শুক্রবার , ২৯শে মার্চ, ২০২৪ , ১৫ই চৈত্র, ১৪৩০ , ১৮ই রমজান, ১৪৪৫

হোম > জাতীয় > সীমান্তে হত্যা ও নির্যাতন কোনভাবেই বন্ধ হচ্ছে না

সীমান্তে হত্যা ও নির্যাতন কোনভাবেই বন্ধ হচ্ছে না

শেয়ার করুন

স্টাফ রিপোর্টার ॥ ‘আমরা সবসময় আতংকে থাকি, কখন কি হয় বলা যায় না, সীমান্তঘেঁষা জমি ও অভিন্ন নদীতে নির্বিঘে যাতায়াত করতে পারি না, ভারতীয় বর্ডার সিকিউরিটি ফোর্স (বিএসএফ) যখন তখন হুটহাট করে ক্ষেপে যায়, আমাদের সাহসী পদক্ষেপের অভাবে বিএসএফ দিনে দিনে বেপরোয়া হয়ে উঠছে’- কথাগুলো বললেন যশোর সীমান্তের শিববাস গ্রামের বাসিন্দা মোহাম্মদ আলম। তার কথা বিএসএফ সীমান্তবাসীদের সাথে প্রায়ই পশুর মতো আচরণ করে। অথচ জোরালো বাদ প্রতিবাদ নেই।

সীমান্ত সূত্র জানায়, সুন্দরবনের কৈখালী থেকে কুষ্টিয়ার চিলমারী পর্যন্ত দক্ষিণ-পশ্চিমের ৬শ’ কিলোমিটার সীমান্তের বিভিন্ন পয়েন্টে প্রায়ই হত্যা, নির্যাতন ও অত্যাচার এবং অপহরণের ঘটনা ঘটছে। যার একটিরও কোন বিচার হচ্ছে না। অতীতের চেয়ে বর্তমানে বিএসএফ’র দাপট বহুলাংশে বেড়ে গেছে। কোনভাবেই বন্ধ করা যাচ্ছে না বিএসএফ’র বাংলাদেশী হত্যা ও নির্যাতন। সীমান্তের বিভিন্ন শ্রেণী ও পেশার মানুষের বক্তব্য, আমরা জানতে পেরেছি গতকাল ১৮ সেপ্টেম্বর ঢাকায় বিজিবি-বিএসএফ সম্মেলন শেষ হয়েছে।

সম্মেলন চলাকালে মঙ্গলবার বেনীপুর সীমান্ত থেকে এক নিরীহ যুবককে ধরে নিয়ে যায় বিএসএফ। বৈঠকের পর বৈঠক হলেও বিএসএফ কখনোই প্রতিশ্রুতি রক্ষা করে না। চলতি বছরের ২৪ মার্চ ভারতে অনুষ্ঠিত ৩৭তম সীমান্ত সম্মেলনে বিএসএফ মহাপরিচালক সীমান্ত এলাকায় নিরপরাধ বাংলাদেশী হত্যা বন্ধে আশ্বাস দিয়েছিলেন। কিন্তু পূর্বের সব বৈঠকের মতোই প্রতিশ্রুতির অপমৃত্যু ঘটেছে, বিএসএফ একের পর এক হত্যা, অত্যাচার ও নির্যাতন চালিয়েছে। হত্যা ও নির্যাতন কমানো তো দূরে থাক নতুন নতুন কৌশলে বিএসএফ গুলী চালিয়ে হত্যা, গাছে ঝুলিয়ে পিটিয়ে আহত করা, এপার সীমান্তে ঢুকে ধরে নিয়ে হাত পা ভেঙে দেয়া ও বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে জখম করার ঘটনা অতিমাত্রায় বাড়িয়ে দেয়। সূত্রমতে, প্রতিটি ঘটনার পর প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়। কিন্তু ভঙ্গ হয় বারবারই।

ভারতীয় বর্ডার সিকিউরিটি ফোর্সের (বিএসএফ) হাতে গত সাড়ে ৪ বছরে শতাধিক বাংলাদেশী হত্যা হয়েছে। এর মধ্যে শুধুমাত্র যশোর সীমান্তে হত্যা হয়েছে প্রায় ৩৫জন। ওই সময়ে বিভিন্নপন্থায় নির্যাতনের শিকার হয়েছে ৩ শতাধিক বাংলাদেশী। সর্বশেষ গতপরশু (মঙ্গলবার) চুয়াডাঙ্গার জীবননগরের বেনীপুর সীমান্তের ওপারের নোনাগঞ্জ বিওপির বিএসএফ সদস্যরা সীমান্তের হাবিবপুর গ্রামের আজান বারী নামে এক নিরীহ যুবককে ধরে নিয়ে যায়। তার ভাগ্যে কি ঘটেছে তা জানা যায়নি। তার পরিবার রয়েছে উ্ৎকন্ঠায়। নিকট অতীতে বিএসএফ হত্যা করে গত ৯ সেপ্টেম্বর কুষ্টিয়ার দৌলতপুর সীমান্তে বজলুর রশীদ নামে এক কৃষককে। তার বাড়ী সীমান্তের মহাম্মদপুর গ্রামে। ঘটনাটি ঘটে মহাম্মদপুর সীমান্তের ১৫৭-১ এস পিলারের কাছে। ভারতের পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদ জেলার জলঙ্গী থানার বাউশমারি ক্যাম্পের বিএসএফ ওই কৃষককে ধাওয়া করে হত্যা করে। বিজিবি ঘটনার প্রতিবাদ জানায়। ঝিনাইদহের মহেশপুর সীমান্তের ফয়সল আহমেদকে ২৮ আগস্ট, কুষ্টিয়ার দৌলতপুর চলিশপাড়া সীমান্তে থেকে বাংলাদেশ ভূখ-ে ঢুকে আলমগীর হোসেনকে ২৫ আগস্ট, একই এলাকার মুন্সীগঞ্জ সীমান্ত থেকে দিপুর আহমেদকে ২ আগস্ট ধরে নিয়ে নির্মমভাবে নির্যাতন চালিয়েছে বিএসএফ। পরে বিজিবির প্রতিবাদের মুখে তাদের ফেরত দেয়া হয়। সীমান্তের বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়, সব ক্ষেত্রেই বিএসএফ একতরফাভাবে গুলী কিংবা নির্যাতনের মাধ্যমে সীমান্তে হত্যা করে। সীমান্তের নো ম্যানস ল্যান্ডে দাঁড়িয়ে কিংবা সীমান্তের গা ঘেঁষা জমিতে চাষাবাদ ও অভিন্ন নদীতে গোসল করার সময়ও বাংলাদেশীদের দিকে বিএসএফ রাইফেল তাক করে তেড়ে আসার ঘটনা অসংখ্য। খুব কম দিনই আছে, যেদিন বিএসএফ সীমান্তে বাংলাদেশী নির্যাতন করে না বা তেড়ে আসে না।

মানবাধিকার সংগঠন রাইটস যশোর-এর নির্বাহী পরিচালক ও দৈনিক টেলিগ্রামের সম্পাদক বিনয় কৃষ্ণ মল্লিক জানান, বারবার প্রতিশ্রুতি দিলেও বিএসএফ-এর হাতে বাংলাদেশী হত্যা ও নির্যাতন বন্ধ হচ্ছে না। ঢাকায় অনুষ্ঠিত সীমান্ত সম্মেলনে কো-অর্ডিনেশন টহলের সিদ্ধান্ত হয়েছে বলে জানা গেছে। যা ভালো সিদ্ধান্ত কিন্তু অতীতে যেসব বৈঠকে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত ও আশ্বাস দেয়া হয়, তারপরেই কিংবা পরক্ষণেই সব ভঙ্গ হয়ে গুলী চালানোর ঘটনা ঘটেছে। সীমান্তে বিএসএফ-এর নির্যাতন মোটেও কমছে না। বরং দিনে দিনে অতিমাত্রায় বেড়েই চলেছে। তিনি বলেন, বিনা উস্কানীতে সীমান্তে বিএসএফ গুলী ও নির্যাতন চালায়। যা মানবাধিকারের চরম লংঘন। সীমান্ত সূত্র জানায়, সীমান্তে হত্যাকা- ঘটলেই পরক্ষণে ফ্লাগ মিটিং হয় বিজিবি ও বিএসএফ-এর মধ্যে। বিএসএফ প্রতিবারই কথা দেয় ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটবে না। কিন্তু তারপরেও ঘটেই চলেছে। সীমান্তবাসীরা বিএসএফ’র মিথ্যা আশ্বাস শুনতে শুনতে রীতিমতো পেরেশান হয়ে গেছেন। কুষ্টিয়ার দৌলতপুর সীমান্তের বাসিন্দা জহুরুল ইসলাম জানালেন, বিএসএফ বিভিন্ন সীমান্তে ছোটখাটো ঘটনায় গুলী করে করতে দ্বিধা করে না। এসব বন্ধের কি কোন স্থায়ী ব্যবস্থা নেই? বিএসএফ’র নিষ্ঠুরতা বহুরূপ আমরা সীমান্তে দেখছি। মানবিক আচরণ ওদের কাছ থেকে পাওয়া যায় না কখনোই। বরাবরই হিংস্র আচরণ করে থাকে।

সীমান্তবাসীদের প্রশ্ন দফায় দফায় বৈঠক করে যে আশ্বাস দেন বিএসএফ কর্মকর্তারা, বাস্তবে তার ফল দেখা যায় না কেন? ফ্ল্যাগ মিটিং-এর দিনটা সৌহার্দ্যপূর্ণ পরিবেশে কাটলেও পরদিনই তা পাল্টে যায়, এর বা কারণ কি? তথ্যানুসন্ধানে জানা যায়, দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের অন্তত ১৪টি গরু করিডোর দিয়ে ভারত থেকে গরু ঢোকে বাংলাদেশে এটি স্বীকৃত। সীমান্তের নোম্যানস ল্যান্ডে এপার ও ওপারের গরু ব্যবসায়ীদের যাতায়াত হওয়াটাই স্বাভাবিক। সূত্র জানায়, গরু করিডোরের এপার ও ওপারের ব্যবসার সাথে যারা জড়িত, তারা বেশী হত্যাকা- ও নির্যাতনের শিকার হয়। তাছাড়া বাংলাদেশ ভূখ-ে ঢুকে মাঠে কর্মরত কৃষককে রাইফেল দিয়ে পিটিয়ে হত্যা করার ঘটনাও আছে। অথচ এমন কোন দিন নেই চোরাচালান, বিশেষ করে ফেনসিডিল পাচার হয় না। বিজিবি’র হাজার হাজার বোতল ফেনসিডিল উদ্ধার রেকর্ড তার প্রমাণ। বিএসএফ কখনো মাদক চোরাচালানীকে গুলী করে হত্যা বা নির্যাতন করেছে এমন রেকর্ড নেই। বিজিবির রিজিয়ন বৈঠকেও বারবার এই বিষয়টি ওঠে এসেছে। সীমান্তের লোকজনের বক্তব্য, বিএসএফ সীমান্তের কাঁটাতারের বেড়ার পকেট ফেনসিডিল পাচারের সময় খুলে দেয় কিংবা মই লাগিয়ে এপারে পাচারের সুযোগ করে দেয় চোরাচালানীদের।

তথ্যানুসন্ধানে জানা যায়, সীমান্তবাসীদের আর্থিক উন্নতি হচ্ছে না কারণ সীমান্তের গা ঘেঁষা গ্রামগুলোতে বসবাসকারীরা অধিকাংশ সময় কাটাচ্ছেন আতংকে। সীমান্তের লোকজন জানালেন, ‘আমরা সীমান্তের জমি ও অভিন্ন নদ-নদীতে অনেক সময় যেতে পারি না। আমরা নির্বিঘেœ চলাফেরার গ্যারান্টি চাই’। তাদের কথা, ‘গরু ব্যবসায়ীদের হত্যা ও নির্যাতনের ঘটনা অহরহ ঘটছে কিন্তু যুব সমাজ ধ্বংসকারী সর্বনাশা ফেনসিডিল পাচারকারীদের বিরুদ্ধে ন্যূনতম ব্যবস্থা নেয়ার ক্ষেত্রে বিএসএফ’র অনীহার কারণ কি সেটিও বড় প্রশ্ন হয়ে দেখা দিয়েছে।

গতকাল বেনাপোলেও বিজিবি ও বিএসএফ সেক্টরপর্যায়ে বৈঠক হয়। বৈঠকে উপস্থিত ২৬ বিজিবি’র কমান্ডিং অফিসার লেঃ মতিউর রহমান জানান, বৈঠকে সীমান্ত জুড়ে কো-অর্ডিনেশন টহল দেয়া হবে। যদিও ইতোমধ্যে তার ব্যাটালিয়ন পিলার টু পিলার ২১টি কো-অর্ডিনেশন টহল দিয়ে সমতা নিশ্চিত করা হয়েছে। আগামী ২অক্টোবর সেক্টরপর্যায়ে আবারো বৈঠক হবে। সীমান্তে হত্যা ও নির্যাতন এবং মাদক পাচার বন্ধে বিজিবি বরাবরই বিএসএফকে চাপ সৃষ্টি করে আসছে।