বাংলাভূমি২৪ ডেস্ক ॥ দিনভর মানব শূণ্য শুনশান নীরবতা থাকলেও রাত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে সরগরম হয়ে উঠে গুলশানস্থ ডিপ্লোম্যাটিক জোনের ৮৬ নম্বর রোডের ৬ নম্বর বাড়িটি। সূর্য উঠা থেকে শুরু করে সূর্য অস্ত পর্যন্ত বাড়িটিতে থাকে মানুষের জন্য হাহাকার। বাড়ির মূল ফটকে বেসরকারি একটি নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠানের পোশাক পরিহিত কয়েকজন নিরাপত্তা কর্মী ব্যতীত দিনের বেশিরভাগ সময় আর তেমন কেউ থাকেন না। সময়ের বিবর্তনে কোনো জরুরি প্রয়োজনে হয়তো সেখানে অফিসের স্টাফ বা অন্য কোনো রথী-মহারথীকে দেখা যায়।
তবে সময় গড়িয়ে সন্ধ্যা নয়, রাত নামলে বাড়িটির সামনে মানুষের ভীড় বাড়তে থাকে। বেশকিছু মানুষ সার বেঁধে দু’পাশে দাঁড়িয়ে থাকেন কারও অপেক্ষায়। তিনি যখন আসেন তার দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য তখন সবাই ব্যতিব্যস্ত হয়ে উঠেন। এ ব্যস্ততা ও চঞ্চলতা যাকে লক্ষ্য করে, তিনি তখন ওই বাড়িতে আসেন তার দৈনন্দিন দাফতরিক কাজ সম্পাদনের জন্য।
আলোচিত বাড়িটি দেশের বৃহৎ একটি দলের প্রধানের রাজনৈতিক কার্যালয়। বাড়িটি বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল-বিএনপি চেয়ারপারসনের কার্যালয়। দল ও দেশের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত ওই বাড়িতে গ্রহণ করা হয়। শুধু দেশের নয়, এমনকি বহির্বিশ্বের কোটি মানুষের বাড়িটির দিকে দৃষ্টি থাকে। থাকে বাংলাদেশের ভাগ্য যারা লেখেন, সেইসব পরাশক্তির দৃষ্টিও।
যেখানে দিনের কর্মচাঞ্চল্য শুরুই হয় সন্ধ্যার পর। চলে মধ্যরাত পর্যন্ত। শীত, গ্রীষ্ম, বর্ষাসহ যে কোনো ঋতুই সে চঞ্চলতায় ছেদ ফেলতে পারে না। দলের চেয়ারপারসনের কার্যালয়ে প্রবেশ ও মধ্যরাতে কার্যালয় ত্যাগ পর্যন্ত নেতাকর্মীরা গভীর ধৈর্য ও আগ্রহ নিয়ে ব্যস্ত ও অপেক্ষা করে থাকেন সেখানে। এরপর নিথর নীরবতায় চলে যায় বাড়িটি।
বাড়িটি নিয়ে বিরোধী রাজনৈতিক দলসহ স্বয়ং নিজ দলের নেতাকর্মীদের মধ্যেও রয়েছে মিশ্র প্রতিক্রিয়া। ইতিবাচক, নেতিবাচক বিভিন্ন ধরনের মন্তব্য শোনা যায় অনেকের মুখে। রাজধানীর নয়াপল্টনে দলটির সদর দফতর থাকলেও দলের নেতাকর্মীদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে চেয়ারপারসনের গুলশান কার্যালয়। নেতাকর্মীদের মধ্যে প্রচলিত আছে-কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের অবস্থা মূলত: ‘ঢাল নেই তলোয়ার নেই, নীধিরাম সর্দার’-এর মতো। গুলশান কার্যালয় থেকে কোনো বার্তা নাজিল না হলে কেন্দ্রীয় কার্যালয় কোনো সিদ্ধান্ত নিতে বা দিতে পারে না।
অতীত অনুসন্ধান করে দেখা গেছে, বিএনপির সর্বোচ্চ নীতি নির্ধারণী ফোরাম জাতীয় স্থায়ী কমিটির কোনো বৈঠক দিনের বেলায় হয় নি। মাসে, দুই মাসে যখনই দলের ওই গুরুত্বপূর্ণ বৈঠক হয়, সব সময়ই হয়ে থাকে রাতের বেলা। কোনো কোনো বৈঠক রাত বেশি হওয়ার কারণে সিদ্ধান্ত গ্রহণ ব্যতিরেকেই মূলতবি ঘোষণা করা হয়। অনেক বৈঠকে সিদ্ধান্ত গৃহীত হলেও তা রাতের গভীরতার কারণে সাধারণ জনগণ তো দূরের কথা, দলের গুরুত্বপূর্ণ নেতারাই জানতে পারেন না। সবাইকে অপেক্ষা করতে হয় পরের দিনের জন্য। এছাড়া দলীয় প্রধান বিদেশি ডেলিগেট বা কূটনীতিকদের সঙ্গে অধিকাংশ বৈঠকই করে থাকেন রাতে।
বিএনপির পক্ষ থেকে বারবারই অভিযোগ করা হয়, তাদের দলের সংবাদ দেশের মিডিয়া গুলো গুরুত্ব দিয়ে প্রচার করে না। যে কারণে দলের গুরুত্বপূর্ণ কর্মসূচি বা সিদ্ধান্ত জনসাধারণের সঙ্গে সঙ্গে নেতাকর্মীদের কাছেও সময় মতো পৌঁছায় না।
প্রকাশ্যে স্বীকার না করলেও দলটির এ ধরনের অভিযোগ রয়েছে দেশের বহুল প্রচারিত বেশকিছু সংবাদপত্র ও বেসরকারি টেলিভিশনের প্রতি। সম্প্রতি বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেল ইন্ডিপেন্ডেন্ট ও ৭১ টিভির কোনো টক শো বা সংবাদ সংশ্লিষ্ট অনুষ্ঠানে নেতাদের অংশগ্রহণের বিষয়ে অলিখিত নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে। দেশের রাষ্ট্র ক্ষমতায় একাধিকবার থাকা একটি গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দলের এ ধরনের পদক্ষেপ ও রাতে রাজনৈতিক কর্মসূচির বিষয়ে কয়েকজন জাতীয় ব্যক্তিত্বের সঙ্গে কথা বলে। তারাও এ ব্যাপারে বিএনপিকে আরও সচেতন ও সঠিক সিদ্ধান্ত নেওয়ার পরামর্শ দেয়।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি প্রখ্যাত রাষ্ট্রবিজ্ঞানী অধ্যাপক ড. এমাজউদ্দিন আহমদ বলেন, ‘রাজনৈতিক দলের কর্মকা- দিনের বেলায় হলে দলটিই লাভবান হবে। তাদের দলীয় সিদ্ধান্তগুলো সময় মতো সংবাদপত্র ও টেলিভিশন সংবাদে প্রচার হলে দল ও নেতাকর্মীরাই লাভবান হবে। রাতে নিউজ কাভারেজে সমস্যা হয়। তাছাড়া মনে রাখতে হবে-রাজনৈতিক দলের সিদ্ধান্ত জনগণকেও জানতে হবে। কারণ জনগণের জন্যই তাদের রাজনীতি।’
দেশের সংবাদ মাধ্যমের বিরুদ্ধে বিএনপির অভিযোগ সম্পর্কে তিনি বলেন, তারা কি ধরনের অভিযোগ দিচ্ছেন, বিষয়টি নিয়ে চিন্তাভাবনা করতে হবে। কেন তারা অভিযোগ করছেন, ঠিক জানি না। শুধু অভিযোগ করলেই তো হবে না। আগে ভিত্তি খুঁজে বের করতে হবে।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি প্রফেসর ড. মনিরুজ্জামান মিয়া বলেন, ‘একটি রাজনৈতিক দলের সভা রাতে কী দিনে হবে এটা তাদের নিজস্ব সিদ্ধান্তে হবে। তা ছাড়া ওনার (খালেদা জিয়া) যে কোনো সিদ্ধান্তের জন্য টিম আছে। তারা এ ব্যাপারে কাজ করে থাকে।’
‘বিএনপি রাতের রাজনীতি করে’ প্রতিপক্ষের এমন অভিযোগের বিষয়ে প্রফেসর মনিরুজ্জামান মিয়া বলেন, ‘উনি এবং দলের নেতাদের সুবিধামত সময়ের ওপর নির্ভর করে তারা কখন বৈঠক করবে।’
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান বলেন, ‘ম্যাডাম (খালেদা জিয়া) সাধারণত সন্ধ্যার পর অফিসে বসেন। মূলত আমরা তখনই মিটিংগুলো করে থাকি।’
বিএনপির গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তগুলো রাতেই নেওয়া হয় কী না এমন প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘আসলে কিছু বিষয় আছে যা দিনের বেলা করলেই ভালো হয়। দেখি বলবো, বিফ্রিং গুলো যেন দিনের বেলায় হয়। তা ছাড়া বিশেষ মুহূর্ত ছাড়া বিফ্রিংগুলো তো দিনের বেলায়ই হয়ে থাকে।’
জানা গেছে, গণমাধ্যম কর্মীরা দিনের বেলায় যখন সংবাদ সংগ্রহের জন্য উন্মুখ হয়ে নেতাদের হন্যে হয়ে খোঁজেন, তখন দলটির নেতাদের পাওয়া যায় না। অনেকের ফোনও থাকে বন্ধ। দিনের কাজ শেষে রাতে সাংবাদিকরা যখন ঘরে ফেরার অপেক্ষায় থাকেন, সেই সময় একটা প্রেস বিজ্ঞপ্তি অথবা কখনও কখনও সংবাদ সম্মেলন আহ্বান করা হয়। নেওয়া হয় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কোনো সিদ্ধান্ত।
অভিযোগ রয়েছে, বিএনপির অনেক নেতা আছেন যাদের কোনো কর্মসূচিতে দেখা যায় না। কিন্তু রাতে তাদের গুলশান কার্যালয়ে দেখা যায়। সারাদিন বিভিন্ন কাজে ব্যস্ত থাকার পর দলীয় পদ টিকিয়ে রাখতে গুলশান কার্যালয়ে ভিড় করেন তারা। চেয়ারপারসন রাতে আসায় সেই সুযোগ নেন তারা। বেঙ্গলিনিউজটোয়েন্টিফোর.কম