বাংলাভূমি২৪ ডেস্ক ॥ একজন দক্ষ শ্রমিক দৈনিক প্রায় ২৫ জোড়া জুতা তৈরি করতে পারেন। ভৈরবের অনেক কারখানায় পুঁজি বিনিয়োগ করা হয়েছে সর্বোচ্চ প্রায় ৩০ লাখ টাকা করে। ২০-২৫ হাজার টাকা বিনিয়োগের ছোট কারখানাও রয়েছে।
বন্ধুর সহযোগিতায় ফুটপাতে পাদুকা ব্যবসা করে সফলতার মুখ দেখেছেন চাঁদপুরের নুরুল ইসলাম। নুরুলের মতো হাজারও বেকার যুবক রাজধানীর ফুটপাতে পাদুকা ব্যবসা করে স্বাবলম্বী হচ্ছেন। নিজের জীবন বাঁচানোর পাশাপাশি পরিবারের অন্য সদস্যদের হাতে তুলে দিচ্ছেন সুন্দর ভবিষ্যৎ গড়ে তোলার পথ। এই ব্যবসাকে কেন্দ্র করে দিন দিন রাজধানীর ফার্মগেট, নিউমার্কেট, মিরপুর, উত্তরা, গুলিস্তানসহ বড় রাস্তার ফুটপাতে গড়ে উঠেছে জুতার বাজার। একই সঙ্গে পুরান ঢাকা, লালবাগের অনেক জুতার কারখানায় কর্মসংস্থানের সুযোগ পাচ্ছেন বেকার যুবকরা। যুগের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে নতুন ডিজাইন ও ভালো মানের জুতা তৈরিতে ব্যস্ত এসব কারখানার শ্রমিকরা।
নুরুল ইসলাম রাজধানীর ব্যস্ততম এলাকায় জুতার ব্যবসা করেন, বন্ধুর সহযোগিতায় এ ব্যবসায় তিনি এখন সফলতার পথে হাঁটছেন। ফুটপাতে জুতার ব্যবসা করেই তিনি পরিবারের ভরণ-পোষণ ও বাবার ঋণ পরিশোধ করেছেন। একই সঙ্গে ভবিষ্যতে গ্রামে বাবা-মায়ের ভিটাস্থলে বিল্ডিং করার স্বপ্ন পূরণে লাভের অংশ সঞ্চয় করছেন। নুরুল জানায়, দরিদ্রতার দরুন ও বাড়ির বড় ছেলে হওয়ায় খুব বেশি লেখাপড়া করার সুযোগ হয়নি নুরুল ইসলামের। ৫ম শ্রেণীর পর বন্ধ হয়ে যায় লেখাপড়া। তারপর বাবার সঙ্গে কৃষি কাজ শুরু করেন। এর কিছু দিন পর নুরুল ইসলাম চলে আসেন ঢাকায়। ইট-কাঠে আবদ্ধ ঢাকা শহরে শুরু হয় তার সংগ্রামী জীবন। প্রথমে কাজ নেন একট পানের দোকানে। স্বল্প বেতনের এই কাজে তার থাকা-খাওয়ার খরচও হয় না। বাধ্য হয়ে পানের দোকানের কাজ ছেড়ে জুতার দোকানে কর্মচারী হিসেবে শুরু করেন জীবন। এদিকে গ্রামের বাড়িতে বাবা-মা, ছোট তিন ভাই ও বড় এক বোনসহ মোট ৮ জনের সংসারে অভাব-অনটন লেগেই থাকে। কিন্তু নুরুল ইসলাম বাড়িতে টাকা পাঠাতে না পারায় দিনের পর দিন হতাশায় ভেঙে পড়েন। চার বছর জুতার দোকানে কাজ করার পর তিনি অনেকটা নিরাশ হয়ে আবার চাঁদপুরে চলে যান। এবার বাড়িতে গিয়ে শুরু করেন মাছের ব্যবসা।
নদীতে মাছ ধরে তা বাজারে বিক্রি করে সংসারের হাল ধরেন। এরই মধ্যে বড় বোনের বিয়ে হয়ে যায়। বোনের বিয়েতে বেশ কিছু অর্থ খরচ হওয়ার ফলে দরিদ্রতা আরও চরম আকার ধারণ করে নুরুল ইসলামের পরিবারে। ছোট ভাইদের হাফেজিয়া মাদরাসায় ভর্তি করে দিয়ে নুরুল ইসলাম আবার চলে আসেন ঢাকা শহরে। এবার চাকরি নেন লালবাগের পলি রাবার কারখানায়। কিছুদিন পর তিনি তার বাল্যকালের বন্ধু ঢাকা ট্রেড সেন্টারের পাইকারি জুতা ব্যবসায়ী জহুরুল ইসলামের সঙ্গে দেখা করেন। এরপর থেকেই শুরু করেন নিজের ব্যবসা। গুলিস্তানের বায়তুল মোকাররম মসজিদের সামনেই অন্যান্য ব্যাবসায়ীর মতো ব্যবসা শুরু করেন। আয়ও হয় ভালো। প্রতি মাসে সংসারের ও নিজের খরচ বাদে ২ থেকে ৩ হাজার টাকা সঞ্চয় করছেন। মাঝে মাঝে লাভের পরিমাণ বেশি থাকে।
বর্তমানে ক্রেতাদের একটা বড় অংশই ফুটপাতে ভালো মানের ও সুন্দর ডিজাইনের জুতা পাওয়ায় ব্র্যান্ডের জুতা কিনতেও ততটা আগ্রহী নন। ফার্মগেটের জুতা ব্যবসায়ী আফজাল মিয়া বলেন, ‘বড় কোম্পানিগুলোর মেয়াদ পার হওয়া জুতা আমাদের কাছে অনেক কম টাকায় বিক্রি করে দেয়। তখন ওই জুতাগুলোই কম মূল্যে অর্থাৎ ১২০০ টাকার জুতা ৫০০ বা ৪০০ টাকায় বিক্রি করি। এছাড়া আশপাশে স্কুল-কলেজের ছেলে-মেয়েরা নতুন নতুন ডিজাইনের জুতা পরার জন্য কম মূল্যে ফুটপাত থেকে জুতা কিনেন। আর এসব জুতা একচেটিয়া পরলে ২ থেকে ৩ মাস পরা যায়। ফলে কম মূল্যে এসব জুতা কেনার ঝোঁক সবারই থাকে।’
জানা যায়, দেশের অন্যান্য স্থানের পাশাপাশি জুতা বা পাদুকা শিল্পের বিকাশ ঘটেছে ভৈরবেও। বর্তমানে ভৈরবের বিভিন্ন স্থানে গড়ে উঠেছে হাজার হাজার ছোট-বড় জুতা তৈরির কারখানা। ভৈরবে এ কাজে জড়িত প্রায় আড়াই লাখ শ্রমিক। জুতার ব্যান্ড তৈরির কারখানাই রয়েছে কয়েক হাজার। অর্থাৎ পাদুকা শিল্পের পাশাপাশি জোরদার হয়েছে প্যাকেজিং শিল্পও। এসব শিল্পে পুরুষের পাশাপাশি কাজ করছেন নারীরাও। জুতার ব্যান্ড তৈরি শিল্পের সঙ্গে জড়িত আছেন প্রায় ২০ হাজার শ্রমিক। তবে ভৈরবসহ বিভিন্ন স্থানে মজুরি বৈষম্য আছে বলে জানা গেছে। ভৈরবে একজন দক্ষ পুরুষ শ্রমিক কাজ করে দৈনিক যেখানে পান সর্বোচ্চ ৩০০ টাকা, সেখানে নারী শ্রমিকদের দেয়া হয় সর্বোচ্চ প্রায় ২০০ টাকা।
একজন দক্ষ শ্রমিক দৈনিক প্রায় ২৫ জোড়া জুতা তৈরি করতে পারেন। ভৈরবের অনেক কারখানায় পুঁজি বিনিয়োগ করা হয়েছে সর্বোচ্চ প্রায় ৩০ লাখ টাকা করে। ২০-২৫ হাজার টাকা বিনিয়োগের ছোট কারখানাও রয়েছে। যাদের পুঁজি কম তাদের কারখানা ছোট। অবশ্য অনেক ছোট কারখানাও এ ব্যবসা চালিয়ে ভালোই লাভ করছে। এসব কারখানার মালিক মনে করেন, ছোট কারখানায় ঝুঁকি কম। অনেক কারখানার মালিক অল্প কয়েকজন শ্রমিক নিয়েই চালু করেন কারখানা। ধীরে ধীরে তা রূপ নেয় বৃহৎ কিংবা মাঝারি শিল্পে। যারা স্বল্প পুঁজিতে কারখানা গড়ে তোলেন তারা নিজেদের পরিবারের লোক দিয়েই পরিচালনা করেন তা। ব্যবসায়ীরা জানান, কারখানাগুলোতে তৈরি করা হয় নিত্যনতুন ডিজাইনের ফ্ল্যাট, হিল ও হাইহিল জুতা, স্যান্ডেল সু, পাম্প সু, কেডস ইত্যাদি। পাদুকা শিল্পকে ঘিরে গড়ে উঠেছে নানা ধরনের ব্যবসা। তাতে বিপুল পরিমাণে কর্মসংস্থানের সুযোগ হয়েছে।(আলোকিত বাংলাদেশ)