শনিবার , ২০শে এপ্রিল, ২০২৪ , ৭ই বৈশাখ, ১৪৩১ , ১০ই শাওয়াল, ১৪৪৫

হোম > অর্থ-বাণিজ্য > ১৩০ কোটি কালো টাকা বিনিয়োগ শেয়ারবাজারে

১৩০ কোটি কালো টাকা বিনিয়োগ শেয়ারবাজারে

শেয়ার করুন

স্টাফ রিপোর্টার ॥ বিদায়ী ২০১২-১৩ অর্থবছরে মোট ১৩০ কোটি কালো টাকা শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ হয়েছে। আর বিনিয়োগ করেছে মাত্র ৭১ জন করদাতা। এ খাত থেকে সরকার রাজস্ব পেয়েছে ১৪ কোটি টাকা। তবে বর্তমান সরকারের প্রথম ৪ বছরে শেয়ারবাজারে কালো টাকা বিনিয়োগের সুযোগ দেয়া হলেও চলতি অর্থবছরে উৎপাদনমুখী শিল্প ছাড়া অন্য খাতের এ সুযোগ বাতিল করা হয়েছে। জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবি আর) সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে। এদিকে কালো টাকা বিনিয়োগের জোরালো বিরোধিতা করছেন অর্থনীতিবিদরা। তাদের মতে, বারবার সুযোগ দেয়ায় একদিকে নিয়মিত করদাতারা নিরুৎসাহিত হচ্ছেন, অন্যদিকে যে উদ্দেশ্য দেয়া হচ্ছে, তা সফল হচ্ছে না।

কালো টাকা বিনিয়োগ : বিদায়ী অর্থবছরের ১২ মাসে প্রায় ১৩০ কোটি টাকার সমপরিমাণ কালো টাকা শেয়ারবাজারে এসেছে। আর বিনিয়োগ করেছেন ৭১ জন করদাতা। এতে সরকার রাজস্ব পেয়েছে প্রায় ১৪ কোটি টাকা । আগের বছরে ৮২ জন বিনিয়োগকারী ৩৮২ কোটি টাকা শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ করেছেন। সব মিলিয়ে দুই অর্থবছরে ১৫৩ জন বিনিয়োগকারী ৫২০ কোটি টাকা বিনিয়োগ করেছেন। বর্তমান সরকারের আমলে ২০০৯-১০ থেকে ২০১২-১৩ সাল পর্যন্ত ধারাবাহিকভাবে কালো টাকা সাদা করার সুযোগ দেয়া হয়। প্রথম বছর এ খাতে ২৯৬ জন বিনিয়োগকারী ৪২৬ কোটি ৬৭ লাখ টাকা বিনিয়োগ করেছে। আর এখাত থেকে রাজস্ব আয় হয়েছে ৪২ কোটি ৬৬ লাখ টাকা। সব মিলিয়ে ৪ বছরে শেয়ারবাজারের এক হাজার ২১৪ জন কালো টাকা সাদা করেছেন।

বিনিয়োগের নিয়ম : এনবি আরের বক্তব্য অনুসারে কেউ কালো টাকা বিনিয়োগ করতে চাইলে নির্ধারিত করের ওপর অতিরিক্ত ১০ শতাংশ জরিমানা দিতে হয়। অর্থাৎ করের সর্বোচ্চ ধাপ ২৫ শতাংশ। আর কালো টাকা বিনিয়োগকারীকে ২৫ শতাংশের ওপরে ১০ শতাংশ জরিমানা দিতে হয়। অর্থাৎ ২ দশমিক ৫০ শতাংশ জরিমানাসহ তার করের হার দাঁড়ায় ২৭ দশমিক ৫০ শতাংশ। এছাড়া কর বহির্ভূত টাকা আয়কে তারা দুই ভাগে করেছে। এর মধ্যে রয়েছে কালো টাকা এবং অপ্রদর্শিত আয়। যার আয়ের খাত বৈধ কিন্তু কর দেয়নি, ওই আয়কে অপ্রদর্শিত আয় হিসেবে ধরা হয়। আর যে টাকা অবৈধ পথে আয় হয়, তা কালো টাকা। তবে সরকারের নতুন মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইনে কর বহির্ভূত যে কোনো আয়কে কালো টাকা হিসেবে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে।

কালো টাকা বিনিয়োগের ইতিহাস : ১৯৭৫-৭৬ অর্থবছরে জিয়াউর রহমানের সময় বাংলাদেশে প্রথম কালো টাকা সাদা করার সুযোগ দেয়া হয়। ওই বছর ১৫ শতাংশ কর দিয়ে মাত্র ৭০ কোটি টাকা সাদা করা হয়। ওই সময় সরকার রাজস্ব পেয়েছিল ১০ কোটি টাকা। পরের অর্থবছর এ সুযোগ অব্যাহত রাখা হয়। এরপর এরশাদের আমলে ১৯৮৭-৮৮ অর্থবছরে ২০ শতাংশ কর দিয়ে দ্বিতীয়বারের মতো কালো টাকা সাদা করার সুযোগ দেয়া হয়। এ সময় ২০০ কোটি কালো টাকা সাদা করা হয়। আর সরকারের কোষাগারে জমা হয় ৪০ কোটি টাকা। ১৯৮৮-৮৯ অর্থবছরে কর ধরা হয় ১০ শতাংশ এবং শর্ত দেয়া হয় শিল্পে বিনিয়োগ করলে বিনা প্রশ্নে মেনে নেয়া হবে। এ সময় ২৫০ কোটি কালো টাকা বিনিয়োগের বিপরীতে সরকার রাজস্ব পায় ৩৫ কোটি টাকা। ১৯৮৯-৯০ অর্থবছরে একই নিয়মে ৪০০ কোটি টাকা বিনিয়োগের বিপরীতে সরকার পায় ৪০ কোটি টাকা। ১৯৯৬ সাল থেকে আওয়ামী লীগের আমলে সব মিলিয়ে ১০০০ কোটি কালো টাকা সাদা হয়। আর সরকারের কোষাগারে জমা পড়ে ১০০ কোটি টাকা। ২০০১ বিএনপি মতায় আসার পর কালো টাকা সাদা করার সুযোগ দেয়া হয়। বিএনপির আমলে ১ হাজার ৭৭ জন বিনিয়োগকারী ৭৭৫ কোটি টাকা সাদা করে। তবে শর্ত ছিল সেবার শিল্প বাণিজ্যে বিনিয়োগ করতে হবে। ওয়ান-ইলেভেনের পর ২০০৭ সালে পরপর দুবছরই কালো টাকা সাদা করার সুযোগ রাখা হয়। তবে এ সময় কালো টাকা না বলে অপ্রদর্শিত আয় বলা হয়েছিল। প্রথমবার ৪২ হাজার ৫৯১ জন করদাতা এ সুযোগ নিয়ে ৮ হাজার ৮৯৫ কোটি টাকা সাদা করে। আর সরকার রাজস্ব আদায় করে ৮০৩ কোটি টাকা। পরের অর্থবছরে সুযোগ দেয়া হয় চার মাসের জন্য। এ সময় ১৪ হাজার ৬২২ জন করদাতা ৭৮৮ কোটি টাকা অপ্রদর্শিত বৈধ করে। আর সরকারের রাজস্ব আয় ১০৮ কোটি টাকা।

অর্থনীতিবিদদের অভিমত : তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ড. আকবর আলি খানের মতে, কালো টাকা বিনিয়োগ অনৈতিক। যার কালো টাকা রয়েছে তারা এক অর্থে চোর। কোনোভাবে এটিকে সরকারের প্রশ্রয় দেয়া উচিত নয়। উল্টো এদের ধরে এনে শাস্তি নিশ্চিত করা উচিত। তিনি বলেন, চুরির টাকা দিয়ে শেয়ারবাজার ভালো করার দরকার আছে বলে মনে হয় না। তার মতে, এর আগেও কালো টাকা বিনিয়োগের ফলে ওইভাবে সুবিধা পাওয়া যায়নি। সরকারি খাতে আশানুরূপ কর আসেনি। বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদের মতে, কালো টাকা জায়েজ করার প্রক্রিয়া অনৈতিক, অযুক্তিক এবং তিকর। তিনি বলেন ুদ্র বিনিয়োগকারীদের কাছে কালো টাকা নেই। কালো টাকা প্রভাবশালীদের কাছে। তাই ওই মহলটিকে কালো টাকা বিনিয়োগের সুযোগ দিলে তারা বাজারে কারসাজি করে। এ েেত্র সাধারণ বিনিয়োগকারীরা আবারও তিগ্রস্ত হয়। তার মতে, কালো টাকা বিনিয়োগ অনৈতিক। আর অনৈতিক সুবিধাটি দিয়েও ভালো কোনো রেজাল্ট পাওয়া যায়নি। ফলে কোনোমতেই শেয়ারবাজারের মতো স্পর্শকাতর জায়গায় কালো টাকা বিনিয়োগের সুযোগ দেয়া উচিত নয়। তিনি আরও বলেন, শেয়ারবাজারের উন্নতি কয়েকটি বিষয়ের ওপর নির্ভরশীল। এ জন্য প্রয়োজন সরকারের মানসিকতা, চাহিদা ও সরবরাহের মধ্যে সমন্বয় এবং নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলোর দতা। এটি কালো টাকা বিনিয়োগের ওপর নির্ভর করে না।