শুক্রবার , ২৯শে মার্চ, ২০২৪ , ১৫ই চৈত্র, ১৪৩০ , ১৮ই রমজান, ১৪৪৫

হোম > Uncategorized > স্বাধীন দেশে সাধারণ মানুষ জিম্মি রাজাকার জাহাঙ্গীরের কাছে

স্বাধীন দেশে সাধারণ মানুষ জিম্মি রাজাকার জাহাঙ্গীরের কাছে

শেয়ার করুন

বিশেষ প্রতিবেদক ॥ নাম তার জাহাঙ্গীর মাহমুদ। পিতার নাম আব্দুল কুদ্দুস। বাড়ি গাজীপুর জেলার কাপাসিয়া গ্রামে। এলাকায় রাজাকার জাহাঙ্গীর না বললে কেউ চিনবেন না। তিনি একাত্তরে সর্বকনিষ্ঠ রাজাকার ছিলেন। স্বাধীনতা সংগ্রামে তিনি এলাকায় পাকিস্তানী মিলিটারী বাহিনীর সাথে সক্রিয় অংশগ্রহন করেন। যুদ্ধের সময়ে এলাকায় হত্যা, ধর্ষণ, লুণ্ঠনসহ এমন কোন কুকর্ম নেই তিনি করেন নি। দেশ স্বাধীনের পর তিনি এলাকা ত্যাগ করে আত্মগোপন করেন ঠাকুরগাঁ জেলায়। সেখানে এক আশ্রয়দাতার সুন্দরী কন্যাকে বিয়ে করেন। শ্বশুরের ঘর সংলগ্ন আঙিনায় মাটির নীচে এক প্রকার কূপ তৈরি করা হয়। তার উপরে ফুলের বাগান। সেই কূপ থেকে ঘরের ভিতরে সুরঙ্গ পথ তৈরি করে কূপটির নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হয়। তাকে কেউ খোঁজতে আসলে সুরঙ্গ পথ দিয়ে কূপের ভেতর গিয়ে আশ্রয় নিতেন। কাপাসিয়া এলাকার মুক্তিযোদ্ধারা খবর পেয়ে ওই এলাকায় গিয়ে খুঁজেও তাকে পায়নি। এভাবে কাটলো কয়েক বছর। দেশ ঠান্ডা হলো। আর তার নিজ গ্রামে আনা-গোনা শুরু করলেন। পরে তাকে আর কেউ কিছু বলেন নি। এভাবে পার পেয়ে যান তিনি।
ওই সময় ঠাকুরগাঁও -এ প্রথম বিয়ে করেন। ১ ছেলে ১ মেয়ে জন্ম গ্রহণের পর প্রথম স্ত্রী মারা যান। পরে কয়টি বিয়ে করেছেন তার সঠিক উত্তর তিনি ছাড়া কেউ দিতে পারবেন না। একেক সময় এক এক জায়গায় বিয়ে করে প্রত্যেকের সাথে প্রতারণা করেছেন। তার নিজ বাড়িতে সব স্ত্রীকে আনতেন না। তাদের মধ্যে কেউ কেউ ২/১ দিনের জন্য বেড়াতে আসতেন। বিয়ে করা যেমন তার নেশা ছিল; তার চেয়ে বেশি নেশা ছিল স্ত্রীর অর্থকড়ি কৌশলে লুটে নেয়া। অর্থকড়ি শেষ হয়ে গেলে আর খবর নিতেন না।
সর্বশেষ তার বাড়ির পাশে মেয়ের বয়সী ভাতিজি সম্পর্কের এক প্রবাসীর স্ত্রীকে বিয়ে করে সেখানে মাঝে মধ্যে রাত্রি যাপন করেন। আবার নিজ এলাকার মসজিদের সভাপতিও সে। ভয়ে কেউ তাঁর বিরুদ্ধে মুখ খুলে না। প্রতিবাদ করার সাহস দেখায় না। এ সুযোগে এলাকায় টাউটারী-বাটপারি, ধানাই-পানাই ছাড়াও চুরি-ডাকাতির সাথে সরাসরি যুক্ত হয় সে।
তার বিরুদ্ধে কাপাসিয়া থানায় ৫টি ডাকাতি, একটি অপহরণ, একটি চুরি মামলা ছাড়াও অন্যান্য মামলা রয়েছে। তবে এলাকায় এখন ‘ডাকাত সরদার রাজাকার জাহাঙ্গীর’ নামে কুখ্যাতি লাভ করেছেন।
সাধারণ মানুষে জমাজমি আত্মসাৎ ঃ
তার পিতা আব্দুল কুদ্দুস ছিলেন বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংকের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা। পৈত্রিক ভিটা-বাড়ি ছাড়া খুব বেশি সম্পদ ছিল না তাদের। চাকুরির শেষ সময়ে আব্দুল কুদ্দুস পৈত্রিক ভিটায় ফিরে আসেন। জাহাঙ্গীরের পিতা আব্দুল কুদ্দুসের চাচাতো ভাই তমিজ উদ্দিনের ডাক নাম ‘কাইল্যা’ ছিল। সে ছিল এক প্রকার পাগল ধরনের। তার স্ত্রী সন্তানও ছিল। আব্দুল কুদ্দুসের জীবদ্দশায় কাইল্যা রহস্যজনক ভাবে নিখোঁজ হন। এরপর কাইল্যার স্ত্রী ও তার সন্তানদের উপর শুরু হয় অত্যাচার। প্রায় সময় রাজাকার জাহাঙ্গীর, তার মা ও অন্যান্য ভাইয়েরা মিলে তাদের মারধোর করে রক্তাক্ত জখম করেছে। অত্যাচার সইতে না পেরে পৈত্রিক ভিটা ত্যাগ করে ভাতিজা সুরুজ মিয়া, তার মা ও বোনদের নিয়ে কাপাসিয়া-নারায়নপুর রোডের পূর্বপাশে ভিটা বাঁধে। সেখানে সুরুজ মিয়া বর্তমানে বসবাস করছেন। সুরুজ মিয়ার একমাত্র পুত্র সুমন জাহাঙ্গীরের শিষ্য। তাকেও ডাকাতি ও ছিনতাই করা শেখায় জাহাঙ্গীর। বছর খানেক আগে সুমন রহস্যজনক ভাবে খুন হয়। অনেকের ধারণাÑ সুমন খুনের নেপথ্যে কলকাঠি নেড়েছে জাহাঙ্গীর ডাকাত।
প্রায় ২৭/২৮ বছর আগের কথা। কাপাসিয়া বাজারে কোন এক হাটবার সেদিন। শনিবার কিংবা মঙ্গলবার। সময় আনুমানিক বিকাল ৪টা। জাহাঙ্গীর ও তার ভাই পাশা এক চাচাতো চাচা আঃ হাই (পঁচু) -কে বাজার থেকে ধরে রিকশায় তুলে নিজ বাড়িতে নিয়ে আটক করে। অনেক ডাক-চিৎকার কান্নাকাটি করেন পঁচু। পানি চাইলে তাঁকে পানিও দেয়া হয়নি। কেউ সাহস পাননি। এক নজর দেখার জন্য। পরদিন সাব-রেজিস্ট্রার অফিস থেকে কমিশন এনে বাড়ি-ভিটেসহ অন্যান্য সম্পত্তি লিখে নেয়। এক সময় ছাড়তে হলো তারও ভিটে মাটি সহায় সম্পত্তি। কিছু দিন আঃ হাই ওরফে পঁচু বাড়ির মসজিদে নামাজ পরে আল্লাহ পাক রাব্বুল আল-আমিনের দরবারে হাত তুলে ফরিয়াদ করতো আর কান্নাকাটি করতো। অভিশাপ দিতো। এলাকার মানুষের কাছে অভিযোগ করতো। কেউই ভয়ে কিছু বলতো না। বাড়ি-ভিটে ছেড়ে পঁচু শ্বশুর বাড়ি শ্রীপুর উপজেলার গোসিংগা ইউনিয়নের পেলাইদ গ্রামে ভিটে বাঁধে। মৃত্যুর পূর্বমুহূর্ত পর্যন্ত সেখানেই ছিলেন। পরে তাঁর দুই ছেলে আঃ মান্নান ও নাজিম উদ্দিন সুরুজ মিয়ার বাড়ির পাশে বাড়ি করে থাকেন।
পঁচুর জমি আত্মসাতের বছর দেড়েক পর কৃষি ব্যাংকের কালিয়াকৈর শাখার স্টাফ পাশা মোটর সাইকেলে সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যান। পাশার মৃত্যুর পর তার স্ত্রী শামিমা চৌধুরী ও তার একমাত্র সন্তানকে নিয়ে স্বামীর ভিটে ছাড়তে হলো অত্যাচারের কারণে। পরে আশ্রয় নেন পিত্রালয়ে। এমনও শুনা যাচ্ছিল- শামিমাকে প্রায় সময় কুপ্রস্তাব দিতো জাহাঙ্গীর। বাধ্য হয়েই স্বামীর ভিটে ত্যাগ করতে হলো তাকে। ওই সময় শামিমা চৌধুরী মামলা দায়ের করেন জাহাঙ্গীর ও তার মার নামে। মামলা করায় তাদের বাড়িতে পুলিশ যায়। ভয়ে জাহাঙ্গীরের মা দৌঁড়ে পাশেই পিত্রালয়ে যাওয়ার পথে রাতের অন্ধকারে হোঁচট খেয়ে পড়ে গিয়ে স্টোক করে মারা যান।
পরে হাসেন নামের এক তরুন যুবককে মালয়েশিয়ায় পাঠাবে বলে প্রলোভন দেখায় রাজাকার জাহাঙ্গীর। তাঁর কাছ থেকে নগদ ১০ হাজার টাকা এবং আধাবিঘা সম্পত্তি লিখে নেয় বিদেশে পাঠানোর নামে। একই সময়ে এলাকার রিয়াজ উদ্দিন নামে আরো এক যুবকের কাছ থেকেও বিদেশের নামে টাকা নেন। তাদেরকে বিদেশ আর পাঠায়নি রাজাকার জাহাঙ্গীর। তারা মনের কষ্টে রাস্তা-ঘাটে রাজাকার জাহাঙ্গীরকে গালাগাল করতো। অবশেষে আর পথ না পেয়ে দু’জনেই বাসের হেলাপারী শুরু করেন।
চতুর জাহাঙ্গীর হাসেনের আত্মসাৎকৃত জমিটি ছোটভাই আলী কবির উরফে মিল্লাতের সাথে এওয়াজ বদল করেন। বর্তমানে ওই জায়গায় কৃষি ব্যাংক কাপাসিয়া শাখার কর্মচারী আলী কবির ওরফে মিল্লাত দোতলা বাড়ি করে থাকেন। পরপর তিন জনের জমি আত্মসাত করে নিজ বাড়ির সীমানা প্রস্তত করেন। ছোট ভাই মিল্লাতও কিছুটা জাহাঙ্গীরের টাইপের। সে চাকুরি করায় ততোটা সুযোগ নিতে পারে না। তারপরও মিল্লাতের দোতলা বাড়ির সীমানা বাড়ানোর জন্য পাশের আরেক জনের জমি গ্রাস করার অপচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন প্রায় ১৫ বছর যাবৎ। এটি নিয়ে মামলা রয়েছে উচ্চ আদালতে।
কাপাসিয়া গ্রামের বড়টেক এলাকার আম্বিয়া খাতুন। বয়স প্রায় ৭০ হবে। সম্প্রতি তাঁর ছেলে শাহজাহান নিখোঁজ হয় তা এলাকার কেউ অজানা নয়। শাহজাহান নিখোঁজের পর রাজাকার জাহাঙ্গীর মা আম্বিয়াকে বলেন- শাহজাহান তার কাছে জমি বিক্রি করেছেন। জমির দখল বুঝিয়ে দিতে বলেন আম্বিয়াকে। আম্বিয়ার এমনিতে ছেলে নিখোঁজের শোকÑ আবার জমি হারানোর কথা শুনতে হচ্ছে। তবে জমির দখল দিতে নারাজ আম্বিয়া। আম্বিয়ারা খুব গরিব। তারপরও প্রতিবাদ করেন। তাঁর ছেলের সন্ধান চান জাহাঙ্গীরের কাছে। এ নিয়ে চলে তাদের মাঝে দ্বন্দ্ব। এক পর্যায়ে ঠাকুরগাঁও এলাকায় জনৈক ব্যক্তিকে বাদি সাজিয়ে মিথ্যা মামলা দিয়ে আম্বিয়া ও তাঁর ছেলেদেরকে জেলখাটায় কয়েক মাস। তাছাড়াও গাজীপুর শহরের মুন্সিপাড়া এলাকার ঠিকানা দিয়ে ভুয়া বাদী সৃজন করে আম্বিয়া ছেলে ও মেয়ের জামাই’র বিরুদ্ধে ভুয়া অপহরণ মামলা দায়ের করেন গাজীপুর আদালতে (সিআর মোঃ নং ৩০২ তাং ১৯/৮/১৩)। এ মামলাটি কাপাসিয়া থানা থেকে এফআইআর ভূক্ত করা হয় (নং-২৩, তারিখ ২৮/৯/১৩)।
রাজাকার জাহাঙ্গীরের কুটকৌশলের কাছে হার মেনে আম্বিয়া সেচ্ছায় জমির দখল বুঝিয়ে দেন। তাঁর ছেলে এখনও নিখোঁজ। আম্বিয়ার আর এক ছেলে মালয়েশিয়ায় খুন হয়। আম্বিয়ার ধারণা মালয়েশিয়ায় তাঁর ছেলেকে খুন করেছে রাজাকার জাহাঙ্গীরের ছেলে ফয়সাল। ফয়সালও সাতটি ডাকাতি মামলার আসামী ছিল। জামিনে মুক্তি পেয়ে গোপনে বিদেশে পাড়ি জমায়।
গাজীপুর আদালতে আম্বিয়া বাদী হয়ে তাঁর ছেলেকে অপহণ, গুম ও ভিটা-বাড়ি দখলের অভিযোগ এনে একটি মামলা (সি.আর মোঃ নং ২৫৭/১৩, তাং ২১/৭/১৩ খ্রিঃ) দায়ের করেন।
এভাবে আরো মানুষের জমি-জমা আত্মসাৎ, নানা কুটকৌশলে হয়রানি করাচ্ছেন রাজাকার জাহাঙ্গীর। দেশ স্বাধীন হলেও এ রাজাকার জাহাঙ্গীরের কাছে এলাকার সাধারণ মানুষ পরাধীন। তাকে ঠেকাবে কে?