শনিবার , ২০শে এপ্রিল, ২০২৪ , ৭ই বৈশাখ, ১৪৩১ , ১০ই শাওয়াল, ১৪৪৫

হোম > Uncategorized > সরকারের সঙ্গে ব্যবসায়ীদের সম্পর্ক খারাপ

সরকারের সঙ্গে ব্যবসায়ীদের সম্পর্ক খারাপ

শেয়ার করুন

বাংলাভূমি২৪ ডেস্ক ॥
ঢাকা: অবকাঠামোর অপর্যাপ্ততা, দুর্নীতি ও অদক্ষ আমলাতন্ত্রকে ব্যবসার ক্ষেত্রে প্রধান তিনটি সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করেছেন এ দেশের ব্যবসায়ীরা। আবার সরকারের সঙ্গে ব্যবসায়ীদের সম্পর্ক ‘খারাপ’ এবং রাজনীতিবিদদের নৈতিক মান ভালো নয় বলেও মত দিয়েছেন তাঁরা।
দেশের সেবা ও উৎপাদন খাতের ৭৭ জন শীর্ষস্থানীয় ব্যবসায়ী বা উদ্যোক্তা একটি জরিপে এই অভিমত দিয়েছেন। ন্যূনতম ১০ কোটি টাকার সম্পদ ও বিশ্ববাণিজ্যের সঙ্গে যোগাযোগ রয়েছে এমন ব্যবসায়ীরা এই জরিপে অংশ নিয়েছেন। আর জরিপটি সুইজারল্যান্ডভিত্তিক বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরামের (ডব্লিউইএফ) পক্ষে বাংলাদেশে পরিচালনা করেছে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)।
বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরামের বৈশ্বিক প্রতিযোগিতার সক্ষমতা সূচক গত বুধবার আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশ পেয়েছে। বৈশ্বিক এই প্রতিবেদনটির অংশ হিসেবে বাংলাদেশের ব্যবসা পরিচালনার পরিবেশ বিষয়ে একটি জরিপও পরিচালনা করা হয়। সিপিডি জানিয়েছে, ১৯৮৯ সাল থেকে ডব্লিউইএফ নিয়মিতভাবে এই সূচকটি প্রকাশ করে আসছে। ২০০১ সালে বাংলাদেশকে এই প্রতিযোগিতা সূচকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়।
বুধবার প্রতিবেদনটি প্রকাশের পর গতকাল বৃহস্পতিবার এর নানা দিক তুলে ধরে সিপিডি। এ জন্য বিকেলে রাজধানীর মহাখালীর ব্র্যাক সেন্টারে এক সংলাপ অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। সিপিডির ট্রাস্টি বোর্ডের সদস্য সৈয়দ মঞ্জুর এলাহীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন শিল্পমন্ত্রী আমির হোসেন আমু, বিশেষ অতিথি সাবেক বাণিজ্যমন্ত্রী ও বিএনপির নেতা আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী এবং প্যানেল আলোচক ছিলেন অ্যাপেক্স ফুটওয়্যারের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ নাসিম মঞ্জুর। প্রতিবেদনটির বিভিন্ন দিক তুলে ধরেন সিপিডির অতিরিক্ত গবেষণা পরিচালক খোন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম এবং স্বাগত বক্তব্য দেন নির্বাহী পরিচালক মোস্তাফিজুর রহমান।
প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, বৈশ্বিক প্রতিযোগিতা সক্ষমতা সূচকে এক ধাপ এগিয়েছে বাংলাদেশ। বিশ্বের ১৪৪টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১০৯। ২০১৩ সালে এই সূচকে বিশ্বের ১৪৮টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ১১০তম। তবে বাংলাদেশের এই উন্নতিকে খুবই প্রান্তিক বলে উল্লেখ করা হয়েছে প্রতিবেদনে। সিপিডির মতে, উন্নতির আরও বেশি সামর্থ্য থাকার পরও বাংলাদেশ একটি বৃত্তেই ঘুরপাক খাচ্ছে। দেশের বিদ্যমান ব্যবসায়িক পরিবেশকাঠামো দিয়ে এই অবস্থা থেকে উত্তরণ সম্ভব নয় বলেও সংস্থাটি জানিয়েছে।
অনুষ্ঠানে জানানো হয়, জরিপে অংশ নেওয়া ব্যবসায়ীদের ২০ দশমিক ৩১ শতাংশ অপর্যাপ্ত অবকাঠামোকে ব্যবসা পরিচালনার প্রধান সমস্যা মনে করেন। ২০১৩ সালে প্রায় সাড়ে ১৮ শতাংশ ব্যবসায়ীর মতামতের ভিত্তিতে এটি ছিল দ্বিতীয় প্রধান সমস্যা। সাধারণ অবকাঠামোর পাশাপাশি সড়ক, রেল ও বিমানপথের যোগাযোগ সুবিধাকে ‘নিকৃষ্টতম’ বলে মনে করেন ব্যবসায়ীরা। এ ছাড়া ১৯ দশমিক ৭০ শতাংশ ব্যবসায়ীর মতে, ২০১৪ সালে ব্যবসার ক্ষেত্রে দ্বিতীয় প্রধান সমস্যা দুর্নীতি। আর সাড়ে ১৪ শতাংশ ব্যবসায়ীর মতামতের ভিত্তিতে তৃতীয় সমস্যা হচ্ছে অদক্ষ আমলাতন্ত্র। ৯ দশমিক ৩৮ শতাংশ ব্যবসায়ী সরকারের অস্থিতিশীলতাকে চতুর্থ সমস্যা বলে মনে করেছেন।
জরিপে অংশ নিয়ে ৩৯ শতাংশ ব্যবসায়ীই বলেছেন, সরকারের সঙ্গে ব্যবসায়ীদের সম্পর্ক ‘খারাপ’। যদিও ২০১৩ সালের জরিপে অংশগ্রহণকারী ব্যবসায়ীদের ৪২ শতাংশ পারস্পরিক এই সম্পর্কটিকে ভালো বলেছিলেন। এক বছরের ব্যবধানে সেই ভালো সম্পর্কটি এখন ‘খারাপ’ হয়ে গেছে। গতকাল সিপিডির আলোচনায় অংশগ্রহণকারী ব্যবসায়ীরাও সম্পর্কের এই অবনতির বিষয়টি তুলে ধরেছেন। সেই সঙ্গে পারস্পরিক সম্পর্ক উন্নয়নে বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে গঠিত ‘বেটার বিজনেস ফোরাম’ পুনরুজ্জীবিত বা সেটির আদলে অন্য কোনো ফোরাম গঠনের তাগিদ দিয়েছেন তাঁরা। এই ফোরামে সরকারের সঙ্গে ব্যবসায়ীদের নিয়মিত বৈঠক অনুষ্ঠিত হতো। সিপিডির মতে, ব্যবসায়ীদের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়ন এখন সরকারের অন্যতম অগ্রাধিকার হওয়া উচিত।
সরকার ও সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর মূল্যায়ন করতে গিয়ে ৬৭ শতাংশ ব্যবসায়ী আইন প্রণয়নকারী প্রতিষ্ঠান হিসেবে জাতীয় সংসদকে অকার্যকর বলে মত দিয়েছেন। আর ৯৪ শতাংশ ব্যবসায়ী বলেছেন, রাজনীতিবিদদের নৈতিক মান ভালো নয়। গত বছরের জরিপে ৬৩ শতাংশ ব্যবসায়ী সংসদকে অকার্যকর ও ৮৭ শতাংশ রাজনীতিবিদদের নৈতিকতার মান নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন। অর্থাৎ পরিস্থিতির আরও অবনতি হয়েছে।
এদিকে, ডব্লিউইএফের প্রতিবেদনে বাংলাদেশের এক ধাপ অগ্রগতির পেছনে সাতটি ইতিবাচক পরিবর্তন বড় ভূমিকা রেখেছে বলে উল্লেখ করা হয়। সেগুলো হচ্ছে অবকাঠামো, সামষ্টিক অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা, উচ্চশিক্ষা, পণ্যবাজারে দক্ষতা, পরিশীলিত আর্থিক বাজার, বাজারের আকার ও নতুনত্ব। এসব ক্ষেত্রে কিছুটা ইতিবাচক পরিবর্তন হলেও অন্য পাঁচটি ক্ষেত্রে অবনতি ঘটেছে। সেগুলো হচ্ছে প্রতিষ্ঠান, স্বাস্থ্য ও প্রাথমিক শিক্ষা, শ্রমবাজারের দক্ষতা, প্রযুক্তিগত প্রস্তুতি এবং পরিশীলিত বাণিজ্য।
সিপিডির সংলাপে আরও বক্তব্য দেন সিপিডির ট্রাস্টি, সাবেক অর্থমন্ত্রী এম সাইদুজ্জামান, ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন বাংলাদেশ শিল্প ও বণিক সমিতি ফেডারেশনের (এফবিসিসিআই) সাবেক সভাপতি এ কে আজাদ, তৈরি পোশাক মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএর সহসভাপতি শহিদুল্লাহ আজিম, পরিকল্পনা কমিশনের সাধারণ অর্থনীতি বিভাগের সদস্য শামসুল আলম, বাংলাদেশ এমপ্লয়ার্স ফেডারেশনের (বিইএফ) সভাপতি কামরান টি রহমান, আবদুল মোনেম গ্রুপের উপব্যবস্থাপনা পরিচালক এ এস এম মঈনউদ্দিন মোনেম, রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চল কর্তৃপক্ষের (বেপজা) সাবেক চেয়ারম্যান মফিজুর রহমান প্রমুখ।
আলোচনা পর্বে শিল্পমন্ত্রী আমির হোসেন আমু গণমাধ্যমকর্মীদের বুঝেশুনে সরকারের সমালোচনা করার আহ্বান জানিয়ে বলেন, ‘গত বছর রাজনৈতিক অস্থিরতার মধ্যেও বাংলাদেশ এক ধাপ এগিয়েছে, যা ইতিবাচক।’
রাজনীতিবিদদের নৈতিকতার বিষয়ে ভিন্নমত জানিয়ে আমির হোসেন আমু বলেন, রাজনীতি না থাকলে দেশে আর কিছুই থাকবে না। রাজনীতিবিদদের সমালোচনা করা যেতে পারে, তবে সেটির একটি পরিধি থাকতে হবে। রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান যদি ভেঙে পড়ে বা রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব যদি আস্থাহীন হয়ে পড়ে, তাহলে দেশের যে অবস্থা তৈরি হবে, তা কারও জন্য মঙ্গলজনক হবে না। প্রধান অতিথির বক্তব্য শেষে অনুষ্ঠানস্থল ত্যাগ করেন মন্ত্রী।
মন্ত্রীর বক্তব্যের সঙ্গে ভিন্নমত পোষণ করে সাবেক বাণিজ্যমন্ত্রী আমীর খসরু মাহমুদ বলেন, ‘আমরা এত দিন জেনে এসেছি, সমালোচনা ছাড়া রাজনীতি টিকতে পারে না। আর আজ মন্ত্রী বললেন বুঝেশুনে সমালোচনা করতে। এর মাধ্যমেই সারা দেশের অবস্থা কী, তা আঁচ করতে কারও অসুবিধা হওয়ার কথা নয়।’ তিনি বলেন, সব ক্ষেত্রে সুশাসনের কোনো বিকল্প নেই। আর জবাবদিহি ছাড়া সুশাসন হয় না। কিন্তু যে সরকার ও সংসদ অনির্বাচিত, তাদের কাছ থেকে কখনো জবাবদিহি আশা করা যায় না।
পদ্মা সেতুর দুর্নীতি মামলায় অভিযুক্ত ব্যক্তিদের দুদকের দায়মুক্তির সমালোচনা করে বিএনপির এই নেতা বলেন, পদ্মায় যেটি হয়েছে, সেটি ছিল সরকার অনুমোদিত দুর্নীতি। তাই এই ঘটনায় কানাডায় মামলা চললেও দুদক সবাইকে দায়মুক্ত করে দিয়েছে।
সৈয়দ মঞ্জুর এলাহী বলেন, ‘রাজনীতিবিদ, বেসরকারি উদ্যোক্তা, সুশীল সমাজ ও সরকারের মধ্যে মতৈক্য ছাড়া কোনো দেশের উন্নয়ন সম্ভব নয়। কিন্তু আমাদের দেশে এখন সেটির বড় অভাব দেখা দিয়েছে।’ তিনি আরও বলেন, সরকার পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে ভালো কাজগুলোও বন্ধ হয়ে যায়। নীতির কোনো ধারাবাহিকতা থাকে না।
নাসিম মঞ্জুর তাঁর বক্তব্যে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক চার লেনে উন্নীত না হওয়ায় হতাশা প্রকাশ করে বলেন, ‘আমি যা-ই উৎপাদন করি না কেন, তা সঠিক সময়ে ক্রেতার কাছে পৌঁছে দিতে না পারলে কোনো লাভ নেই।’ নতুন বিনিয়োগের ক্ষেত্রে জমির উচ্চমূল্য, গ্যাস-সংকট, ব্যাংক সুদের উচ্চ হারকে বড় সমস্যা হিসেবে অভিহিত করেন তিনি।
এফবিসিসিআইয়ের সাবেক সভাপতি এ কে আজাদ বলেন, রাজনীতিবিদদের সবার আগে বদলাতে হবে। তাঁরা বদলালে দেশও বদলে যাবে।
খোন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, দেশে বর্তমানে বিনিয়োগ সহায়ক রাজনৈতিক পরিবেশের অভাব রয়েছে। এই অবস্থার উন্নতি ঘটাতে হলে সরকার ও ব্যবসায়ীদের মধ্যে সংলাপ দরকার।