কঠিন পথ পাড়ি দিচ্ছে নারী

বাংলাভূমি২৪ ডেস্ক ॥
ঢাকা:অর্থনৈতিক সমতা, রাজনীতিতে অংশগ্রহণ, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবা প্রাপ্যতার ভিত্তিতে নারী-পুরুষ সমতার সূচকে এগিয়েছে দেশ। ঘর থেকে বেরিয়ে নারী পৌঁছে গেছে কর্মক্ষেত্রের উচ্চ পদে; অবদান রাখছে মানবতার উন্নয়নে। তবে নারীর ক্ষমতায়ন, এগিয়ে যাওয়া, স্বাবলম্বী হয়ে ওঠা বা নিজ ন্যায্য অধিকার প্রতিষ্ঠায় পাড়ি দিতে হচ্ছে কঠিন পথ। নারীর সাফল্যের পথে এখনও বাধা হচ্ছে পুরুষতান্ত্রিক সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি। নারীর প্রতি সহিংসতা, ধর্মকে নারীর বিরুদ্ধে ব্যবহার, নীতিনির্ধারকদের মনোভাব মর্যাদার লড়াইয়ে পিছিয়ে দিচ্ছে নারীকে। কঠিন পথ পাড়ি দিচ্ছে নারী

মানবাধিকারকর্মী ও নারীনেত্রীরা বলছেন, সমাজে নারীর অবদান-অর্জনকে অবমূল্যায়ন এবং পুরুষের অধস্তন পর্যায়ে দেখার ফলে সহিংসতা, নির্যাতন ও অমর্যাদা জ্যামিতিক হারে বাড়ছে; নস্যাৎ করে দিচ্ছে মানবিক মর্যাদা, সমতাভিত্তিক সমাজ নির্মাণের সোনালি স্বপ্ন। দেশীয় ও আন্তর্জাতিক আইন, নাগরিক সমাজের নানা উদ্যোগ ও সরকারের প্রচেষ্টা- এত রক্ষাকবচ, তবুও নারীর প্রতি অন্যায্য আচরণ ও সহিংসতা কোনোভাবেই কমছে না। এখনও দেশের বেশির ভাগ পুরুষ মনে করেন, নারীর গায়ে হাত তোলার অধিকার তারা রাখেন।
আইসিডিডিআরবির বাংলাদেশে লিঙ্গীয় পরিচয় (জেন্ডার) এবং নারীর প্রতি সহিংসতা সম্পর্কে পুরুষের মনোভাব ও চর্চা শীর্ষক গবেষণায় দেখা গেছে, গ্রামের ৮৯ ও শহরের ৮৩ শতাংশ পুরুষ মনে করেন, স্ত্রী অন্যায় কিছু করলে গায়ে হাত তোলার অধিকার আছে স্বামীর। শহরের ৫০ ও গ্রামের ৬৫ শতাংশ পুরুষ বিশ্বাস করেন, পরিবারকে রক্ষা করার জন্য নারীদের নির্যাতন সহ্য করা উচিত।
একই গবেষণায় উঠে এসেছে, শহরের ৭৭ ও গ্রামের ৮১ শতাংশ পুরুষ বিশ্বাস করেন, যৌনতা বা এ-সংশ্লিষ্ট বিষয়গুলোতে অধিকার শুধু পুরুষের। পরিবারে সিদ্ধান্ত গ্রহণের অধিকার শুধু পুরুষের; স্বামীর বাধ্য থাকা স্ত্রীর কর্তব্য। স্বামীর সঙ্গে শারীরিক সম্পর্ক স্থাপনে স্ত্রীর কখনোই অসম্মতি জানানো উচিত নয় বলে মত দিয়েছেন বেশির ভাগ পুরুষ।
রাস্তাঘাটে, পরিবারে, কর্মক্ষেত্রে, শিক্ষাক্ষেত্রে এখনও নির্যাতন ও যৌন হয়রানির শিকার হচ্ছেন নারী। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) ‘ভায়োলেন্স অ্যাগেইনস্ট উইমেন (ভিএডব্লিউ) সার্ভে ২০১১’ শীর্ষক জরিপে দেখা গেছে, দেশের বিবাহিত নারীর ৮৭ শতাংশই স্বামীর মাধ্যমে কোনো না কোনো সময়ে, কোনো না কোনো ধরনের নির্যাতনের শিকার হয়েছেন।
মনোবিজ্ঞানী আনোয়ারা হক বলেন, সমাজে এখনও নারীর প্রধান বাধা পুরুষতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গি। এ অবস্থার পরিবর্তন ততক্ষণ পর্যন্ত হবে না, যতক্ষণ মেয়েরা নিজেরা কিছু করছে।
প্রতিদিন ঘর থেকে বের হয়ে পরিবারের কাছে ফিরে আসার আগ পর্যন্ত সরাসরি বা প্রযুক্তিগত নানা উপায়ে নিপীড়নের শিকার হন নারী। অ্যাকশনএইডের ‘নিরাপদ নগরী নির্ভয় নারী’ শীর্ষক গবেষণায় দেখা গেছে, শহরের ৪৭ দশমিক ৫ শতাংশ নারী গণপরিবহন, রাস্তা বা উন্মুক্ত জনবহুল এলাকায় চলাফেরার ক্ষেত্রে নিরাপত্তাহীনতায় ভোগেন। আর ৮১ শতাংশ নারী যৌন হয়রানির ক্ষেত্রে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যের কাছে সহায়তার জন্য যেতে চান না। ৮৮ শতাংশ নারী পথচারী, পুরুষ যাত্রী ও ক্রেতার দ্বারা হয়রানির শিকার হন। তারা বলেছেন, পুলিশের সাহায্য চাইলে সমস্যা বাড়ে। যৌন সহিংসতা এড়াতে ৬৪ শতাংশ নারী রাতে ঘরের বাইরে যান না। এ ছাড়া মানুষ চলাচলের জায়গায় ৮৫ শতাংশ নারী মর্যাদাহানিকর উক্তির শিকার হয়েছেন এবং ৪৬ শতাংশ নারী অশ্লীল কথা শুনেছেন।
১১ আর্মস পুলিশ ব্যাটালিয়নের মহা-অধিনায়ক (পুলিশ সুপার) সালমা বেগম বলেন, সমাজ সব সময় নারীকে বেঁধে ফেলতে চায়, টেনে ধরতে চায়। তবে নারী যদি সত্যিকার অর্থে এ পরিস্থিতি থেকে বেরিয়ে আসতে চান, সমাজ কিছু করতে পারবে না। আসলে হাজার বছরের পুরুষতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গি তো এত দ্রুত পরিবর্তন হবে না। তাকে আঘাতে আঘাতেই ভাঙতে হবে। নারী যখন লড়াই-সংগ্রাম করে হলেও সফল হচ্ছে, উচ্চ পদে অধিষ্ঠিত হচ্ছে, তখন রাষ্ট্র ও সমাজ একেবারে সহযোগিতা করছে না- সেটাও বলা যাবে না।
ধর্ষণের শিকার নারীরও দোষ আছে, নারী যদি বাধা না দেন, তবে তা ধর্ষণ হবে না- এ ধরনের দৃষ্টিভঙ্গি লালন করেন অনেক পুরুষ। আইসিডিডিআরবির গবেষণায় দেখা গেছে, ৪০ শতাংশ পুরুষ তাদের বয়স ১৯ বছর হওয়ার আগে নারী ধর্ষণ করেছে, ৫৭ থেকে ৬৭ শতাংশ শুধু মজা করার জন্যই নারীদের যৌন হয়রানি করেছে; ৪৩ থেকে ৫১ শতাংশ পুরুষ বলেছে যে নারীদের যৌন হয়রানি করার পর তাদের কোনো অনুশোচনা হয়নি।
মহিলা পরিষদের সভাপতি আয়শা খানম বলেন, নারীর প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি এখনও মধ্যযুগের মতো। টক শোগুলোতে মাঝেমধ্যে নারীকে নিয়ে আলোচনা হয়। ধর্ষণ কিংবা যৌন হয়রানির ঘটনায় অনেকে বলেন, নিশ্চয়ই ছেলেটির সঙ্গে কোনো সম্পর্ক ছিল; কাপড়ে শালীনতা ছিল না। ধরে নিলাম, ছেলেটির সঙ্গে সম্পর্ক আছে। সম্পর্ক থাকলে অসুবিধা কোথায়? সম্পর্কের জন্য তাকে ধর্ষণ করতে হবে? হত্যা করতে হবে? মেয়েটি যে কাপড় পরছে, এটি তার কাছে শালীন। এ বিষয়ে অন্যের মন্তব্যটাই অশালীন। এসব সস্তা আলোচনায় মানুষের মধ্যে আরও বিভ্রান্তি তৈরি হয়। যে ব্যক্তি একটি মেয়ের পোশাক নিয়ে আলোচনা করছে, সে মেয়েটির ব্যক্তিগত জীবনে প্রবেশ করছে। এটি একটি জঘন্য অপরাধ। আমাদের ছোটবেলায় এ রকম নোংরা রাজনৈতিক কালচার ছিল না। একটি মেয়ে কীভাবে কাপড় পরবে, কীভাবে চলবে, এটি তার নিজস্ব ব্যাপার। রাষ্ট্রের দায়িত্ব হলো তাকে নিরাপত্তা দেওয়া।
প্রযুক্তির অবাধ ব্যবহারেও নারীর প্রতি সহিংসতার মাত্রা উদ্বেগজনক হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। গোপনে বা জোরপূর্বক অশ্লীল ভিডিও বা ছবি ধারণ করে তা ইন্টারনেটে ছড়িয়ে দেওয়া, ছড়িয়ে দেওয়ার হুমকি প্রদান ও ভয়ভীতি প্রদর্শন করে প্রতিনিয়ত নারীর ওপর শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন ঘটে চলেছে।
পোশাকশিল্পে তথা দেশের অর্থনীতিতে বিরাট ভূমিকা রাখছেন গার্মেন্টে কাজ করা নারী শ্রমিকরা। বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ গার্মেন্ট কারখানায় নারী শ্রমিকদের কর্মপরিবেশ শীর্ষক গবেষণায় উঠে এসেছে, গার্মেন্ট কারখানায় কাজ করতে গিয়ে ৩০ শতাংশ নারী শ্রমিক নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন। ৭৬ শতাংশ নারী শ্রমিকই মনে করেন, তারা যে কোনো সময় কাজ হারাতে পারেন।
সরকারিভাবে মোট জাতীয় উৎপাদনে (জিডিপি) নারীর অবদান এখন ২০ শতাংশ, তবে গৃহস্থালির মজুরিবিহীন কাজ হিসাব করলে আনুমানিক মূল্য দাঁড়ায় আড়াই লাখ কোটি টাকা। জিডিপিতে নারীর অবদান দাঁড়াবে প্রায় অর্ধেক, অর্থাৎ ৪৮ শতাংশে।
উইমেন চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির প্রেসিডেন্ট সেলিমা আহমেদ বলেন, মজুরিবিহীন কাজকে কাজ হিসেবেই দেখা হয় না। পুরুষরা যেহেতু উপার্জনকারী ও বাইরের কাজ করে, তাই তাদের সামাজিকভাবে উচ্চবিত্তের এবং নারীরা মজুরিবিহীন ঘরের ও সেবামূলক কাজ করে, তাই তারা নিম্নবিত্তের। পুরুষের কাজ রিয়েল ওয়ার্ক আর নারীর কাজ নট রিয়েল ওয়ার্ক। এই সামাজিক শ্রমবিভাজনের কারণে নারীর অবস্থান নির্ভরশীলতার এবং মর্যাদার দিক থেকে পুরুষের নিচে। ফলে এ ধরনের নারীরা হয়ে ওঠে সমাজের কাছে বোঝা, বেকার ও মূল্যহীন। এই সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গির কারণে অর্থনৈতিক ও সামাজিক অবদানের দিক থেকে নারীরা যথার্থ অবদান রাখা সত্ত্বেও পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্র- কোথাও থেকে স্বীকৃতি ও মূল্যায়ন পাচ্ছে না।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ফারজানা ইসলাম বলেন, নারীর ক্ষমতায়নের ক্ষেত্রে সাফল্য কিংবা সভ্যতার অনেক উন্নতি সত্ত্বেও রাষ্ট্র ও পরিবারে নারীর প্রতি বৈষম্য বিরাজমান। লিঙ্গীয় সমতা এখনও আকাঙ্ক্ষিত পর্যায়ে সর্বত্র সমানভাবে প্রয়োজন অনুযায়ী অর্জিত হয়নি। নারীর মানবিক বিকাশ ও তার জীবনের নিরাপত্তা এখনও সংকটমুক্ত নয়। এখনও প্রতিক্রিয়াশীল গোষ্ঠী নারীকে মধ্যযুগে নিয়ে যাওয়ার পাঁয়তারা করছে। এখানে রাষ্ট্রের বড় ভূমিকা থাকা প্রয়োজন। সূত্র- সমকাল

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত আরও সংবাদ

সাম্প্রতিক সংবাদ

আর্কাইব

Sat Sun Mon Tue Wed Thu Fri
 123456
78910111213
14151617181920
21222324252627
28293031  

প্রধান সম্পাদক : সাঈদুর রহমান রিমন
সম্পাদক ও প্রকাশক : মোঃ নজরুল ইসলাম আজহার

সার্বিক যোগাযোগ : চৌধুরী মল (৫ম তলা), ৪৩ হাটখোলা রোড, ঢাকা-১২০৩॥

গাজীপুর অফিস : এ/১৩১ (ইকবাল কুটির) হাবিব উল্লাহ স্মরণী, জয়দেবপুর, গাজীপুর-১৭০০॥

হটলাইন: ০১৭৫৭৫৫১১৪৪ ॥ সেলফোন : ০১৭১৬-৩৩৩০৯৬ ॥ E-mail: banglabhumibd@gmail.com

© সর্বস্বত্ব স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত বাংলাভূমি ২০০৯-২০২৫