শুক্রবার , ১৯শে এপ্রিল, ২০২৪ , ৬ই বৈশাখ, ১৪৩১ , ৯ই শাওয়াল, ১৪৪৫

হোম > গ্যালারীর খবর > সম্পদের তথ্য লুকানোর উপায় খুঁজছে ইসি

সম্পদের তথ্য লুকানোর উপায় খুঁজছে ইসি

শেয়ার করুন

বাংলাভূমি২৪ ডেস্ক ॥ প্রার্থীদের ব্যক্তিগত তথ্য, বিশেষ করে সম্পদের বিবরণী জনসমক্ষে প্রকাশের ব্যাপারে আওয়ামী লীগের আপত্তি আমলে নিয়েছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। কমিশন এখন সম্পদের বিবরণী প্রকাশ বন্ধ করার জন্য আইনের ফাঁকফোকর খুঁজছে।

হলফনামা আকারে প্রার্থীদের ব্যক্তিগত তথ্য প্রকাশের ব্যাপারে সর্বোচ্চ আদালতের সুস্পষ্ট নির্দেশনা আছে। আদালতের আদেশ ও গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশের (আরপিও) মাঝখানে এখন ফোকর খুঁজে বেড়াচ্ছে কমিশন।

গত বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের সময়েও এই চেষ্টা হয়েছিল। ‘ভুয়া ব্যক্তির’ মাধ্যমে আবেদন করে আদালতেই তা আটকানোর চেষ্টা করা হয়েছিল। সে চেষ্টা অবশ্য ব্যর্থ হয়। হলফনামার তথ্য গোপন রাখার জন্য তখনকার নির্বাচন কমিশনও সরকারি দলের পক্ষে নানা চেষ্টা করেছিল।

হাইকোর্টের রায়ের পর বিএনপির সময় অষ্টম সংসদে পাঁচটি উপনির্বাচন হয়। তখন আলোচিত বিচারপতি এম এ আজিজ ছিলেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার। ২০০৫ সালের ২০ জুলাই অনুষ্ঠিত সুনামগঞ্জ-৩ আসনের উপনির্বাচনে প্রার্থীরা হলফনামা জমা দিলেও রিটার্নিং কর্মকর্তা পুরো তথ্য প্রকাশ না করে সারাংশ প্রকাশ করেন। এর পক্ষে তখন নির্বাচন কমিশন ব্যাখ্যায় দাবি করেছিল, শাস্তির কথা বলা না থাকায় তথ্য প্রকাশ করা ঐচ্ছিক, বাধ্যতামূলক নয়।

দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মনোনয়নপত্রের সঙ্গে জমা দেওয়া হলফনামায় আওয়ামী লীগের সাবেক ও বর্তমান মন্ত্রী-সাংসদেরা স্বেচ্ছায় তাঁদের সম্পদের তথ্য দিয়েছেন। নিয়মানুযায়ী নির্বাচন কমিশন তার ওয়েবসাইটে তা প্রকাশ করেছে। এরপর কয়েক দিন ধরে গণমাধ্যমে কয়েকজন মন্ত্রী-সাংসদের অস্বাভাবিক সম্পদ অর্জনের তথ্য প্রকাশিত হতে থাকে। এ নিয়ে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি ও সরকারের মধ্যে প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়।

গত রোববার আওয়ামী লীগের নির্বাচন কমিশন সমন্বয় উপকমিটির আহ্বায়ক ও সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মহীউদ্দীন খান আলমগীরের নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধিদল প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী রকিব উদ্দীন আহমেদের সঙ্গে দেখা করেন। তাঁরা প্রার্থীদের ব্যক্তিগত তথ্য জনসমক্ষে প্রকাশের ব্যাপারে আপত্তি জানান।

কমিশনকে প্রতিনিধিদল বলেছে, প্রার্থীদের শিক্ষাগত যোগ্যতা ও প্রতিশ্রুতি-সংক্রান্ত সাধারণ তথ্য প্রকাশ করা যেতে পারে। কিন্তু তাঁদের এবং পরিবারের নির্ভরশীলদের সম্পদের তথ্য প্রকাশ যুক্তিসংগত নয়।

কমিশন সচিবালয় সূত্র জানায়, গতকাল সিইসি বিষয়টি নিয়ে চার নির্বাচন কমিশনারের সঙ্গে আলোচনা করেছেন। বৈঠকে একজন কমিশনার বলেছেন, এ বিষয়ে আইন আছে, আদালতের নির্দেশনা আছে। কমিশনের কিছু করার নেই। আইন সংশোধন করে হলফনামার প্রকাশ বন্ধ করা হলে তা আদালতের নির্দেশনার পরিপন্থী হবে। তবে কমিশন ক্ষমতাসীন দলের অনুরোধ উপেক্ষা করতে পারছে বলে গতকাল পর্যন্ত মনে হয়নি।

জানতে চাইলে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান বলেন, আওয়ামী লীগের প্রস্তাব খতিয়ে দেখার কোনো সুযোগ নেই। যদি নির্বাচন কমিশন তা করে, তাহলে ধরে নিতে হবে, তারা সরকারের বি টিম হিসেবে কাজ করছে। একটি দলের চাপে হলফনামার প্রকাশ বন্ধ করা হলে দুর্নীতি ও অবৈধ সম্পদ অর্জনকে উৎসাহিত করা হবে।

ফাঁকফোকরের সন্ধানে: সূত্র জানায়, কীভাবে প্রার্থীদের সম্পদের তথ্য প্রকাশ বন্ধ করা যায়, সেই উপায় খতিয়ে দেখছে কমিশন। কমিশনের বৈঠকে আলোচিত সম্ভাবনাগুলো ছিল—প্রার্থীদের নিজস্ব তথ্য প্রকাশ করে নির্ভরশীলদের তথ্য প্রকাশ না করা। হলফনামার তথ্য সর্বসাধারণের জন্য উন্মুক্ত না করে শুধু প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীদের জন্য উন্মুক্ত করা।

কমিশন সচিবালয় সূত্র জানায়, সিইসি এ-সংক্রান্ত আদালতের রায় এবং আইনকানুন খতিয়ে দেখার জন্য চার কমিশনার ও কমিশন সচিবালয়ের আইন শাখাকে দায়িত্ব দিয়েছেন। তাঁরা দু-এক দিনের মধ্যে তাঁদের মতামত দেবেন।

হলফনামা প্রকাশের বিষয়ে জানতে চাইলে গতকাল সিইসি সাংবাদিকদের বলেন, ‘এটা নতুন কোনো বিষয় নয়। আগে থেকেই হয়ে আসছে। ২০০৮ সালেও ছিল। কাজেই আইনকানুন দেখতে হবে।’

হলফনামার প্রকাশ বন্ধ করা হবে কি না—জানতে চাইলে সিইসি বলেন, ‘দেখা যাক। আইনকানুন দেখে সিদ্ধান্ত নেব।’

হলফনামার বিএনপি-অধ্যায়: প্রার্থীদের শিক্ষাগত যোগ্যতা, আয়ের উৎস ও ফৌজদারি অপরাধের সঙ্গে সংশ্লিষ্টতাসহ আট ধরনের তথ্য জানানোর নির্দেশনা চেয়ে সুপ্রিম কোর্টের তিন আইনজীবী আবদুল মোমেন চৌধুরী, কে এম জাবের ও জহুরুল ইসলাম ২০০৫ সালে জনস্বার্থে রিট করেন। ওই বছরের ২৩ এপ্রিল সরকার ও নির্বাচন কমিশনের প্রতি রুল জারি করেন আদালত। ২৪ মে হাইকোর্ট প্রার্থীদের আট ধরনের তথ্য সরবরাহের নির্দেশ দিয়ে রায় দেন।

এরপর সন্দ্বীপের জনৈক আবু সাফার আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে আপিল বিভাগের অবকাশকালীন চেম্বার বিচারপতি জয়নুল আবেদীন ২০০৬ সালের ১৯ ডিসেম্বর রায়ের কার্যকারিতা স্থগিত করেন। বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে ২২ জানুয়ারির একতরফা নির্বাচনের (যা পরে হয়নি) মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার পাঁচ দিন আগে এই স্থগিতাদেশ আসে। তাই তখন অভিযোগ ওঠে, বিএনপি পেছনে থেকে জনৈক আবু সাফাকে দিয়ে এই আবেদন করিয়েছে।

এক-এগারোর পট পরিবর্তনের পর ২০০৭ সালের ১৯ নভেম্বর আপিলের ওপর শুনানি শুরু হয়। ২০ নভেম্বর আদালত আবু সাফাকে হাজির করতে নির্দেশ দেন। কিন্তু তাঁকে হাজির করা হয়নি। ২০০৭ সালের ১১ ডিসেম্বর তৎকালীন প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বে আপিল বিভাগের সাত সদস্যের পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চ ওই আপিল খারিজ করে দেন। ফলে হাইকোর্টের রায় বহাল থাকে।

হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে আবেদনকারী আবু সাফার আইনজীবী ওমর সাদাত গতকাল বলেন, ‘আমি আবেদনটি করিনি। এক আইনজীবী যোগাযোগ করেছিলেন। আমি তাঁর হয়ে মামলা পরিচালনা করেছি। তবে সাত বছর আগের ঘটনা, বিস্তারিত মনে নেই। পরে বিস্তারিত বলতে পারব।’

হাইকোর্টের রায়ে বলা হয়েছিল, প্রার্থীদের আট ধরনের তথ্য সর্বসাধারণের জানার জন্য প্রকাশ ও প্রচারের ব্যবস্থা করতে হবে। এ ক্ষেত্রে হাইকোর্ট ভারতীয় সুপ্রিম কোর্টের একটি রায়ের উদাহরণ দেন। ভারতের সুপ্রিম কোর্টের রায়ে বলা হয়, ভোটাররা প্রার্থীদের অতীত ইতিহাস না জানলে নির্বাচন প্রহসনে পরিণত হবে, ভোটারদের ভোট দেওয়া অর্থহীন হবে।

বাংলাদেশে আদালতের রায়ের পর গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ (আরপিও) সংশোধন করা হয়। এতে কোনো প্রার্থী হলফনামায় মিথ্যা তথ্য দিলে তাঁর প্রার্থিতা বাতিল হবে বলে বলা হয়।

হলফনামায় অসত্য তথ্য দেওয়ার কারণে আদালতের নির্দেশে বর্তমান সংসদের আওয়ামী লীগদলীয় সাংসদ জসিম উদ্দিন (ভোলা-৩) ও জাতীয় পার্টির সাংসদ আবুল কাশেমের (টাঙ্গাইল-৫) সদস্যপদ বাতিল হয়ে যায়।

হলফনামার আওয়ামী-অধ্যায়: ২০০৮ সালের নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসে। তখন তাঁরাসহ সব দলের প্রার্থীরা নির্বাচন কমিশনে সম্পদের তথ্যসহ হলফনামা দেন। তা নিয়ে গণমাধ্যমে তখন বহু প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি অনুষ্ঠেয় নির্বাচনের জন্য হলফনামা জমা দিলে গণমাধ্যমে প্রার্থীদের গত পাঁচ বছরে সম্পদের হ্রাস-বৃদ্ধি তুলে ধরে প্রতিবেদন প্রকাশিত হতে থাকে। এই অবস্থায় আওয়ামী লীগ বিষয়টি নিয়ে জোরালো আপত্তি তুলছে।

মহীউদ্দীন খান আলমগীর গতকাল বিবিসিকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে হলফনামার তথ্যকে গোপনীয় দলিল বলে দাবি করেছেন। তিনি বলেন, ‘দেশের নাগরিকেরা যে আয়কর বিবরণী দিয়ে থাকেন, সেটা একমাত্র আদালত ছাড়া সবার জন্য গোপনীয়।’

সম্পদের তথ্যসহ আট ধরনের তথ্য প্রকাশে আইনি বাধ্যবাধকতা সম্পর্কে মহীউদ্দীন খান আলমগীর দাবি করেন, ‘এটা আদালতের নির্দেশ নয়, নির্বাচন কমিশনের ব্যাপার।’

নির্বাচন কমিশন আদালতের নির্দেশ অনুযায়ীই হলফনামা প্রকাশ করছে—এ প্রশ্নের জবাবে মহীউদ্দীন খান বলেন, ‘হলফনামার অংশবিশেষ সংশ্লিষ্ট আয়কর কর্তৃপক্ষ দেখবেন বা নির্বাচন কমিশন দেখবেন। এর বাইরে কোনো পক্ষ এসে নির্বাচনের আগে যদি কোনো মন্তব্য দেন, তাহলে আমি বলব, তাঁরা অযথা হস্তক্ষেপ করছেন। নির্বাচনের আগে অযথা অশুভ প্রভাব সৃষ্টির চেষ্টা করছেন। তবে আদালত যদি চান, তাঁরা নিশ্চয়ই দেখবেন।’ তিনি বলেন, ‘আমরা নির্বাচন কমিশনকে বলেছি, আয়কর-সম্পর্কিত বিবরণ কমিশন পর্যবেক্ষণ করবেন, বিশ্লেষণ করবেন এবং সংশ্লিষ্ট আদালত দেখবেন। এটা ওয়েবসাইটে তুলে দেওয়ার প্রয়োজন ছিল না।’

তবে সাবেক নির্বাচন কমিশনার এম সাখাওয়াত হোসেন বলেন, প্রার্থীদের তথ্য নির্বাচন কমিশনকে প্রচার করতে হবে বলে উচ্চ আদালতের নির্দেশনা আছে। গত নির্বাচনে কমিশন প্রার্থীদের হলফনামা লিফলেট করে নির্বাচনী এলাকায় বিতরণও করেছিল।