শুক্রবার , ২৯শে মার্চ, ২০২৪ , ১৫ই চৈত্র, ১৪৩০ , ১৮ই রমজান, ১৪৪৫

হোম > গ্যালারীর খবর > সুন্দরবনে সাড়ে তিন বছরে ৬১ দস্যু নিহত

সুন্দরবনে সাড়ে তিন বছরে ৬১ দস্যু নিহত

শেয়ার করুন

জেলা প্রতিনিধি, বাগেরহাট ॥ বিশ্ব ঐতিহ্য সুন্দরবনে বিভিন্ন সময়ে বনদস্যু নিহত হলেও দমছে না তাদের তৎপরতা। এখনও অপতিরোধ্য বনদস্যুরা। নতুন নতুন বাহিনী গঠন করে তারা সুন্দরবনে চালায় দস্যুতা।

বিগত সাড়ে তিন বছরে সুন্দরবনে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধ ও গণপিটুনিতে ১২ বাহিনী প্রধানসহ ৬১ বনদস্যু নিহত হয়েছে। তারপরও বন্ধ হয়নি তাদের কর্মকান্ড।

একজনের মৃত্যু হলে নতুন করে আরেকজনের আবির্ভাব হচ্ছে। পুণরায় শুরু হচ্ছে তাদের আধিপত্য বিস্তারের লড়াই। এ অবস্থায় জেলেসহ বনজীবীরা বাধ্য হয়ে পেশা পরিবর্তন করে বিকল্প কাজের সন্ধান করছেন।

র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটেলিয়নের (র‌্যাব-৮) অধিনায়ক লে. কর্নেল ফরিদুল আলম জানান, ২০১০ সালের জানুয়ারি থেকে শুরু করে ২০১৩ সালের ১০ আগস্ট পর্যন্ত র‌্যাব-৮ এর সদস্যরা সুন্দরবনে বেশ কয়েকটি অভিযান পরিচালনা করেছে। এছাড়া কোস্টগার্ডের অভিযান ও স্থানীয় জেলেদের গণপিটুনিতে কয়েকজন বনদস্যু মারা গিয়েছে।

২০১০ সালে ৯ জন, ২০১১ সালে ১৯ জন, ২০১২ সালে ১৯ জন, ২০১৩ সালের ১০ আগস্ট পর্যন্ত ১৪ জন বনদস্যু নিহত হয়। এ সময় ২৫ বনদস্যুকে আটক করা হয়। বনে তল্লাশি চালিয়ে ২৬৩টি দেশি-বিদেশি আগ্নেয়াস্ত্র, দুই হাজার ৪৪৬ রাউন্ড গুলি,  ৪৯টি ধারালো অস্ত্রসহ দস্যুদের ব্যবহৃত বিভিন্ন মালামাল উদ্ধার করা হয়।

এছাড়া দস্যুদের কবল থেকে উদ্ধার করা হয়েছে অপহৃত ৯০ জনকে জেলেকে।

চলতি ইলিশ মৌসুমের শুরুতেই বঙ্গোপসাগর ও সুন্দরবনের উপকূলে দুই লাধিক জেলে দস্যু আতংকে ভুগছেন। দস্যুদের চাঁদা না দিয়ে মাছ ধরার উপায় নেই। মুক্তিপণ ছাড়া অপহৃত জেলেদের মুক্তি পাওয়া দায়।

এ অবস্থায় সুন্দরবনে দস্যু দমন ও জেলেদের মৎস্য আহরণ নিরাপদ করতে আইনশৃঙ্খলা রাকারী বাহিনীর সদস্যরা নানা কৌশল অবলম্বন করছেন। একের পর এক অভিযান পরিচালনা করে আসছেন।

বিভিন্ন সূত্র থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, সুন্দরবনের বাংলাদেশ অংশে ৬ হাজার ১৭ বর্গকিলোমিটার আয়তনের ৪ হাজার ১৪৩ বর্গকিলোমিটার স্থলভাগ ও ১ হাজার ৮৭৩ বর্গ কিলোমিটার জলভাগের অধিকাংশ এলাকা জুড়ে বনদস্যুরা তাদের রাজত্ব কায়েম করেছে।

সরকার সুন্দরবনের দস্যু দমন ও জেলেদের মৎস্য আহরণ নির্বিঘ্নে করতে জাতীয় টার্স্কফোর্স কমিটি গঠন করেছে। এই কমিটি গঠনের মধ্যে দিয়ে দস্যু দমনে অভিযান আরো গতি পেয়েছে। বনের গহীনে র‌্যাব, পুলিশ, কোস্টগার্ড ও বনবিভাগের সদস্যরা কখনও যৌথ আবার কখনো নিজেরা অভিযান পরিচালনা করছেন। এমনকি গত বছর সুন্দরবনে দস্যুদের হাতে অপহৃত জেলেদের উদ্ধারে হেলিকপ্টারও ব্যবহার করা হয়।

সর্বশেষ ৮ আগস্ট সুন্দরবনে মুক্তিপণের টাকা নিতে এসে কুখ্যাত বনদস্যু রুবেল বাহিনীর প্রধান রুবেলসহ দুই বনদস্যু নিহত হয় এবং ৩/৪ দিন পর বনদস্যু বাহিনীর সদস্যরা সুন্দরবনসহ বঙ্গোপসাগরে গণডাকাতি ও মুক্তিপণের দাবিতে অর্ধশতাধিক জেলেকে অপহরণ করে।

জেলেদের কাছ থেকে প্রাপ্ত তথ্য মতে, সুন্দরবনের পূর্ব ও পশ্চিম বিভাগ মিলে এখনও ডজন খানেক বনদস্যু বাহিনীর ছয়শতাধিক সদস্য সক্রিয়। এছাড়া বঙ্গোপসাগরে আরো কয়েকটি বাহিনীর প্রধানের নেতৃত্বে  কয়েকশত বনদস্যু সক্রিয় রয়েছে।

দেশি-বিদেশি অস্ত্র নিয়ে দস্যুরা জেলেদের কাছ থেকে মোটা অঙ্কের চাঁদা আদায় করছে। চাঁদার টাকা না দিলে ট্রলারে হামলা চালিয়ে জাল, মাছ লুট এবং জেলেদের অপহরণ করে মুক্তিপণের টাকা আদায় করে। মুক্তিপণের টাকা না পেলে জেলেদের হত্যা করে সাগরে ফেলে দেওয়ারও ঘটনা ঘটেছে ইতিপূর্বে।

দস্যুদের বেপরোয়া তাণ্ডবের কারণে জেলেরা দীর্ঘদিন ধরে অতিষ্ঠ । প্রতিবছর দস্যুরা সুন্দরবন সংলগ্ন বঙ্গোপসাগরে কয়েক হাজার জেলেকে অপহরণ করে মুক্তিপণ আদায় করে এবং লুটে নিচ্ছে জেলেদের মাছ ও জাল। অনেক সময় দস্যুদের আগাম টাকা দিয়ে টোকেন নিয়ে মাছ ধরতে হয় জেলেদের।

এসব দস্যুতার কারণে সরকারও প্রতি বছর কয়েক কোটি টাকার রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হচ্ছে বলে জানান জেলে সংগঠনের নেতারা।

এদিকে ২০১০ সালের জানুয়ারি থেকে ২০১৩ এর ১০ আগস্ট পর্যন্ত সুন্দরবন ও বনসংলগ্ন এলাকায় বন্দুকযুদ্ধে ৫৬ জন, বনদস্যু দুই গ্রুপের সংঘর্ষে ৩ জন এবং সর্বশেষ মুক্তিপণের টাকা নিতে এসে জেলেদের গণপিটুনিতে দু’জন বনদস্যু নিহত হয়।

সাড়ে তিন বছরে সুন্দরবনের যে ১২ জন বাহিনী প্রধান নিহত হয়েছে তারা হল- ডাক্তার মানিক, কৃষ্ণ সাগর, মোতালেব জুলফিকার, সোহাগ, জিহাদ, নবকুমার, গামা, মেঘনা জাকির, নাটা শহিদুল, সাইজ্যা বাহিনীর প্রধান মাহাবুব ওরফে সাইজ্যা, আমজাদ বাহিনীর প্রধান আমজাদ ও রুবেল বাহিনীর প্রধান রুবেল।

সুন্দরবনের ফিসার ম্যান গ্রুপের চেয়ারম্যান মেজর (অব.) জিয়া উদ্দিন জানান, সুন্দরবনে আইনশৃঙ্খলা রাকারী বাহিনীর সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে মোতালেব জুলফিকার, সোহাগ, জিহাদসহ আরো কয়েকজন বাহিনীর প্রধান নিহত হওয়ার পর কিছুদিন ওই বাহিনীর কর্মকান্ড বন্ধ ছিল।

কিন্তু পরবর্তীতে ওইসব বাহিনীর সদস্যরা দলের হাল ধরেছে নতুন করে নিজেদেরকে সংগঠিত করে পুণরায় তাদের তৎপরতা শুরু করেছে।

সাগর থেকে ফিরে আসা জেলেরা জানান, সুন্দরবন ও গোটা বঙ্গোপসাগর জুড়ে বনদস্যু বাহিনীর সদস্যরা তৎপরতা চালাছে। এখন সাগরে জেলেদের জন্য নিরাপদ নয়। বঙ্গোপসাগর ও সুন্দরবন এলাকায় জেলেদের ওপর হামলার ঘটনা ও জেলেদের মধ্যে দস্যু আতঙ্ক বিরাজ করছে।

দস্যুদের তান্ডবে অনেকে আর সাগরে মাছ ধরতে যেতে আগ্রহী নয়। স্ত্রী ও ছেলে মেয়ে নিয়ে বেঁচে থাকার জন্য  বিকল্প কাজ খুঁজে বেড়াচ্ছে।

র‌্যাপিড অ্যাকশান ব্যাটালিয়ান র‌্যাব-৮ এর অধিনায়ক লে. কর্নেল ফরিদুল আলম জানান, র‌্যাব সদস্যদের অভিযান সুন্দরবন অঞ্চলে জেলেদের  ট্রলারে ডাকাতি ও জেলে অপহরণ অনেকাংশেই কমে গেছে। এ অবস্থায় র‌্যাব সদস্যরা বিশেষ সতর্ক অবস্থায় রয়েছে। জেলেদের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখা হচ্ছে।

বিভিন্ন সূত্র থেকে তথ্য নিয়ে দস্যুদের নতুন অবস্থানের সন্ধানে তল্লাশি চালানো হচ্ছে। দস্যুতা দমনে সুন্দরবন হিরণপয়েন্ট ও দুবলারচরে র‌্যাবের দু’টি ক্যাম্পও স্থাপন করা হয়েছে বলে জানান তিনি।