স্টাফ রিপোর্টার ॥ বিদ্যুৎ উৎপাদন বাড়লেও জ্বালানি সংকট আর অবকাঠামো সমস্যার কারণে এর সুফল ভোগ করতে পারছেন না গ্রাহকরা। এ সংকট কাটিয়ে ওঠা না গেলে বিদ্যুৎ সংকট দীর্ঘমেয়াদি হবে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। ২০০৯ সালে ৪ হাজার ৯৪২ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা ছিল। কিন্তু এখন উৎপাদন ক্ষমতা প্রায় ৮ হাজার ৫২৫ মেগাওয়াট। তবে জ্বালানি সংকট এবং অবকাঠামো সংকটের কারণে বিদ্যুতের উৎপাদন হচ্ছে ৬ হাজার মেগাওয়াট।
জ্বালানি ঘাটতির মধ্যে বড় সমস্যা গ্যাস। গ্যাস নেই তবু গ্যাসভিত্তিক কেন্দ্র করা হয়েছে। প্রায় ৬০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করা যাচ্ছে না গ্যাস ঘাটতির কারণে। গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর এক হাজার মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাসের চাহিদার বিপরীতে সরবরাহ করা হচ্ছে ৮০০ মিলিয়ন ঘনফুট। কিছুদিন আগ পর্যন্ত ৯৫০ মিলিয়ন ঘনফুট বিদ্যুৎখাতে সরবরাহ করা হলেও সম্প্রতি সার কারখানায় গ্যাস সরবরাহের কারণে বিদ্যুতের ১৫০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস সরবরাহ কমিয়ে দেয়া হয়েছে।
গ্যাস কম আছে বলে বিকল্প হিসেবে তেলভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন করা হয়েছে। কিন্তু খরচ বেশি বলে এখন তেলভিত্তিক সব কেন্দ্র চালু রাখা হচ্ছে না। ফলে বিদ্যুৎকেন্দ্র থাকলেও তেলের অভাবে তা চলছে না। এর কারণে প্রায় ৫০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন বন্ধ আছে।
১৯৯৬ সালে বিবিয়ানায় গ্যাস আবিষ্কারের পর আর কোনো বড় ক্ষেত্র পাওয়া যায়নি। বিদেশি কোম্পানির পাশাপাশি বাপেক্স অনুসন্ধান এবং উৎপাদন বাড়ানোর কাজ করছে। কিন্তু তাদের অধীন ক্ষেত্রগুলো থেকে খুব কম পরিমাণ গ্যাস জাতীয় গ্রিডে যুক্ত হচ্ছে। এ অবস্থায় বিদ্যুৎখাতে জ্বালানি ঘাটতি মেটাতে হলে বিকল্প জ্বালানি দিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদনের পরিকল্পনা করা হলেও বাস্তবে সে পরিকল্পনা বাস্তবায়নের অগ্রগতি নেই বললেই চলে।
বড়পুকুরিয়া কয়লা খনির কয়লা আছে। যা দিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন বাড়ানো সম্ভব হতো। কিন্তু তা করা হয়নি। কয়লার ব্যবহার হয়নি। কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের মধ্যে একমাত্র বাংলাদেশ-ভারত যৌথ উদ্যোগে স্থাপিতব্য রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের প্রাথমিক কাজ শুরু হয়েছে। আগামী মাসে এ কেন্দ্রের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করা হতে পারে। এ কেন্দ্রটি ২০১৬ সালের মধ্যে উৎপাদনে আসার কথা রয়েছে।
আগামী মাসে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রটির ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপনের কথা রয়েছে। তবে এক্ষেত্র থেকে কবে নাগাদ বিদ্যুৎ জাতীয় গ্রিডে যোগ হবে তা এখনো অনিশ্চিত। বায়ু বা জলবিদ্যুৎকেন্দ্র নিয়ে সরকার পরিকল্পনা করলেও তা এখন পর্যন্ত আলোর মুখ দেখেনি।
অবকাঠামো সমস্যা: বেসরকারি হিসেবে বর্তমানে দেশে প্রায় আট হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুতের চাহিদা রয়েছে। উৎপাদন হচ্ছে প্রায় ৬ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ। কিন্তু সিস্টেম লসের কারণে এই উৎপাদনের পুরোটাও গ্রাহকরা পাচ্ছে না।
২০০৯ সালে সঞ্চালন লাইন ছিল ৮ হাজার ৩০৫ কিলোমিটার। এই চার বছরে তা বেড়েছে মাত্র ৬৪৪ কিলোমিটার। বিতরণ লাইন ছিল ২ লাখ ৫৬ হাজার ১৪৩ কিলোমিটার। এখন তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২ লাখ ৮১ হাজার ১২৩ কিলোমিটার।
সঞ্চালন ও বিতরণ মিলিয়ে বিদ্যুতে এখন প্রায় ১৬ দশমিক ৩৬ শতাংশ সিস্টেম লস হচ্ছে। চলতি বছরের জুলাই পর্যন্ত হিসাবে বিদ্যুৎখাতে সঞ্চালন লস ২.৭৭ শতাংশ আর বাকি ১৪.২৩ শতাংশ লসই বিতরণ লস। আরইবি এবং ওজোপাডিকো ছাড়া অন্য তিনটি বিদ্যুৎ বিতরণ সংস্থার সিস্টেম লস কমেছে। সিস্টেম লস কমাতে না পারায় এই দুই সংস্থার চার কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে।
অন্যদিকে সারাদেশের প্রায় ২০ ভাগ ট্রান্সফরমার এখন ওভারলোডেড অবস্থায় আছে। যার পরিমাণ ১ লাখ ৩৮ হাজার ৪৮৭টি। পিডিবির অধীন এলাকায় মোট ২৫ হাজার ৮০৯টি ট্রান্সফরর্মার আছে। এরমধ্যে ৩ হাজার ৪৫০টি ট্রান্সফরমার ওভারলোডেড। আরইবির ৬ লাখ ৪১ হাজার ৫৬৫টি ট্রান্সফরমারের মধ্যে ১ লাখ ৩৩ হাজার ৩১১টি, ডিপিডিসির ৯ হাজার ৩২৪টির মধ্যে ১ হাজার ৯৪টি, ডেসকোর ৫ হাজার ২৪৯টির মধ্যে ৪৬৯টি, ওজোপাডিকোর ৫ হাজার ৬৬৪টির মধ্যে ১৩১টি এবং পিজিসিবির ২৩০টির মধ্যে ৩২টি ট্রান্সফরমার ওভারলোডেড। এসব ওভারলোডেড ট্রান্সফরমারগুলোর কারণে বিদ্যুৎ সরবরাহ বিঘিœত হচ্ছে।
এ বিষয়ে ডিপিডিসির পরিচালক (অপারেশন) মিজানুর রহমান জানান, ওভারলোডেড ট্রান্সফরমারের কারণে চাহিদা অনুযায়ী বিদ্যুৎ সরবরাহ করা যাচ্ছে না। এমনিতেই চাহিদার পুরো বিদ্যুৎ পাওয়া যায় না। তারওপর ট্রান্সফরমারগুলোর কারণে গ্রাহকদের বিদ্যুৎ দেয়া যাচ্ছে না।
তেল-গ্যাস খনিজ সম্পদ এবং বিদ্যুৎ বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটির সদস্য সচিব আনু মুহাম্মদ বলেন, জ্বালানি ও অবকাঠামো সংকটের কারণে বিদ্যুৎ সংকট দীর্ঘমেয়াদি হবে। একদিকে গ্যাস অনুসন্ধান ও উত্তোলন বাড়েনি অন্যদিকে বিদ্যুতের উৎপাদন বাড়াতে একের পর এক সরকার চুক্তি করলেও এই বিদ্যুৎ সরবরাহের ব্যবস্থার উন্নয়ন করেনি। ফলে অবকাঠামোর কারণে উৎপাদিত বিদ্যুতের পুরোটাও সাধারণ মানুষ পাচ্ছে না। রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন না করে বড় বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন করা হলে ঘাটতি কিছুটা কম হতো।