সত্যি বলতে কি, সমকামিতা কোনো আধুনিক বিষয় নয়। বরং অনেক অনেক প্রাচীন কাল হতেই এর অস্তিত্ব আছে। কঠিন অনুশাসনময় সমাজ ব্যবস্থায়, যেখানে নারী-পুরুষের পরস্পরের সংস্পর্শে আসার সুযোগ ছিল খুব কম, গবেষকরা বলেন মূলত সেখানেই জন্ম সমকামিতার। মানুষ মাত্রই তার কিছু যৌন চাহিদা আছে, এবং প্রকৃতি প্রদত্ত ভাবেই জীবনের একটা নির্দিষ্ট পর্যায়ে তা অত্যন্ত জোরালো ভাবে উপস্থিত হয়। কঠিন অনুশাসনের সমাজ ব্যবস্থায় বিপরীত লিঙ্গের সংস্পর্শে আসার চাইতে সহজ ছিল সম লিঙ্গের সঙ্গ পাওয়া, স্বভাবতই অনেকের আকর্ষণ গড়ে ওঠে সম লিঙ্গের মানুষের প্রতি। এ কারণেই সমকামিতার ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যাবে অতীতকালে যোদ্ধা, নাবিক ইত্যাদি পেশায় জড়িত পুরুষদের মাঝে যেমন সমকামী জোড়া ছিল; তেমনি ছিল বিধবা আর ধর্মীয় কারণে চিরকুমারী রয়ে যাওয়া নারীদের মাঝেও। সমকামিতা সব সময়েই ছিল সমাজের একটি “ওপেন সিক্রেট”… সকলে বুঝতো, কিন্তু কেউ কথা বলতে চাইত না বিষয়টি নিয়ে। বর্তমান সময়ের সাথে তখনকার সমকামিতার পার্থক্য কেবল এটাই।

প্রশ্নটা হলো, শুধুই কি যৌনতাই মুখ্য ভূমিকা রেখেছে সমকামিতার নেপথ্যে?

সে প্রশ্নের জবাব খুঁজতে হলে আমাদের যেতে হবে আরও খানিকটা গভীরে। বর্তমান সময়ে সমকামিতা শুধুমাত্র পশ্চিমা দেশের গণ্ডিতে সীমাবদ্ধ নেই, বরং তা পাশের দেশ ভারতের সীমানা পেরিয়ে আমাদের দেশেও সংবাদ হতে শুরু করেছে। পৃথিবীর অনেক দেশেই সমকামিতাকে দেয়া হয়েছে বৈধতা, সমকামী প্রেমিক যুগলদের বিয়ের জন্য আইনও পাশ হয়েছে দেশে দেশে। এখনও অনেক দেশে আন্দোলন চলছে সমকামিতাকে আইনত বৈধ করার জন্য। প্রাচীনকাল থেকে যে সম্পর্কের অস্তিত্ব আছে, এখন আর সমাজ সেটাকে অস্বীকার করতে পারছে না। আর পারার কথাও নয়। সমকামী যুগলেরা এখন ঘটা করে বিবাহ করছেন, নিজের সমকামী হবার বিষয়টিকে গোপন করার চেষ্টা করছেন না কিংবা সেটা নিয়ে লজ্জিতও বোধ করছেন না।

সমকামিতা ভালো কি মন্দ- সে ব্যাপারটি নিয়ে আমরা তর্কে যাবো না। তবে এই ব্যাপারটি অস্বীকারের কোনো উপায় নেই যে সমকামিতা প্রকৃতির নিয়ম বিরুদ্ধ একটি ব্যাপার। পৃথিবীর বুকে মানব সভ্যতা টিকে থাকে নারী ও পুরুষের মিলনের মাধ্যমে সন্তান উৎপাদন হওয়ার মাধ্যমে। সমকামী দম্পতিরা পরস্পরকে অনেক কিছু দিতে পারলেও স্বভাবতই জৈবিক উপায়ে একটি সন্তান দিতে পারেন না। আবার অন্যদিকে তথ্য উপাত্ত ঘাঁটলে দেখা যায় যে বিবাহিত সমকামী যুগলদের মাঝে ডিভোর্স প্রায় নেই বললেই চলে। শুধু তাই নয়, প্রেমে প্রতারণার হারও সমকামী যুগলদের মাঝে অনেকটাই কম। আধুনিক বিশ্বের বেশীরভাগ নারী পুরুষ আজকাল যখন বিবাহ বিমুখ, সেখানে সমকামীদের আগ্রহ বিয়ে করার দিকেই বেশী। শুধু তাই নয়, বিয়ে করে সন্তান দত্তক নিয়ে একটি সুখী পরিবার গড়ে তোলার দিকে তাদের আগ্রহ অনেকটাই বেশী স্বাভাবিক যুগলদের চাইতে।

স্পষ্টতই বোঝা যাচ্ছে যে সমকামিতার নেপথ্য কারণ কেবলই যৌনতা নয়। বরং এর গভীরে হয়তো আছে আরও অর্থবহ কিছু একটা। কিন্তু তা কি? এখানে ভুলে গেলে চলবে না যে পৃথিবীর প্রত্যেক দেশেই সমকামিতাকে সামাজ ও ধর্ম বিরুদ্ধ কাজ হিসাবেই দেখা হয়।

কিছু দিন আগেই একজন ভারতীয় মেয়ের বিয়ের ছবি নিয়ে ফেসবুক পাড়ায় বেশ শোরগোল শুরু হয়েছিল।

কারণ? মেয়েটি যাকে বিয়ে করছে সেও একজন নারী। সুন্দরী একজন শ্বেতাঙ্গ নারীকে বিয়ে করেছিল মেয়েটি এবং তা পুরোপুরি পরিবার পরিজনদের সমর্থনে। ছবিতে আপনারা দেখতে পাবেন যে পরিবার ও বন্ধুদের সমর্থকে শতভাগ ধর্মীয় রীতিনীতি মেনে তারা আবদ্ধ হয়েছেন বিবাহ বন্ধনে। তারও কিছু দিন আগে খবরে এসেছিল দুজন পুরুষের বিয়ের খবর। আর সম্প্রতি কিছুদিন আগেই বাংলাদেশের দুটি মেয়েকে নিয়ে খবর হলো, প্রেমের টানে যারা ঘর ছাড়া। পশ্চিমা দেশ গুলোতে এসব সংবাদ ডাল-ভাত হলেও আমরা এখনও সহজ ভাবে নিতে পারিনি। আমাদের দেশে আজো নারী-পুরুষের চিরন্তন প্রেমের সম্পর্কটিকেই “খারাপ” দৃষ্টিতে দেখা হয়, স্বভাবতই সমকামিতাকে মেনে নেয়া আমাদের পক্ষে এখনও অসম্ভব একটি বিষয়। কিন্তু তাতে এই সত্যতা কিছুতেই বদলে যায় না যে প্রত্যেক মানুষের অধিকার আছে নিজের জীবনটা একান্তই নিজের মতন করে কাটাবার, একজন মানুষ সমকামী বলেই তাকে উত্যক্ত বা অপমান- অপদস্থ করা মানবাধিকারের লঙ্ঘন।

সমকামিতা বৈধ-অবৈধ, খারাপ-ভালো, নোংরা-পরিছন্ন ইত্যাদি ইত্যাদি নানান মতামতের চাইতেও অনেক বেশী জরুরী এই ব্যাপারটি যে ক্রমশ বাড়ছে সমকামী যুগলদের হার। কিন্তু মানব প্রজাতির মাঝে সমকামিতা উল্লেখযোগ্য হারে বৃদ্ধি পাবার কারণটা আসলে কি? কি সেই কারণ, যার ফলে বিপরীত লিঙ্গের চাইতে সম লিঙ্গের প্রতিই আকর্ষণ বৃদ্ধি পাচ্ছে?কেন এই প্রকৃতির বিরুদ্ধাচরণ?

অনেকে মনে করছেন, বিপরীত লিঙ্গের প্রতি অবিশ্বাস এই অনীহার মূল কারণ। নারী এবং পুরুষ উভয়েই নানাভাবে বিপরীত লিঙ্গের দ্বারা শারীরিক/ মানসিকভাবে নির্যাতিত হয়ে থাকে, নারীদের ক্ষেত্রে আবার নির্যাতিত হবার হার আবার অনেকটাই বেশী। বিশেষ করে শারীরিকভাবে নির্যাতন। এমনটা অনেক ক্ষেত্রেই দেখা গিয়েছে যে স্বামী বা প্রেমিক দ্বারা শারীরিক-মানসিক নির্যাতিত হবার পর অনেক নারীই পরবর্তী জীবনে বেছে নিয়েছেন একজন নারী সঙ্গীকে। পুরুষদের ক্ষেত্রেও পরিবেশ- পরিস্থিতি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। জেলে থাকা, নাবিক বা যোদ্ধার জীবনে পুরুষেরা সমকামিতায় বেশী আকৃষ্ট হয়ে পড়ে।

তবে কেবল পরিবেশ পরিস্থিতি নয়, সাথে আছে মানসিক কারণও। এ কথা এখন অস্বীকারের কোনো উপায় নেই যে অনেক নারী বা পুরুষই শারীরিকভাবে এক রকম জন্ম গ্রহণ করলেও মানসিক ভাবে তিনি থাকেন বিপরীত লিঙ্গের কেউ। যেমন ধরুন, একজন মানুষ শারীরিক ভাবে পুরুষ, কিন্তু নিজের মনের মাঝে বা মানসিক ভাবে তিনি একজন নারী। এইজন্যই আমরা মেয়েলী স্বভাবের পুরুষ ও পুরুষালী স্বভাবের নারী দেখতে পাই। উদাহরণ হিসাবে আমরা সদ্য প্রয়াত পরিচালক ঋতুপর্ণ ঘোষের কথা বলা যেতে পারে। জন্ম থেকে তিনি একজন পুরুষ। জীবনের বেশীরভাগ অংশটাই তিনি পুরুষ রূপে অতিবাহিত করেছেন। কিন্তু নিজের মনের মাঝে তিনি ছিলেন একজন নারী। এবং এক পর্যায়ে শারীরিকভাবে নারী হয়ে ওঠার চেষ্টাও প্রবল ভাবে করে গেছেন। সুতরাং স্বভাবতই, লিঙ্গ পরিবর্তন অপারেশনের আগে ঋতুপর্ণ ঘোষের সাথে অপর পুরুষের সম্পর্ককে সমকামিতা ব্যতীত অন্য কিছু বলার উপায় নেই।

আবার অনেক ক্ষেত্রেই দেখা গিয়েছে যে যেসব নারী বা পুরুষ নিজেকে যথেষ্ট আকর্ষণীয় মনে করেন না কিংবা বিপরীত লিঙ্গের কেউ যখন তাদের প্রতি আগ্রহ প্রদর্শন করেন না, তখন তারা সমকামিতার প্রতি আকৃষ্ট হন। কিন্তু এসব কারণ ছাড়া কি সমকামিতার উদাহরণ নেই? তাও আছে! একেবারে নিখাদ ভালোবাসা থেকে সমকামী প্রেমের উদাহরণও আছে ভুরি ভুরি।

তবে কারণ যাই হোক না কেন, বর্তমান সমাজ ব্যবস্থার প্রেক্ষাপটে সমকামিতাকে অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই। যতই দাবিয়ে রাখার চেষ্টা করা হোক না কেন, সমাজ বিজ্ঞানীদের ধারণা যে আরও প্রবল ভাবে দেখা দিতে যাচ্ছে বিষয়টি। এবং হ্যাঁ, আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটেও।

এবং এটা এমন একটি বিষয় যাতে ঐক্যমতে পৌঁছানো আসলে অসম্ভব। কারো কাছে ভালো লাগবে, কারো কাছে নোংরা মনে হবে, কেউ মনে করবেন যার যার ব্যক্তিগত ব্যাপার। তবে এক কথা নিশ্চিত যে সমকামিতার নেপথ্য কারণ কেবলই যৌনতা নয়। যৌনতা ছাড়াও এর অন্তরালে আছে মানবিক আবেগ ও বোঝাপড়ার একটি দৃঢ় বন্ধন। অনেক সমকামী যুগল এমন দেখা গিয়েছে যে যাদের কাছে যৌনতার ততটা মূল্য নেই, যতটা মূল্য পরস্পরের সাথে “বিবাহিত” হিসাবে জীবন কাটাবার মাঝে।

ক্রমশ বাড়তে থাকা সমকামিতার হার পৃথিবী কিংবা সমাজকে কোনদিকে নিয়ে যাচ্ছে সেটা এখনই বলার কোনো উপায় নেই। এই হার কি আরও বাড়বে নাকি একটা নির্দিষ্ট পরিধিতেই থেকে যাবে, সেটাও নিশ্চিত হবার কোনো উপায় নেই। তবে একটি কথা নিশ্চিত ভাবে বলা যায় যে সমকামী যুগলদের অস্বীকার এখন অসম্ভব। এবং পৃথিবী জুড়েই মানুষের দৃষ্টি ভঙ্গি ক্রমশ এই ব্যাপারে বদলে যাচ্ছে, হচ্ছে আরও উদার।