বাংলাভূমি২৪ ডেস্ক ॥ চট্টগ্রাম থেকে প্রতিদিন বিভিন্ন পণ্য নিয়ে প্রায় পাঁচ হাজার ট্রাক যেত দেশের বিভিন্ন স্থানে। হরতাল-অবরোধে তা এখন ১০০-তে নেমে এসেছে। উত্তরবঙ্গে একটি ট্রাক চট্টগ্রাম থেকে যেতে ভাড়া গুনছে লাখ টাকা! তাও পাওয়া যাচ্ছে না। চট্টগ্রামের খাতুনগঞ্জের বিভিন্ন গোডাউনে নষ্ট হচ্ছে পণ্য। পণ্য থাকলেও সাধারণ মানুষের কাছে তা পৌঁছানো যাচ্ছে না। খাতুনগঞ্জের পণ্য নষ্ট হচ্ছে খাতুনগঞ্জে। চট্টগ্রাম কাস্টসম এখনও ২ হাজার কোটি টাকা রাজস্ব থেকে পিছিয়ে আছে। খাতুনগঞ্জের অনেক ব্যবসায়ী দেউলিয়া হয়ে যাওয়ার পথে।
অর্থঋণ আদালতে নাম উঠছে অনেক বড় বড় ব্যবসায়ীর। চট্টগ্রাম ইপিজেডে মুখ থুবড়ে পড়েছে সামগ্রিক ব্যবসা-বাণিজ্য। মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে বিদেশি বায়াররা। চট্টগ্রাম ইপিজেডের সবচেয়ে বৃহৎ প্রতিষ্ঠান ‘প্যাসিফিক গ্রুপ’। প্রায় ২৫ হাজার কর্মকর্তা-কর্মচারী। এ গ্রুপের ওপর নির্ভর করে চলছে হাজার হাজার পরিবার। গ্রুপের স্বত্বাধিকারী নাসির উদ্দিন হতাশ কণ্ঠে বলেন, তিল তিল করে গড়ে ওঠা এ প্রতিষ্ঠানটি এখন কঠিন সমস্যার মুখোমুখি। তিনি বলেন, এখন শীতকাল। বিদেশে বাংলাদেশী কাপড়ের ব্যাপক চাহিদা। কিন্তু উৎপাদন আর সরবরাহ ব্যবস্থা ভেঙে পড়ার কারণে সবকিছু এখন হুমকির মুখে। বিদেশি বায়ারদের সঠিক সময়ে পণ্য সরবরাহ দিতে পদে পদে বাধার সম্মুখীন হতে হচ্ছে। তিনি বলেন, হাজার হাজার কর্মকর্তা-কর্মচারীর মুখের দিকে চেয়ে এ প্রতিষ্ঠান নিয়ে আমি লড়াই করে যাচ্ছি। পরিস্থিতির উত্তরণ না হলে ভবিষ্যৎ কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে এ নিয়ে শঙ্কিত আমি।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে দেশের সামগ্রিক আমদানি-রফতানির প্রায় ৮৫ ভাগই হয়ে থাকে। চট্টগ্রাম কাস্টসম হচ্ছে দেশের সবচেয়ে বেশি রাজস্ব যোগানদাতা। এখানে রয়েছে দেশের অন্যতম ‘চট্টগ্রাম ইপিজেড’, যেখানে কাজ করে ৪ লাখেরও বেশি শ্রমিক। ৪ বছর ধরে চট্টগ্রামের ব্যবসা-বাণিজ্য যেটুকু এগিয়েছে, তা প্রায় শেষ হয়ে গেছে ৩ মাসে। টানা দিনের পর দিন হরতাল আর অবরোধের কারণে অনেক প্রতিষ্ঠানের রফতানি অর্ডার বাতিল হয়ে গেছে। অনেকে বাধ্য হয়ে বাতিল করেছেন। কারণ শীতকালে সবচেয়ে বেশি গরম কাপড় যায় বাংলাদেশ থেকে। অনেক প্রতিষ্ঠান উৎপাদন করলেও সরবরাহ করতে না পারায় বেকায়দায় আছে। হরতাল-অবরোধে সরবরাহ ব্যবস্থা ভেঙে পড়ার কারণে অর্ডারগুলো বাতিল করতে বাধ্য হয়েছে অনেকে। কারণ অনেকের শিল্প-কারখানা রয়েছে চট্টগ্রামের বাইরে।
হরতাল-অবরোধে ট্রাক ও কাভার্ডভ্যান ভাড়া এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে, যা অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে। চলমান অবস্থায় বিদেশে বাজার হারানো ও আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতিযোগিতামূলক সক্ষমতা হারানোসহ বিভিন্ন আতঙ্কে ভুগছেন ব্যবসায়ীরা। অনেক ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান দেউলিয়া হওয়ার পথে। অর্থঋণ আদালতে বাড়ছে মামলার সংখ্যা। বিশেষ করে দেশের ওয়াল স্ট্রিট বলে খ্যাত চট্টগ্রামের ‘খাতুনগঞ্জ’ এখন বন্ধ প্রায়। প্রতিদিন যেখানে ৬০০ কোটি থেকে ১ হাজার কোটি টাকার ব্যবসায়িক লেনদেন হতো, সেখানে তা নেমে এসেছে শূন্যের কোটায়। গুদামে নষ্ট হচ্ছে কোটি কোটি টাকার পণ্য। উত্তরবঙ্গে কোনো পণ্যই পাঠানো যাচ্ছে না। ঝুঁকি নিয়ে যেসব গাড়ি যাচ্ছে, তাতে ভাড়া হাঁকছে লাখ টাকা। ঢাকায় পণ্য যেত ১৫ থেকে ১৬ হাজার টাকায়। সে ভাড়া এখন সর্বোচ্চ ৫০ হাজার টাকা। অনেকে বন্ধ করে দিয়েছে আমদানি। এরই মধ্যে আমদানি করা পণ্য খালাস ও বাজারজাত করতে না পারায় গুদামভর্তি। তাই নতুন করে আর আমদানি হচ্ছে না। এতে চাপ পড়ছে সামগ্রিক অর্থনীতিতে। কমে যাচ্ছে রাজস্ব আদায়।
কাস্টমস কমিশনার মাসুদ সাদিক বলেন, তিন মাসের ধাক্কায় কমে গেছে রাজস্ব আদায়। ডিসেম্বর পর্যন্ত ১২ হাজার ৬০০ কোটি টাকা রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা ছিল। এখন প্রায় ২ হাজার কোটি টাকা পেছনে আছি। এ অবস্থা অব্যাহত থাকলে রাজস্ব আদায় কী পরিমাণ হবে তা নিয়ে সংশয় দেখা দিয়েছে।
দেশে সবচেয়ে বেশি পণ্য আমদানি হয় চট্টগ্রামের খাতুনগঞ্জে। এখান থেকে প্রতিদিন হাজার হাজার ট্রাক দেশের বিভিন্ন স্থানে পণ্য পরিবহন করে নিয়ে যায়। চলমান রাজনৈতিক অস্থিরতায় সবচেয়ে বেশি খারাপ অবস্থা খাতুনগঞ্জের। চট্টগ্রাম বন্দরের সন্নিকটে হওয়ার কারণে পণ্য আমদানি করে গুদামভর্তি করে রেখেছে ব্যবসায়ীরা। দিন গুনছে কবে সমস্যার সমাধান হয়। কিন্তু দিনের পর দিন চলতে থাকা হরতাল-অবরোধের কারণে গুদাম থেকে পণ্য আর বের হচ্ছে না। একদিকে বিপুল পরিমাণ ট্রাক ভাড়া, অন্যদিকে ব্যাংকের দেনা শোধ করতে গিয়ে অনেকের এখন অসহায় দিন যাচ্ছে। সঠিক সময়ে পণ্য সরবরাহ না হওয়ার কারণে দেশের বিভিন্ন স্থানে বাড়ছে পচনশীল পণ্যের দাম। সরবরাহ করতে না পারার কারণে মান নষ্ট হচ্ছে ও পণ্য পচে যাচ্ছে। শুধু ঢাকা-চট্টগ্রাম পণ্য পরিবহন ভাড়া দ্বিগুণ হয়েছে। ১৬ হাজার টাকা ট্রাক ভাড়া এখন ৪০ থেকে ৫০ হাজার টাকা। আর উত্তরবঙ্গে ট্রাক ও কাভার্ডভ্যান ভাড়া লাখ টাকা।
বিষয়টি স্বীকার করে খাতুনগঞ্জ ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক সগির আহম্মদ বলেন, ব্যবসায়ীরা এখন আমদানি প্রায় বন্ধ করে দিয়েছে। এ অবস্থা চলতে থাকলে বড় ধরনের সমস্যা সৃষ্টি হতে পারে। তিনি বলেন, মনে করেছিলাম নির্বাচনের পর দেশের মানুষ আর হরতাল-অবরোধ দেখবে না। অথচ আবারও হরতাল-অবরোধে পড়ে এখন সবাই দিশাহারা।
দেশের অর্থনৈতিক চালিকাশক্তি চট্টগ্রাম বন্দর। প্রতিদিন চট্টগ্রাম বন্দরের মাধ্যমে সারা দেশের ব্যবসায়ীরা নিজেদের ব্যবসা পরিচালনা করে আসছেন। প্রতিদিন চট্টগ্রাম বন্দরের মাধ্যমে প্রায় ২ হাজার ২০০ কনটেইনার পণ্য আমদানি ও রফতানি হয়ে থাকে। হরতাল ঘোষণার পর থেকে ব্যবসায়ীদের শিডিউল এলোমেলো হয়ে যায়। সঠিক সময় কনটেইনার পণ্য জাহাজীকরণ হয় না, আবার সঠিক সময় পণ্য জাহাজ থেকে নামানোর পর গন্তব্যে পৌঁছে না। ফলে ব্যবসায়ীদের গুনতে হচ্ছে কোটি কোটি টাকা ডেমারেজসহ নানা ধরনের লোকসান। কয়েক দিনের হরতালে দেশের অন্যতম গার্মেন্ট সেক্টরে নেতিবাচক প্রভাব সবচেয়ে বেশি। বিদেশি বায়ারদের নানা ধরনের জবাবদিহি করতে হচ্ছে এ সেক্টরের সঙ্গে জড়িত ব্যবসায়ীদের। কারণ চট্টগ্রাম বন্দর থেকে পণ্য পাঁচ দিনের মধ্যে সিঙ্গাপুর, কলম্বো ও মালয়েশিয়ার পোর্ট কেলাংয়ে যায়। এখান থেকে কনটেইনার মাদার ভেসেলযোগে ইউরোপ-আমেরিকায় বায়ারদের কাছে যায়। টানা হরতালের কারণে ব্যবসায়ীরা অনেক সময় প্রয়োজনীয় পণ্য সিঙ্গাপুর, কলম্বো বা পোর্ট কেলাংয়ে পৌঁছতে ব্যর্থ হচ্ছে। ফলে হারাতে হচ্ছে মাদার ভেসেল। পণ্য সময়মতো পাচ্ছে না আমদানিকারক। পরে অর্ডার বাতিলের খড়গ নেমে আসছে। শুক্র-শনিবার বাংলাদেশে সরকারি ছুটির দিন। অথচ এ দুদিন বিদেশে বেশিরভাগ কাজ হয়। সরকারি ছুটির পর টানা হরতাল ডাকার ফলে বিস্মিত ব্যবসায়ী সমাজ। ঢাকা ও চট্টগ্রামের বিভিন্ন গার্মেন্টে গাড়িভর্তি পণ্যের স্তূপ পড়েছে। অন্যদিকে বন্দরে বাড়ছে কনটেইনার ও জাহাজজট। বন্দরের অভ্যন্তরে পণ্য জাহাজ থেকে নামলেও ডেলিভারি হচ্ছে না। অন্যদিকে প্রয়োজনীয় সংখ্যক কনটেইনার পণ্য না পেয়ে শূন্য কনটেইনার নিয়ে চলে যাচ্ছে জাহাজ। চট্টগ্রাম বিজিএমইএ’র সাবেক প্রথম সহ-সভাপতি নাসির উদ্দিন চৌধুরী বলেন, বিদেশের আমদানিকারকরা এখন প্রতিদিনই দেশের অবস্থার খোঁজখবর নিচ্ছেন। যেহেতু এখন বেশিরভাগ গার্মেন্ট পণ্য উৎপাদন হচ্ছে ঢাকায়, ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম বন্দরে পণ্য সময়মতো আসছে না। ফলে আমদানিকারকদের কাছে তা সময়মতো পৌঁছানো কঠিন হয়ে পড়েছে। এতে আস্থা হারাচ্ছে আমদানিকারক। কয়েক দিনের হরতাল এবং ভবিষ্যৎ রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে তারা এখন বিকল্প বাজার খুঁজছে।