কাপাসিয়া (গাজীপুর) প্রতিনিধি ॥ গাজীপুরের কাপাসিয়া উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসে জগদ্দল পাথরের মতো সীমাহীন ঘুষ, দূর্নীতি, বিভিন্ন কাজে অনিয়ম, গাফিলতি ও কর্মকর্তার বিরুদ্ধে স্বেচ্ছাচারিতা এবং শিক্ষকদের সাথে অসৌজন্যমূলক আচরণের অভিযোগ উঠেছে। টাইমস্কেল, পে-বিল, ইনক্রিমেণ্ট, রিক্রিয়েশন বিল, এরিয়া বিল এবং পেনশন ও গ্রাচ্যুয়েটির ক্ষেত্রে মোটা অংকের উৎকোচ না দিলে ফাইল নড়াচড়া করেনা বলে জানা গেছে। এসব কারণে দীর্ঘদিন যাবত দেশ-জাতি গড়ার কারিগর শিক্ষকদের মাঝে বিরাজ করছে চাপা ক্ষোভ ও উত্তেজনা।
বিভিন্ন সূত্র থেকে জানা যায়, শিক্ষকরা প্রতিমাসের ১ তারিখে মাসিক বেতন (পে-বিল) পাওয়ার কথা থাকলেও বর্তমানে তা পাচ্ছেনা। শিক্ষা অফিস থেকে বিলম্বে ট্রেজারী অফিসে বিল পাঠানোর কারণে শিক্ষকরা প্রতি মাসের ৫/৭ তারিখে মাসিক বেতন তুলতে বাধ্য হচ্ছেন। অবসর প্রাপ্ত শিক্ষকদের পেনশনের কাগজপত্র ও গ্রাচ্যুয়েটি বিল তৈরী করতে দিনের পর দিন অফিসে ধর্ণা দিতে হচ্ছে। মোটা অংকের টাকা ছাড়া এ অফিসের কোন ফাইল নড়াচড়া করেনা বলে ভূক্ত ভোগী শিক্ষকরা জানান।
শিক্ষকরা সময় মত চিত্তবিনোদন/রিক্রিয়েশন বিল পাচ্ছেনা। শিক্ষা অফিসারের দায়িত্বহীনতার কারণে প্রায় ২ মাস যাবত বিনোদন ভাতা ট্রেজারী অফিসে পড়ে আছে। ভাতার এ টাকা সঠিক সময়ে উত্তোলন করা না হলে পরবর্তীতে বাড়তি ঝামেলা পোহাতে হবে শিক্ষকদের । শিক্ষকরা তাদের এ ভাতার টাকা উত্তোলন করতে আসলে শিক্ষা অফিসারকে উৎকোচ না দেওয়ার কারণে নানা তাল-বাহানায় দূরে রাখেন বলে শিক্ষকরা জানান।
টাইম-স্কেল, ইনক্রিমেন্টের ও ইবিক্রসের জন্যও শিক্ষকদের দিতে হয় ঘুষ। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক সহকারী শিক্ষক জানান, শিক্ষা অফিসার শামীম আহমেদ’র সাথে যোগাযোগ করলে তিনি বলেন, ‘পরে আসেন। আপনার ক্লাসের সব ছাত্র ছাত্রীরা কি সব পড়া পারে? এসব কথা বলে তিনি বিষয়টি এড়িয়ে যান’।
মাতৃত্বকালীন ছুটি, আন্তঃ জেলা বদলী, এক প্রতিষ্ঠান থেকে অন্য প্রতিষ্ঠানে বদলী, চাকুরি রত অবস্থায় উচ্চ শিক্ষার জন্য ভর্তির অনুমতির জন্য উৎকোচ না দিলে তাদেরকে চরম হয়রানীর শিকার হতে হয়।
বিভিন্ন বিদ্যালয়ের দপ্তরী-কাম নৈশপ্রহরী নিয়োগে উপজেলা শিক্ষা অফিসের বিরুদ্ধে ব্যাপক অনিয়ম এবং ঘুষ বাণিজ্যের অভিযোগ উঠেছে। নিয়োগ পরীক্ষায় প্রথম স্থান হওয়া প্রার্থীকে নিয়োগ না দিয়ে অযোগ্য প্রার্থীকে নিয়োগ দেয়ার অভিযোগ রয়েছে। এ নিয়োগ নিয়ে উপজেলার সর্বত্র রয়েছে মুখরোচক ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনা । দপ্তরী-কাম নৈশ প্রহরী নিয়োগে অনিয়মের কারণে নিয়োগ বাতিলের জন্য কমপক্ষে ২ ডজন প্রতিষ্ঠান উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের বরাবর আবেদন করেছে বলে জানা গেছে। এসব কারণে বর্তমানে বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের নিয়োগ ঝুলে আছে।
উপজেলার তরুল সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আব্দুস সাদেক জানান, কানিজ ফাতেমা নামে তাঁর এক সহকারী শিক্ষক ১ বছর যাবত ছুটি না নিয়ে বিদ্যালয়ে অনুপস্থিত রয়েছে এবং বর্তমানে সে স্বামীর সাথে ইতালী প্রবাসী। মাসিক প্রতিবেদনে অনুপস্থিতির কারণে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর থেকে বার বার ব্যবস্থা নেয়ার নির্দেশ সত্ত্বেও রহস্য জনক কারণে তাঁর বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছেনা। ফলে একজন শিক্ষক ছাড়া পাঠদান ব্যাহত হচ্ছে।
অফিস সহকারী মোজাম্মেল হক’কে গত কয়েক বছর আগে অফিসের ভিতরে ঘুষ নেয়ার সময় দূর্নীতি দমন কর্মকর্তারা তাকে হাতেনাতে আটক করে এবং থানায় মামলা দেয়। এতে সে সাময়িক ভাবে বরখাস্ত হয়। প্রতি দিন সে অফিসে শুধুমাত্র হাজির থাকার কথা। অথচ নিয়মবর্হিভূত ভাবে বরখাস্তকৃত অফিস সহকারী মোজাম্মেল রীতিমত অফিসের সকল কাজ-কর্ম করছেন।
এদিকে বর্তমান কাপাসিয়া শিক্ষা অফিসার শামীম আহমেদের বিরুদ্ধে কর্মস্থলে না থাকার অভিযোগ উঠেছে। তিনি ঢাকা থেকে আসেন এবং প্রতি দিন ঢাকায় চলে যান বলে জানা যায়। এতে অফিসে বিভিন্ন ধরনের ফাইল স্তুুপ হয়ে পড়ে থাকে। শিক্ষকরা অফিসে এসে সময় মত না পাওয়ার ফলে তারা হয়রানীর শিকার হচ্ছেন। শিক্ষা অফিসার শামীম আহমেদ গত জোট সরকারের আমলে কাপাসিয়ায় সহকারী শিক্ষা অফিসার হিসেবে কর্মরত থাকা অবস্থায় বিভিন্ন অনিয়মের অভিযোগে অন্যত্র বদলী হয়েছিলেন বলে একটি সূত্র জানায়। সে সময় শিক্ষকদের সাথে বিশেষ করে মাতৃত্বকালীন ছুটির পর শিক্ষক মায়ের সাথে তার শিশু সন্তান স্কুলে আনার কারণে তার অমানবিক ও রুক্ষ আচরণ এখনও বদলায়নি। বরং তার পদোন্নতির সাথে সাথে তার মাত্রাও বেড়েছে। সম্প্রতি বিভিন্ন স্কুলে পরিদর্শনে গিয়ে মায়ের সাথে তার নিস্পাপ শিশু সন্তানকে দেখে ক্ষেপে যান এবং স্কুলে বাচ্চা আনা যাবে না বলে নির্দেশ জারী করে গালমন্দের ঘটনা ঘটে। তার এ ধরনের অসৌজন্যমূলক আচরণে শিক্ষকরা চরম ভাবে ক্ষুব্দ। নাম প্রকাশে একজন শিক্ষক জানান, শিক্ষা অফিসার শামীম আহমেদ ছাত্র জীবনে ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের জিয়া হলে থাকা অবস্থায় একটি রাজনৈতিক সংগঠনের সক্রিয় কর্মী ছিলেন । বর্তমানে তার আচরণে ছাত্র জীবনের সেই বৈশিষ্ট্য ফুটে উঠছে।
গাজীপুর জেলা প্রাথমিক শিক্ষক সমিতির সাংগঠনিক সম্পাদক ও চন্ডালহাতা সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মোঃ আশরাফুল আলম খান জানান, শিক্ষা অফিসের দূর্নীতি ও অনিয়ম নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা। বর্তমান শিক্ষা অফিসারের আচরণে শিক্ষকরা ক্ষুব্দ। সহকারী শিক্ষা অফিসার ও শিক্ষকদের সাথে শিক্ষা অফিসারের সমন্বয়ের ঘাটতি রয়েছে। শিক্ষদের ন্যায্য অধিকার আদায়ের জন্য শিক্ষকরা আন্দোলনে যাবে বলে তিনি জানান। জেলা প্রাথমিক শিক্ষক সমিতির ক্রিড়া সম্পাদক ও বরাইদ সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক শরিফুল আলম জানান, শিক্ষা অফিসারের কারণে সে তার একটি বিল নিয়ে র্দীঘদিন যাবত হয়রানীর শিকার হচ্ছেন। চাঁদপুর সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক এমদাদুল হক আরমান জানান, কোন অবস্থাতেই শিক্ষকদের এ হয়রানী মেনে নেয়া যায় না।
এসব বিষয়ে উপজেলা শিক্ষা অফিসার শামীম আহমেদ জানান, তার অফিসে এ ধরনের কোন অনিয়ম হয়নি। কেউ কোন অভিযোগ দিয়ে থাকলে তা ষড়যন্ত্র ও উদ্দেশ্য মূলক।
শিক্ষা অফিসের অনিয়ম দূর্নীতি ও শিক্ষা অফিসার শামীম আহমেদের অসৌজন্যমূলক আচরণের বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে কাপাসিয়া উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান বীর মুক্তিযোদ্ধা আলহাজ¦ খন্দকার আজিজুর রহমান পেরা ও ভাইস-চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট রেজাউর রহমান লস্কর মিঠু ক্ষুব্দ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে বলেন, যে কোন দূর্নীতি, অনিয়ম, স্বেচ্ছাচারিতা ও অফিসারদের অসৌজন্যমূলক আচরণ বরদাশত করা হবে না এবং এ ব্যাপারে সকলের সহযোগিতার মাধ্যমে যথাযথ ব্যবস্থা নেয়া হবে।