বাংলাভূমি২৪ ডেস্ক ॥ বাংলাদেশীদের জন্য সঙ্কুচিত হয়ে আসছে বিশ্বের শ্রমবাজার। ধীরে ধীরে চাহিদা কমছে। অনেক দেশ আগের মতো শ্রমিক রপ্তানিতে আগ্রহ দেখাচ্ছে না। বিশেষ করে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় শ্রমবাজার মধ্যপ্রাচ্যে জনশক্তি রপ্তানিতে রীতিমতো ধস নেমেছে। মধ্যপ্রাচ্য ছাড়াও মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর এবং আফ্রিকার বেশির ভাগ দেশে শ্রমিকদের কাজের সুযোগ সীমিত হয়ে আসছে। এ অবস্থায় বিশ্ববাজারে শ্রমিক রপ্তানিতে পিছিয়ে পড়ছে বাংলাদেশ। আর এ সুযোগ কাজে লাগাচ্ছে পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত, পাকিস্তান, নেপাল, মিয়ানমার, শ্রীলঙ্কা ও ইন্দোনেশিয়া। সরকারি পরিসংখ্যানে দেখানো হয়েছে, বর্তমানে বিগত বছরের চেয়ে শ্রমিক রপ্তানির হার কমছে। এক হিসাবে দেখা গেছে, গত এক বছরে গড়ে প্রতি মাসে বিদেশে গিয়েছেন ৩৪,৭২৩ জন কর্মী। অথচ ২০১২ সালে সারা বছরে এ সংখ্যা ছিল ৬২,৪৭৩ জন। বাংলাদেশ জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরো-বিএমইটির পরিসংখ্যানে ২০০৮ সালে বাংলাদেশ থেকে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে কর্মী রপ্তানি হয়েছে ৮ লাখ ৭৫,০৫৫ জন। আর ২০১৩ সালে এ সংখ্যা অর্ধেকে নেমে দাঁড়িয়েছে। এ বছর দেশ ছাড়া শ্রমিকের সংখ্যা ৪ লাখ ৯,২৫৩।
শ্রমবাজার হারানোর মূল কারণ হিসেবে দক্ষ জনশক্তি তৈরি করতে না পারাকে দায়ী করছেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, ’৮০-এর দশকে যে অদক্ষ শ্রমিক দিয়ে বাংলাদেশ বিশ্ববাজার দখল করেছিল, বাংলাদেশ এখনও সেখানেই পড়ে আছে। অথচ প্রতিযোগিতার এ বাজারে টিকতে একই সঙ্গে শ্রমশক্তি রপ্তানিকারক দেশ শ্রীলঙ্কা-ফিলিপাইনসহ বিভিন্ন দেশ দক্ষ শ্রমিক তৈরি করেছে। আমরা এ ক্ষেত্রে কোন অগ্রগতি অর্জন করতে পারিনি। ফলে ধীরে ধীরে হাতছাড়া হয়ে যাচ্ছে বিশ্ববাজার। সেখানে ঢুকছে অন্যরা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণা প্রতিষ্ঠান রিফিউজি অ্যান্ড মাইগ্রেটরি মুভমেন্টস রিসার্চ ইউনিট-রামরু’র প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান প্রফেসর ড. তাসনিম সিদ্দিকী বলেন, বাজার যে নেই তা নয়। কিন্তু সেই বাজার থেকে বাংলাদেশ দূরে সরে যাচ্ছে। শ্রম রপ্তানির ক্ষেত্রে দেশটি আগের অবস্থান থেকে ২০ শতাংশ নিচে নেমে এসেছে। এটা শুধু সঠিক সিদ্ধান্ত ও পদক্ষেপ গ্রহণের অভাবের কারণেই হয়েছে। তিনি বলেন, সরকার দেশের ভেতরে শ্রমিক রপ্তানির বিভিন্ন প্রক্রিয়া নিয়েছে। কিন্তু বাইরের বাজার ধরে রাখা এবং তা সংরক্ষণে কোন ব্যবস্থা নেয়নি। ফলে ফল যা হওয়ার তাই হচ্ছে। শ্রমিক দেশে ফেরত চলে আসছে। দরজা বন্ধ হয়ে যাচ্ছে বিভিন্ন দেশের।
সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, বাংলাদেশের শ্রমবাজার যেসব দেশে বন্ধ হচ্ছে সেখানে প্রবেশ করছে ভারত, মিয়ানমার, নেপাল, পাকিস্তান, ফিলিপাইন, শ্রীলঙ্কাসহ আশপাশের দেশগুলো। একসময় মধ্যপ্রাচ্যসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশী শ্রমিকদের চাহিদা ছিল প্রচুর। কিন্তু এখন তাদের প্রতি কোন আগ্রহই নেই দেশগুলোর। ফলে চলতি গত ছয় মাসেই জনশক্তি রপ্তানি প্রায় অর্ধেক কমে গেছে। ২০১২ সালের মতো ২০১৩ সালেও পূরণ হয়নি জনশক্তি রপ্তানির লক্ষ্যমাত্রা। এ কারণে চলতি বছর অর্থাৎ ২০১৪ সালে এ খাতটিতে বিপর্যয়ের আশঙ্কা রয়েছে বলে সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন। তবে শ্রম মন্ত্রণালয়ের একটি সূত্র জানিয়েছে, চলতি বছর বাজার দখলে ৫ লাখ শ্রমিক রপ্তানির লক্ষ্যমাত্রা নিয়েছে সরকার। আর এ জন্য শিগগিরই প্রক্রিয়া শুরু হবে। সংশ্লিষ্টরা জানান, বাংলাদেশী জনশক্তির দ্বিতীয় বৃহত্তর শ্রমবাজার সংযুক্ত আরব আমিরাতে বড় রকমের ধস নেমেছে। একই অবস্থা সৌদি আরবেও। ২০০৮ সালে সংযুক্ত আরব আমিরাতে জনশক্তি রপ্তানি হয় ৪ লাখ ১৯,৩৫৫ জন। ২০১০ সালে তা কমে নেমে আসে ২ লাখ ৩৩০৮-এ। আর ২০১৩ সালে এ সংখ্যা দাঁড়ায় মাত্র ১৪,২৪১ জনে। সৌদি আরবে ২০০৮ সালে ১ লাখ ৩২,১২৪ কিন্তু ২০১৩ সালে সেখানে এ সংখ্যা ছিল ১২,৮৫৪ জন। আর ২০১০ সালে গেছেন মাত্র ৭,০৬৯ জন। আরব আমিরাতে ২০১২ সালের সেপ্টেম্বর থেকেই ব্যাপক হারে বাংলাদেশ কর্মী নেয়া বন্ধ হয়ে পড়ে। দেশটিতে ২০১২ সালে গড়ে প্রতি মাসে প্রায় ২৪ হাজার কর্মী যেতো। ২০১৩ সালে তা ৭৩৮ জনে নামে। অন্যদিকে বৃহৎ শ্রমবাজার সৌদি আরবও ২০০৮ সালের পর থেকে ব্যাপক হারে বাংলাদেশী থেকে কর্মী আমদানি করছে না। আবার দুবাই, ওমান, কাতার বাংলাদেশীদের ভিসা দিচ্ছে না। ইরাক, কুয়েত ও লিবিয়া সরকারও বাংলাদেশ থেকে জনশক্তি আমদানি বন্ধ রেখেছে। মালয়েশিয়ার বাজার চালু হয়েও এখন স্থবির। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাংলাদেশের বৃহত্তম শ্রমবাজার সৌদি আরব বাংলাদেশ থেকে জনশক্তি আমদানি দীর্ঘদিন বন্ধ রাখার পর একমাত্র আরব আমিরাতই সেই ক্ষতি পুষিয়ে দিয়েছে। কিন্তু এ দু’টি দেশ বাংলাদেশ থেকে শ্রমিক আমদানি বন্ধ করে দেয়ায় এ বিপর্যয়ের মুখে বাংলাদেশ। অভিযোগ রয়েছে, দেশের বিমানবন্দর, ইমিগ্রেশন, রিক্রুটিং এজেন্সি, বিএমইটির কিছু অসাধু কর্মকর্তার যোগসাজশে ভুয়া কাগজপত্র নিয়ে বিদেশে পাড়ি দেন কর্মীরা। এ জন্য দক্ষতার বিষয়টি থেকে যায় অবহেলায়। দালাল চক্র ৩ থেকে ৫ লাখ টাকা নিয়ে কর্মীদের সেখানে পাঠায়। কিন্তু অদক্ষ হওয়ায় তাদের পক্ষে সেখানে গিয়ে কাজ করতে হিমশিম খেতে হয়। ভাষা ও কাজের অদক্ষ হওয়ায় চাকরি হারাতে হয় তাদের। পরে জেল খেটে, রাস্তাঘাটে ঘুরে শূন্য হাতে তারা একেবারে দেশে ফিরে আসছেন। সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, কূটনৈতিক ব্যর্থতা, সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের অদক্ষতা ও জনশক্তি রপ্তানিকারক কিছু প্রতিষ্ঠানের প্রতারণার কারণে জনশক্তি রপ্তানিতে এ দুর্যোগ। বাংলাদেশ এসোসিয়েশন অব ইন্টারন্যাশনাল রিক্রুটিং এজেন্সিস (বায়রা) মহাসচিব আলী হায়দার চৌধুরী বলেন, বিশ্ব অর্থনৈতিক মন্দাও এর জন্য দায়ী। তবে আমাদের নিজেদের ব্যর্থতাই বাজার হারাতে ভূমিকা রাখছে বেশি। অদক্ষতার পাশাপাশি দেশগুলোর সঙ্গে আমাদের পারস্পরিক সম্পর্কের অবনতিও একটি বিষয়। তা ছাড়া চাহিদামতো শ্রমিক দিতে না পারা। বাজার ধরতে না পারা এসব কারণেও পিছিয়ে পড়ছি আমরা। এ প্রসঙ্গে প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান সচিব ড. খোন্দকার শওকত হোসেন বলেন, বাজার বাড়া-কমা একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। কোথাও বাড়বে, কোথাও কমবে। সৌদি আরবে বাজার না খুললেও আকামা পরিবর্তনের সুযোগ দেয়া হয়েছে। এটি শ্রমিকদের জন্য ইতিবাচক। তিনি বলেন, দক্ষ জনশক্তি তৈরিতে আমাদের সীমাবদ্ধতা আছে। আমরা দেড় লাখ শ্রমিককে বছরে প্রশিক্ষণ দিতে পারি। কিন্তু প্রয়োজন প্রায় ৫ লাখ। এ জন্য বিভিন্ন মন্ত্রণালয়েরও সহযোগিতা নেয়া হচ্ছে। প্রশিক্ষণ সুবিধা বাড়ানোর দিকে জোর দিচ্ছি আমরা। এ জন্য প্রত্যেক উপজেলায় তা ছড়িয়ে দেয়ার উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে। মানবজমিন